ছবি: সুমন চৌধুরী
সে দিন দূরপাল্লার এসি ফার্স্ট ক্লাস কামরায় এক জনই যাত্রী। কর্নেল অনুরাগ সরকার। যাবেন পটনা। যাত্রা নিঃসঙ্গ হলেই তিনি খুশি হন। সাধারণত গল্পগুজব, আড্ডা তিনি পছন্দ করেন, কিন্তু অচেনা অজানা গায়ে-পড়া লোকজন তাঁর মনঃপূত নয়। ট্রেনের আলাপ তিনি ট্রেনেই শেষ করে দেওয়ার পক্ষপাতী।
অনুরাগ সরকার সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন প্রায় আট বছর আগে। অকৃতদার মানুষ। তাঁর কলেজ জীবনের বান্ধবী এষার বিয়ে হয়েছিল এক অধ্যাপকের সঙ্গে। দশ-বারো বছর আগে সেই অধ্যাপকের রোড অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হওয়ার পরে অনুরাগ খোঁজখবর নিয়ে এষার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ধীরে-ধীরে এষার সঙ্গে তাঁর একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি মাঝে-মাঝে এষার ফ্ল্যাটে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যান। কখনও এষা পটনায় তাঁর বাড়িতে এসে থেকে যান কিছু দিন। ইদানীং তাঁরা একসঙ্গে বাস করার কথা চিন্তা করছেন।
ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে অনুরাগের কামরায় উঠে পড়লেন এক সাধু। খুব ব্যস্তসমস্ত মানুষ। হাতে মাঝারি সাইজের দামি ব্র্যান্ডের স্যুটকেস। পরে আছেন তো একটা গেরুয়া রঙের আলখাল্লা। তার জন্য স্যুটকেস? কত সেট আলখাল্লা লাগে? চল্লিশের কমই হবে সাধুর বয়স। ঘন কালো দীর্ঘ চুল মাথায় ঝুঁটির মতো টান-টান বাঁধা। দাড়িগোঁফের বেশ যত্ন আছে। এই রকম তেল-চুকচুকে চেহারার সাধু দেখলে অনুরাগ সরকারের হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। সাধু উলটো দিকের বার্থে বসে উজ্জ্বল চোখে সহযাত্রীকে আপাদমস্তক দেখে নিলেন।
অনুরাগ খবরের কাগজ মেলে ধরলেন মুখের সামনে। এক ঝলকেই অবশ্য অনুরাগকে দেখে মনে হল সাধুটি প্রসন্ন হয়েছেন। মধ্যবয়স্ক অনুরাগ সংসারের দায়িত্বভারে ক্লিষ্ট নন। নিখুঁত কামানো রাফ-টাফ মুখের থুতনি দৃঢ়, চোখ দুটোর মধ্যে ব্যবধান একটু বেশি। সুপুরুষ। চওড়া বলিষ্ঠ কাঁধ আর বাহু। কুস্তিগীরের মতো জোরালো কবজি, বেঁটে শক্তসমর্থ আঙুল। সাধারণ মানুষের তুলনায় তিনি অতিরিক্ত শক্তিশালী।
কর্নেল সরকার এই আগন্তুকের মতো সাধুদের একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। এঁদের জন্য তাঁর একটা বিশেষ শব্দ আছে, ‘ফাইভ স্টার’। তাঁর মতে দিব্যি আরামে থাকেন এঁরা এবং তাঁদের সম্প্রদায়ের কল্যাণে খাওয়া-পরা, চিকিৎসা ও বার্ধক্যে দেখাশোনার ব্যবস্থা হয়ে যায়, নিজে উপার্জন না করেও। তিনি খবরের কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রেখে বাইরে গেলেন সিগারেট খেতে। সাধুর দিকে তাকালেন না একবারও।
ফিরে এসে অনুরাগ দেখলেন সাধু খবরের কাগজটা পড়ছেন। সাধু গভীর দৃষ্টি ফেলে বললেন, “গত কাল দেখছি আর একটা খুন হয়েছে। পুলিশ সন্দেহ করছে একই সিরিয়াল কিলারের কাজ। মিডিয়া যার নাম দিয়েছে ‘মিস্তিরি’, সে গলায় তার পেঁচিয়ে হত্যা করে। এই নিয়ে দু’মাসে বোধহয় পাঁচ-ছ’টা মার্ডার হয়ে গেল, তাই না?”
সাধুটির চেহারা ছোটখাটো, কিন্তু কাঠামো বেশ মজবুত। নিশ্চয়ই নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন। টিভিতে একজন সাধুবাবা আসেন প্রাণায়াম শেখাতে। তিনি পেটের পেশি হাপরের মতো চালাতে পারেন। হাতে ভর দিয়ে শীর্ষাসনে হাঁটতে পারেন। এদের হাত-পা রোগা হলেও প্রচণ্ড স্ট্রং হয়।
অনুরাগ বললেন, “মোটিভলেস মার্ডার। এ সব অপরাধীদের ধরা কঠিন।”
সাধু বললেন, “সন্ন্যাস গ্রহণ করার পরে আমাকে নানা বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। কিছু মনে করবেন না, অধিকাংশ মানুষের অবচেতনের ক্রিয়া ঠিক যুক্তি দিয়ে এক কথায় ব্যাখ্যা করা যায় না।”
“জ্যোতিষী আর সন্ন্যাসীরা মনস্তত্ত্ব বিষয়টা ভাল বোঝেন, আমি শুনেছি।” বিদ্রুপের আভাস অনুরগের স্বরে।
“ঠাট্টা করছেন? কথাটা কিন্তু খাঁটি। অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় কিনা!”
“হ্যাঁ। জনসংযোগ অন্য প্রফেশনের চেয়ে বেশি।”
“প্রফেশন?” সাধু মুচকি হাসলেন, “আমাদের সম্পর্কে আপনার বেশ বিরূপ মনোভাব আছে দেখছি।”
অনুরাগ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “না না, ঠিক সকলের সম্বন্ধে নয়। যে বার উত্তরাখণ্ডে প্রবল মেঘভাঙা-বৃষ্টি নেমেছিল সে বার সন্ন্যাসীদের কাজ করতে দেখেছিলাম। আমার ইউনিট ছিল উদ্ধারের ডিউটিতে। কেদারনাথ মন্দিরের নীচে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল তখন ব্যাপক ধ্বংসস্তূপ। গ্রাম, জনপদ, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। অসংখ্য মানুষ নিহত, আহত কিংবা নিখোঁজ। আমি নিজের চোখে এক দল সন্ন্যাসীকে ওই প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে দেখেছি সেখানে। তাঁরা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা অক্লান্ত সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। তাঁবুতে হ্যাজাকের আলোয় আগতদের প্রাথমিক চিকিৎসা করেছেন, এমনকী ভাঙা হাড় সেট করতে দেখেছি। খাদ্য-পানীয়ের জোগান অব্যাহত রাখার বন্দোবস্ত করতেন তাঁরা। তাঁদের নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা, নিঃস্বার্থ সেবার সঙ্গে কেবল ইন্ডিয়ান আর্মির তুলনা করা যেতে পারে। তাঁদের আমি সমীহ করি, কিন্তু...”
“কিন্তু?” প্রশ্ন করলেন সাধু।
অনুরাগ শীতল গলায় বললেন, “আর এক টাইপ আছে ফাইভ স্টার সাধু। চকচকে বুদ্ধিমান চেহারা, গলায় ব্যারিটোন, সম্মোহনী দৃষ্টি। কেবল জ্ঞানের কথা মুখে। গৃহস্থদের তুলনায় নিজেদের কয়েক ধাপ উঁচুতে মনে করেন। অত্যন্ত সুশিক্ষিত বিদ্বান মানুষ তাঁরা।”
সাধু হেসে ফেললেন, “ভয়ঙ্কর অ্যালার্জি দেখছি আপনার। আচ্ছা, আপনি সাধুদের টাইপ জানেন, ওই সিরিয়াল কিলার ‘মিস্তিরি’ কী টাইপের মানুষ মনে হয় আপনার?”
একটু ভেবে অনুরাগ বললেন, “খুন করার মোডাস ওপারেন্ডিই ধরিয়ে দিচ্ছে তার পেশা। যে ধরনের টিনের সরু তার ভিকটিমের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মারছে, তা সাধারণত ইলেকট্রিক বা প্লাম্বার মিস্তিরিরাই ব্যবহার করে। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে মিডিয়ার দেওয়া নামটা বেশ মানানসই।”
“বেশ। আর?”
“এবং তার গায়ে অসম্ভব জোর আছে, নইলে ও রকম ভাবে সে হত্যা করতে পারত না।”
“অর্থাৎ পুরুষ?”
“নারীও হতে পারে। আজকাল অনেক মেয়ে ক্যারাটে জানে, যোগ ব্যায়াম করে, জিম করে। তাদের দেহ যথেষ্ট শক্তিশালী।”
“কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ। তা হলে আততায়ী একজন মিস্তিরি এবং তার গায়ে অসাধারণ শক্তি। আর কিছু?”
“সে হত্যা করছে অকারণে, মনের খুশিতে। তার কোনও উদ্দেশ্য নেই। আর্থিক লাভ নয়। ব্যর্থ প্রেম-টেম নয়, প্রতিশোধ নয়। সে যত্রতত্র খুন করে বেড়াচ্ছে।”
“আর একটা লক্ষণীয় ব্যাপার আছে। সে যাদের মারছে, তারা সকলে পুরুষ তো বটেই, তা ছাড়াও তাদের দেহে সাধারণের তুলনায় শক্তি বেশি। যেমন গত মাসে খুন হয়েছেন এক জন হোটেলের বাউন্সার, এক জন জাতীয় স্তরের ওয়েটলিফ্টার, এক জন সাঁতারু, আর... আর...”
“এই মাসে এক জন জিম ইনস্ট্রাক্টর, এক প্রমোটারের বডিগার্ড মাস্তান চেলা আর এক পুলিশ অফিসার। তাঁরা সকলেই ফিট, শক্তিশালী।”
“বেছে-বেছে গায়ে জোর আছে এমন লোককে মারছে। সে একটা জিনিয়াস!”
“জিনিয়াস?” অনুরাগ চোখ সরু করে সাধুর দিকে তাকালেন। সত্যিকারের সাধুর মুখে এই রকম কথা মানায় না। তাঁর মনে অশ্রদ্ধা আবার জেগে উঠল। বললেন, “একটা জঘন্য হত্যাকারীকে আপনার জিনিয়াস মনে হল? সে তো একটা নোংরা ক্রিমিনাল!”
সাধু জ্বলজ্বলে চোখে দু’হাত ঘষে বললেন, “আহা, সে তো আমজনতার দৃষ্টিতে। ভেবে দেখুন, তার মনস্তত্ত্বের দিকটা। সে খুন করছে সন্ধের পরে প্রকাশ্যে, জনবহুল এলাকায়। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের ‘ক্লু’ লোপাট। খুনি সহজেই মিশে যাচ্ছে জনারণ্যে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, সরু তার গলায় পেঁচিয়ে পিছন থেকে অতর্কিতে টেনে ধরেছে। মেরুদণ্ডে কালশিটে, অর্থাৎ হত্যাকারী হাঁটু দিয়ে চেপে গলায় টান মেরেছিল। তার আচরণ যেন একটা চ্যালেঞ্জ, না?”
গলায় বিতৃষ্ণা ঢেলে অনুরাগ বললেন, “জ্যোতিষী আর সাধুদের মতো আমি মনস্তত্ত্ব ঘাঁটাঘাটি করিনি। আমি জানি না।”
সাধু থমকে গিয়ে বললেন, “আপনার অনুমান একদম ভ্রান্ত নয়। পূর্বাশ্রমে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছিলাম। আপনার কি মনে হয় আততায়ী বিকৃতমস্তিষ্ক?”
দরজায় নক করে টিটি ঢুকলেন। টিকিটে গতানুগতিক দৃষ্টিপাত করে কাগজে টিক মেরে চলে গেলেন। এই সুযোগে অনুরাগ খবরের কাগজটা আবার মেলে ধরলেন মুখের সামনে। সাধুটির সবজান্তা হাবভাবে তিনি ক্রমশ বিরক্ত হয়ে পড়ছেন। হয়তো ধৈর্য হারিয়ে তাকে আচমকা আঘাত করে ফেলতে পারেন। লোকটা যদি পটনা পর্যন্ত চুপ করে থাকে তো বাঁচা যায়, নইলে কী হবে বলা যায় না। অনুরাগ মনটাকে শান্ত করার জন্য এষার কথা ভাবতে লাগলেন। এষা বলছিল তিন মাসের জন্য মেয়ের কাছে যাবে সিডনিতে। ওকে ছেড়ে সেই ক’মাস ভীষণ ফাঁকা লাগবে তাঁর। এষার কথা মনে পড়লেই তার কাছে গিয়ে ওর নরম শরীরটা বুকে টেনে নিতে পারবেন। ওদের গভীর একান্ত মুহূর্তগুলো ভাবলেই অনুরাগের ধমনীতে রক্তপ্রবাহের গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। খবরের কাগজের অক্ষরগুলো চোখের সামনে ভাসতে-ভাসতে সরে যাচ্ছে। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না।
হাত ভারী হয়ে একটু শিথিল হতেই কাগজের উপর দিয়ে অনুরাগের চোখাচোখি হয়ে গেল সাধুর সঙ্গে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। সাধু বললেন, “বলুন তো, আততায়ী কেবল বলবান পুরুষকে হত্যা করে কেন? কখনও আমার মতো রোগাপটকা দুর্বল মানুষকে মারে না, কিংবা কোনও মহিলাকে! কী কারণ হতে পারে? লোকটা কি লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ পুরুষদের ঘৃণা করে? মানসিক কোনও জটের কারণে সে তাদের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায়? প্রকাশ্যে এমন বেপরোয়া খুন করে কেন লোকটা?”
“আপনাকে খুব দুর্বল মনে হয় না কিন্তু। আপনার হাতের রিস্ট, লম্বা আঙুলগুলো স্টিলের তারের মতো মজবুত।”
সন্ন্যাসী কেমন যেন শূন্য চোখে নিজের দু’টো হাত চোখের সামনে তুলে দেখতে লাগলেন। অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, “পূর্বাশ্রমে পিতাঠাকুর বলতেন, তোকে দিয়ে দৈহিক পরিশ্রমের কাজ হবে না। তোর হাত নারীর মতো।”
“হত্যাকারী কেবল শক্তিশালী পুরুষদের খুন করে। কথাটা ভেবে দেখার মতো। আপনার এই থিয়োরিতে বেশ দম আছে।’’
অ্যাটেনডেন্ট এসে কম্বল-বেডশিট-বালিশ রেখে গেল। অনুরাগ বার্থ ছেড়ে উঠে জোরালো আলোটার সুইচ অফ করে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। দায়সারা ভাবে বললেন, “আপত্তি নেই তো?” সিটে বসেই অনুরাগ আলোর সুইচবোর্ড ছুঁতে পারতেন, কিন্তু মনে বিরক্তির ভার আর অস্থিরতা সামলাতে একটু নড়াচড়ার প্রয়োজন ছিল।
অনুরাগ বাথরুমে গিয়ে পোশাক ছেড়ে স্লিপিং স্যুট পরে এলেন। সাধু তখনও বিভ্রান্ত মুখে কী যেন ভাবছেন। কামরায় ফের জোরালো আলোটা জ্বলছে। নাইট ল্যাম্প সাধু নিভিয়ে দিয়েছে। অনুরাগের ভুরু কুঁচকে উঠল, এ বার তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে।
ওঁকে দেখে সাধু যেন বর্তমানে ফিরে এলেন। সঙ্গের ঝোলা থেকে হটবক্স বের করে দু’টো প্লাস্টিকের ডাব্বা রাখলেন অনুরাগের খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে।
“এটা কী হচ্ছে?” চিড়বিড়ে গলায় ঝলসে উঠলেন অনুরাগ। বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে ভদ্রলোকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে, “কাগজটা এখনও পড়া হয়নি আমার!”
সাধুর স্বরে কোনও আপশোস নেই। বললেন, “খবরের কাগজ পড়া একটা অভ্যেস মাত্র, কে আর মন দিয়ে পড়ে?” লুচি আর আলুর দম আছে। দু’জনের বেশ হয়ে যাবে।”
“ট্রেন জার্নিতে আমি কিছু খাই না।”
“জানেন, আমার মনে হয় মিডিয়া ধীরে ধীরে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে। লোকাল পলিটিক্স, রাজ্য পলিটিক্স, ন্যাশনাল পলিটিক্সের টানাপড়েনে পাঁচটা সংবাদমাধ্যম এখন এক ঘটনার পাঁচ রকমের স্টোরি ছাপে। কোনটা সত্যি, কোনটা কতটুকু রং চড়ানো, কোনটা কার দিকে ঝোল টানছে, বোঝা অসম্ভব। রিয়েলিটি এখন ব্যাপক কমার্শিয়ালাইজড...”
“লাইট জ্বলতে থাকলে আমার ঘুম আসে না। সিরিয়াল কিলার মিস্তিরির রিপোর্টিংও কি তাই?”
“মনে করুন কোনও গ্রামে সংঘর্ষে একজন যুবক খুন হয়েছে। অমনি পাঁচটা সংবাদমাধ্যম পৌঁছে যাবে সেখানে। অমুক দল বলবে, ছেলেটা তাদের কর্মী। তমুক দল বলবে, ছেলেটা তাদের পার্টির অফিসে মিটিং করে ফিরছিল। আর এক দল ফুলের মালা নিয়ে তার বাসায় হাজির। এক সাংবাদিক ছেলেটার ক্রন্দনরতা মায়ের মুখের সামনে মাইক ধরে জিজ্ঞেস করবে, ‘এই যে আপনার একমাত্র সন্তান খুন হলেন, আপনি কী বলবেন?’ অন্য এক জন ছেলেটার বৃদ্ধ বাবাকে কোণঠাসা করে জিজ্ঞেস করবে, ‘ছেলের খুনের খবর যখন শুনলেন তখন আপনি বাবুদের দিঘিতে জাল ফেলেছিলেন, শুনে প্রথমেই আপনার কী মনে হল?’ মা-বাবা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন দেখে, তার পর প্রশ্ন, ‘আপনি কি সরকারের সাহায্য আশা করছেন? আপনারা কি রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ জানাতে যাবেন?”
অনুরাগ বললেন, “লোকে এই সব পড়তে চায়, শুনতে চায়। মিডিয়াকে দোষ দিয়ে কী লাভ? অবশ্য আপনি বলতে পারেন, লোকে কী চায় মিডিয়া জানল কী করে? তারা কি জনমত নিয়েছে? হয়তো নেয়নি, কিন্তু কোন জাতীয় খবর বিক্রি হবে তারা জানে। খবরটাকে তো বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে হবে, তাই না? সেই জন্যেই তো ভোটের ক্যাম্পেন করার সময় নেতারা ব্রেকফাস্টে কী খেয়েছেন, লাঞ্চে ডাবের জল খাবেন কি না, সে সব তথ্য মানুষকে জানানো হয়। আমি ভেবে দেখলাম সিরিয়াল কিলার ‘মিস্তিরি’ সম্বন্ধে আপনার তত্ত্ব বেশ ইন্টারেস্টিং। সে খুঁজে-খুঁজে কেবল গায়ে জোর আছে এমন লোককে মারে কেন? আপনি যে কোনও টিভি চ্যানেলের বিশেষজ্ঞ প্যানেলে গিয়ে আপনার থিয়োরিটা জানাতে পারেন, রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে যাবেন।”
এত ক্ষণ ধরে একনাগাড়ে কথা বলা অনুরাগের স্বভাববিরুদ্ধ। এই লোকটার প্রতি চাপা ক্রোধ ক্রমশ তাঁর উপর প্রেশার কুকারের মতো চাপ বৃদ্ধি করেছে। নিজের অজ্ঞাতসারে তাঁর দুটো হাত অনেক ক্ষণ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে।
সাধু ধীরেসুস্থে কাগজের মোড়ক থেকে গুঁড়ো সাবান বের করে এঁটো পাত্রগুলো নিয়ে বাথরুমের দিকে গেলেন। ধুয়ে এনে গুছিয়ে রাখলেন ঝোলায়। তারপর একটা মলম বের করে দু’হাতের আঙুলে আর চেটোয় হালকা করে মাখিয়ে সিন্থেটিক রাবারের কিচেন গ্লাভস পরে নিলেন। তাঁর বোধহয় হঠাৎ খেয়াল হল, কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। বললেন, “এখনও ঠান্ডা চলছে একটানা। শীতকালে জল ঘাঁটলে আমার আঙুলগুলো ফুলে লাল হয়ে যায়, চামড়া ফেটে রস গড়ায়। ডাক্তার বলেছে, এক টাইপের বাত। তাই মলম লাগাতে হয় আর কাপড়জামায় মুছে না যায় তাই গ্লাভস। ঘণ্টাখানেক পরে থাকলেই চামড়ার ভিতরে মলম শুষে নেয়... কী যেন বলছিলেন?”
সাধুকে খোঁচা মেরে উত্তেজিত করার অদম্য ইচ্ছে হচ্ছিল অনুরাগের বললেন, “টিনের সরু তার গলায় পেঁচিয়ে খুন করছে বলেই হত্যাকারী ‘মিস্তিরি’ হবে, এই অনুমান ভুল হতে পারে। ও রকম তারের গোছা যে কোনও হার্ডওয়্যারের দোকানে কেজি দরে কিনতে পাওয়া যায়। ছাদে বা বারান্দায় তার বেঁধে ভিজে কাপড় মেলে দেওয়ার রেওয়াজ অনেক বাড়িতেই আছে। সিরিয়াল কিলার যে কোনও পেশার লোকই হতে পারে, এমনকী জ্যোতিষী বা সাধুও।”
“কিংবা সৈনিক। আপনার হাত দুটো অসাধারণ বলিষ্ঠ।” অনুরাগ সরকার থতমত খেয়ে তীব্র দৃষ্টি ফেললেন সহযাত্রীর দিকে। দু’জনেই নীরবে পরস্পরকে কঠিন চোখে দেখতে লাগলেন। কামরা নিস্তব্ধ। কেবল অন্ধকারে ট্রেনