ছবি: কুনাল বর্মণ
দেবাংশুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হল মিনির বাড়িতে। মিনি একটা ছোট্ট গ্যাদারিং অ্যারেঞ্জ করেছিল সে দিন। ঠিক রাহুল চলে যাওয়ার পর পরই। আমিও যেমন অর্ণবের সঙ্গে ছাড়াছাড়িটা করতে চাইছিলাম, আমার পাঁচ বছরের ছোট বোন মিনিও রাহুল আর ওর লিভ-ইন রিলেশনটা থেকে বেরোতে চাইছিল। কিন্তু চাইলেও ব্যাপারটা বোধহয় সহজ নয়। বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকা মানে এই নয় যে চাইলেই বেরিয়ে যাওয়া যায়। শেষ অব্দি ছ’বছর পর আমার আর অর্ণবের যে দিন সেপারেশন হয়ে গেল তার ক’দিন পর মিনি বলল, ‘‘দিদি, আজ ভোরবেলা রাহুল মুভ আউট করে গেল।’’
আমি বললাম, ‘‘তা হলে রাহুলও চলে গেল?’’
মিনি বলল, ‘‘হ্যাঁ। চলে গেল। তবে আবার ফিরেও আসতে পারে!’’
‘‘ফিরে আসবে কেন? তোদের কি প্রপার ব্রেক-আপ হয়নি? না কি সাময়িক ব্রেক?’’
‘‘দিদি, এটা ব্রেক-আপের ব্যাপার নয়। মুম্বই যদি ওর স্যুট না করে তা হলে কলকাতায় ব্যাক করবে। তাই বলে গেল যে যদি ফিরে আসতে হয় তা হলে ক’দিন আবার এই ফ্ল্যাটে এসে থাকতে পারে। এটা তো ঠিকই যে এই ফ্ল্যাটটা রাহুলই খুঁজে বের করেছিল। আমার তো তখন চাকরি ছিল না। রাহুলের পে স্লিপ আর জব সিকিয়োরিটি দেখেই তো বাড়ির মালিক ভাড়া দিতে রাজি হয়েছিল। তাই ও যদি ক’দিন এসে থাকতে টাকতে চায়, তা হলে আমি তো না বলতে পারব না।’’
আমার এই ফ্ল্যাটটা আমি তিন মাস আগে হাতে পেয়েছি। থ্রি বিএইচকে। বুক করেছিলাম তিন বছর আগে। ফ্ল্যাটটার চাবিটা হাতে পেলাম বলেই অর্ণবের সঙ্গে বিচ্ছেদের ডিসিশনটা নিতে পারলাম। নইলে আমার আর নতুন বাড়ি-টাড়ি দেখে শিফট করার মতো উৎসাহ ছিল না। আর অর্ণবও কিছু উচ্চবাচ্য করছিল না ডিভোর্স নিয়ে। যে যার চাকরি নিয়ে আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই ওই এক ছাদের নীচে থাকছিলাম। ঠিক এই সময়ই বিল্ডার জানাল, ফ্ল্যাট রেডি হয়ে গিয়েছে। আর আমিও অর্ণবের সঙ্গে কথা বলে একসঙ্গে লইয়ারের কাছে গিয়ে মিউচুয়াল ডিভোর্সের কাগজে সই করে এলাম। মার্চ মাসে আমাদের ফাইনাল সইটা হয়ে যাওয়ার কথা।
ডিসেম্বরের শুরুতে এক দিন ফোন করে মিনি বলল, ‘‘কাল আয়। কয়েক জন বন্ধুবান্ধব আসবে। ডিনার খাওয়াব। তোর ভাল লাগবে। কী একা একা থাকিস। বললেও আসিস না। এ বার একটা প্রেম কর।’’
আমি বললাম, ‘‘তুই বরং এসে ক’দিন আমার কাছে থাক। এত সুন্দর একটা আবাসন। আলো-হাওয়া ভরা একটা ফ্ল্যাট। তোর অফিসের কাছেও!’’
মিনি বলল, ‘‘থাক থাক। এত ব্যাখ্যা দিতে হবে না। এই যে কথাগুলো বলিস না, একদম সেকেলে পিসিমা টাইপের। আমার সহ্য হয় না। কাল আসবি কিন্তু। আর বাড়ি ফিরতে হবে না রাতে। পরশু তো সানডে।’’
বাবা জামসেদপুরে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার আর মিনির মধ্যেও যে খুব একটা যোগাযোগ আছে তা নয়। আমি তাও বিয়ে-টিয়ে করেছিলাম নিজের মতো করে। মিনি তো পড়াশোনা করতে কলকাতা আসা ইস্তক একটা ফ্লোটিং লাইফই লিড করে গেল।
মিনির তিনতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলাম একটা মাত্র ছেলে এসেছে। বয়স তিরিশ হবে। লিভিংরুমের গদির ওপর ল্যাপটপ খুলে খুব মন দিয়ে কী কাজ করছে। আমাকে দেখেই ল্যাপটপ বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল ছেলেটা। মিনি বলল, ‘‘দেবাংশু, এই আমার দিদি বিভা। দিদি, ও দেবাংশু। আমার কলিগ। ও বহিরাগত বাঙালি। চাকরির জন্য এখন কলকাতায়।’’
দেবাংশু হাঁ-হাঁ করে উঠল। ‘‘প্রবাসী বাঙালি! প্রবাসী বাঙালি! আভা, বহিরাগত বাঙালিটা আবার কী?’’ আভা হল মিনির ভাল নাম। মিনির বাংলা খুব খারাপ।
দেবাংশু বেশ নম্র। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমার সঙ্গে দেবাংশুর ভাব হয়ে গেল। আটটা নাগাদ যখন মোটামুটি আরও দু-তিনজন এসে পৌঁছেছে, তত ক্ষণে দেবাংশু আর আমি মিনির ল্যান্সডাউন রোডের ভাড়া বাড়ির ঝুলবারান্দায় নিজেদের জন্য একটা কমফর্ট জোন তৈরি করে ফেলেছি। দেবাংশু গিটারও বাজায় না, কবিতাও লেখে না। তবে নাগপুরে ওদের একটা ছোট্ট গ্রুপ ছিল। চার-পাঁচ জন মিলে ওরা একটা পাক্ষিক কাগজ বের করত। শিল্প ও সংস্কৃতির উপর। আমি ও-সব খুব একটা বুঝি না। ফিন্যান্সে এমবিএ করেছি। আর্টের মধ্যে সিনেমা দেখতে আমি খুব ভালবাসি। কিন্তু হরর মুভি! হরর মুভি দেখা, সোশ্যাল ডিসওরিয়েন্টেশন, অসুখী দাম্পত্য, বাথরুমে এক ঘণ্টা ধরে সময় কাটানো, এগুলো আর কিছু দিন আগেও আমার সম্পর্কে ‘কি’ ইনফরমেশন হিসেবে ধরা হত। এখন ছবিটা একটু পালটেছে। দেবাংশু আমাকে একটা সুন্দর ড্রিংক বানিয়ে এনে দিয়েছে। ককটেল। রাস্তার ওপর দিয়ে ঘোড়ায়-চড়া বর আর তার সঙ্গে বরযাত্রীদের একটা প্রসেশন যাচ্ছে। ব্যান্ড পার্টি, তাসা পার্টি, হ্যাজাকের আলোয় এই ছোট্ট ঝুলবারান্দাটা যেন কেমন বদলে গেল এক নিমেষে। আমি দেখলাম দেবাংশুর মুখের ওপর একটা লাল আলো পড়ে সরে গেল, তার পর বেগুনি আলো, তার পর কোনও আলো নেই, শুধু ওর মুখের নরম চামড়াটা, তার পর আবার লাল আলো, সবুজ আলো, তার পর আমার চোখের সঙ্গে ওর চোখ ঘষে গেল, আচমকা! দেবাংশুর চোখ দু’টো কী নিষ্পাপ, তাই না? আমার কী হল, বারবার ইচ্ছে হল ছেলেটার কালো ঘন মণির দিকে তাকাতে। আর চোখের ওপর এসে পড়া কোঁকড়া চুলগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আমার আঙুলগুলো কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো শূন্যে সাঁতরাতে লাগল। আমি চকিতে মিনিকে লিভিং রুমে খুঁজলাম। মিনি আমাকে ভালবাসে কি না জানি না। আমি আমার বোনকে ভালবাসি। একটা অসুখী দাম্পত্যের ভিতর আমরা দু’জনে বড় হয়েছি। অসুখী পরিবারগুলোর জীবনে কি পিছনের বাগানের একটা ভূমিকা থাকে? আমি আমাদের বাংলোর পিছনের বাগানে মা’কে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম নিশুত রাতে। আর মিনি আমাদের পিছনের বাগানে একটা কাদামাখা হলুদ লরি দেখতে পেত। যেমন লরিতে করে আত্মহত্যা করার পর জুঁইয়ের মায়ের ডেডবডি শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লরিটা আমার আর মিনির বেডরুমের জানলায় নাকি হেডলাইট দু’টো ঠেসে ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। তখন তো আমিই মিনিকে বোঝাতাম, ‘‘এই লরিটার তো জুঁইদের পিছনের বাগানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। এই লরিটা আমাদের বাগানে কখনও আসবে না। মা কখনও আত্মহত্যা করবে না।’’ কে জানে হয়তো দেবাংশু মিনির বয়ফ্রেন্ড! আমি দেবাংশুর লাল টুকটুকে তুলতুলে নরম কানের লতিটা দেখে ফেললাম। নিজের অজান্তেই আমার কান গরম হয়ে উঠল। হঠাৎ দেবাংশু নিজের ফোনটা তুলে নিয়ে আমার ছবি তোলার চেষ্টা করল। একটা দু’টো তিনটে আটটা ন’টা। ‘‘এই আলোটা, এই আলোটা নেব... দেখি!’’ আর দেবাংশুই আমাদের দু’জনের সেলফি তুলতে চাইল। খচখচ করে সেলফিও উঠল আমাদের কয়েকটা। মিনি এসে বলল, ‘‘এই, তোরা তো দেখছি ড্রিংক শেষ করতেও ভুলে গিয়েছিস?’’ আমি অকারণেই লজ্জা পেলাম। বললাম, ‘‘চল, ভিতরে গিয়ে বসি। সবার সঙ্গে আলাপ করি।’’
কিন্তু দেবাংশু আমাকে বলল, ‘‘না না, তুমি এখানেই বসো তো। কী রকম সুন্দর ঠান্ডা পড়েছে।’’ দেবাংশু আমাকে দিদি বলে ডাকল না। ওর তুমিটার মধ্যে কিছু একটা ছিল। মিনি আর আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। মিনি ভুরুতে একটা ঢেউ তুলল। আমাকে চোখ মারল মিনি। যেতে যেতে বলে গেল, ‘‘লাভলি! ভাবাই যায় না!’’
খুব জম্পেশ হইচই হল সে দিন মিনির ওখানে। সবাই যখন একে একে চলে গেল, তখন দু’টো বাজে। মিনি দেখলাম কিচেন ক্লিন করতে শুরু করেছে। আমি মিনিকে হেল্প করতে গেলাম, ‘‘এই বাসনগুলো কোথা থেকে নিলি রে মিনি? চমৎকার দেখতে।’’
মিনি একটা অনলাইন শপিং সাইটের নাম বলল। ‘‘তোর ফ্ল্যাটটা দেখতে যাব এক দিন।’’
‘‘আয় না। আমি একটু একটু করে গোছাচ্ছি।’’
‘‘একটা হাউস ওয়ার্মিং করবি না? তুই যা কৃপণ!’’
‘‘কৃপণ! নিঃস্ব হয়ে ফ্ল্যাটটা দাঁড় করালাম। অর্ণবের বাড়ি থেকে আমি একটা ট্রে-ও আনিনি। ওই সংসারে আমার কেনা জিনিসপত্র কিছু কম জমেনি এত বছরে। তুই এটা ঠিক বুঝবি না। অর্ণব ওয়াজ ফেয়ার, আমাকে সব নিয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু আমার রুচিতে বাধল। আমি দু’টো ট্রলি স্যুটকেস টেনে নিয়ে লিফটে উঠে যাচ্ছি, এটাই আমার জন্য ঠিকঠাক। হাতুড়ির বাড়ি মেরে খাট খোলাচ্ছি, আমি নিজেকে এ ভাবে ভাবতে পারি না।’’
মিনি সাবানে হাত ধুতে ধুতে কড়া চোখে তাকাল আমার দিকে, ‘‘প্রথম কথা, রাহুলের এ বাড়িতে এমন কিছু ছিল না। আর দ্বিতীয় কথা হল, রাহুলকে আমি দু’বছর টেনেছি। ওর কোনও কাজ ছিল না। ফ্রিলান্স করে যা পেত সব মদে উড়িয়ে দিত। আর সিগারেট? সারাটা দিন বাড়িতে সিগারেটের ধোঁয়া। তুই জানিস এখন আমার কাশি হয়! রাহুল এ বাড়িতে অন্য মেয়ে এনেছে, জানিস? বেশ করেছে এনেছে। আমার সামনে আনলেও কিছু বলতাম না। উই ওয়্যার ডান উইথ ইচ আদার। কিন্তু আমি তো দু’বছর টেনেছি। হয়তো আরও টানতাম। আমার কিছু যাচ্ছিল আসছিল না। ও-ই চাকরি পেয়ে গেল, চলে গেল,’’ মিনি পিছনে ঘুরে গেল। মাথাটা নিচু। পিঠ কাঁপছে। মিনিকে আমি গত কুড়ি বছরে কোনও দিন ভেঙে পড়তে দেখিনি। অস্ফুটে বলল, ‘‘যে এ দিক থেকে দরজা বন্ধ করে, তার কথা কেউ কেন ভাববে না?’’
‘‘লিভ-ইন টাও একটা দাম্পত্য, তাই না?’’ বললাম আমি।
‘‘রাহুল যে দিন আমাকে ফোন করে বলল ও চলে যাবে, সে দিন আমি নিউমার্কেট থেকে ওরই জন্য পর্ক কিনে বাড়ির পথে,’’ মিনি কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘‘অর্ণবদা কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক ছিল দিদি।’’
‘‘হুম, খুব ভদ্রলোক।’’ মুখে বললাম। মনে মনে বললাম, আমি আর অর্ণব কেউই পরস্পরের চোখে ছোট হইনি কখনও। আমরা যখন একে অন্যের ঘরে হঠাৎ ঢুকে পড়তাম, মেঘের মতো জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস ঠেলে ঢুকতে হত।
বেঁচে যাওয়া খাবার ফ্রিজে ঢোকাচ্ছিল মিনি। তখন মিনির ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। মিনি মেসেজ পড়ে হাসল, ‘‘দেবাংশু তোর ফোন নম্বর চাইছে। দেব?’’
কথাটা শুনেই আমি অতিরিক্ত হেসে উঠলাম। যেন মিনির কাছে ধরা পড়ে গিয়েছি আমরা। হ্যাঁ। ‘আমরা’ই মনে হল। দেবাংশু সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় যে ভাবে তাকিয়ে গিয়েছে আমার দিকে, তার পর আমি ঝুলবারান্দায় গিয়েছি, দেবাংশু রাস্তায় নেমে সিগারেট ধরিয়েছে। টান দিয়েছে দু’তিন বার। হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে যাওয়ার আগে হাত নেড়েছে। তার পর ওর ফোনের আলোটা জ্বলে উঠতে আমি দূর থেকেও বুঝতে পেরেছি, দেবাংশু ইশারায় বলছে ফোন করবে। তখনই দ্বিতীয় বার আমার মনে হয়েছিল, তা হলে দেবাংশুর সঙ্গে মিনির কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। প্রথম বার মনে হয়েছিল যখন মিনি বলেছিল, ‘‘লাভলি!’’ ঝুলবারান্দা থেকে আমার শরীরটা অনেকটা ঝুঁকে গিয়েছিল তখন।
মিনি বলল, ‘‘পাঠিয়ে দিলাম তোর নম্বর। কবে যেন বলছিলি না, জীবনে আর নতুন করে কিছুই হওয়ার নেই? দেখ, আবার টেক্সট করেছে, ‘কই পাঠালে না?’ এত তাড়া!’’
‘‘তুই কি পাগল? দশ বছরের ছোট একটা ছেলে! ফোন নম্বর চেয়েছে মানেই প্রেমে পড়ে গিয়েছে? ইস! আমি না তোর দিদি? যা খুশি ইয়ার্কি করিস না? এ সব আবার হয় না কি?’’ আমি ছটফট করে উঠে বললাম। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলাম না। স্রোতের মতো ধেয়ে এসে কতকগুলো চিন্তা আমাকে ডুবিয়ে দিল। হঠাৎ আমি অনেক কিছু দেখে ফেললাম। দেখলাম, আমি আর দেবাংশু প্রেম করছি। মশগুল হয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছি পার্ক স্ট্রিট ধরে। আচ্ছা, ঘাড়ের কাছে একটা ট্যাটু করালে কেমন হয়? আচ্ছা আমি আর দেবাংশু তো একসঙ্গে থাকতেও পারি? দেবাংশু জাস্ট ওর পেয়িং গেস্ট অ্যাকোমোডেশন থেকে মুভ ইন করে যাবে। লিভ-ইন তো এ রকমই হয়। একসঙ্গে থাকতে শুরু করে দেয় দুম করে। কী ভাবে যেন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়। একটা যৌথ জীবন গড়ে ওঠে। কি ইজি, তাই না? আমার মনে হল, আলাদা ঘর না এক ঘর? ভাবলাম, দশ বছরের ছোট একটা ছেলে তো কি? ডু আই লুক ফর্টি? তখন মিনি যেন আমার ভিতর থেকেই বলে উঠল, ‘‘প্রেম হওয়ার হলে এ রকম ভাবেই হয়। কৃশানু যে এসেছিল, ও তো দেবাংশুরই বয়সি। ও কি তোর ওপর ইন্টারেস্ট দেখাল?’’ শুনে বোতল খুলে জল খেতে গিয়ে আমার ডিজাইনার টপটা ভিজিয়ে ফেললাম। মিনি আমার বাঁ বুকের ওপর হাত রেখে বলে উঠল, ‘‘ইস্ ধকধক করছে!’’’
তখন ভোর চারটে। আমার ফোনে পর পর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকল। লিখেছে, ‘খুব ভাল কাটল তোমার সঙ্গে সন্ধেটা। আশা করি তাড়াতাড়ি দেখা হবে।’ তার পর একের পর এক ছবি। উত্তেজিত আমি ফোনটাকে একটু নাড়ালাম, যেন তাতে ছবিগুলো দ্রুত খুলে যাবে। আমার একার ছবিগুলো না, শুধু আমার আর দেবাংশুর সেলফিগুলো দেখতে চাইলাম। মিনিও ঝুঁকে পড়ল ফোনের ওপর।
একটা ইনোসেন্ট মুখ, কোঁকড়ানো চুল, নরম চাহনির পাশে এ কার মুখ? আমি তো কাজল পরি না! তা হলে আমার চোখের কোটর দু’টো এ রকম কালো হয়ে গেল কোথা থেকে! কপালে এই চিকচিকে শিরাগুলো কিসের! আমার সমস্ত মুখের ওপর যেন একটা সেলোফেন পেপার লাগানো। ওটা কি লালসা? আমার চোখের কোণ থেকে গাল অবধি যেন একটা ফ্যাকাশে দাগ। চোখের জলের দাগ? সাইকো-থ্রিলার মুভিতে গাড়ির বন্ধ জানলায় এসে পড়া কোনও মুখের মতো একটা মুখ। আমার নিজেকে যেন প্রাগৈতিহাসিক লাগল। আমাদের মানাচ্ছে না! কেন? মাথাটা গরম হয়ে গেল আমার। মিনি বলল, ‘‘কী উত্তর দিবি? লেখ, ‘এখনও ঘুমোওনি?’ এই ভাবে কথা শুরু করতে হয়। চ্যাট কর। চ্যাট কর।’’
‘‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমাকে আর চ্যাট করতে শেখাতে হবে না! আরে আমি কি ছেলে-ধরা টাইপের নাকি, যে কথা নেই বার্তা নেই একটা হাঁটুর বয়সি ছেলে দেখে তার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ব?’’ রাগ-রাগ গলায় কথাটা বলে আমি ঝুলবারান্দায় সরে এলাম। তখন সবে আলো ফুটছে আকাশে। নিজেকে জোরে ঠেলে দিলাম আমি, দেবাংশুকে লিখলাম, ‘‘তোমার মুখের পাশে আমার মুখটা কেমন অসভ্য অসভ্য লাগছে না!’’
দেবাংশু টেক্সট করল সঙ্গে সঙ্গে, ‘‘কই অসভ্য? মুখটা এক বার দেখি?’’
চোরা হাসিতে মুখ ভরিয়ে আমি টয়লেটে ঢুকলাম একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে।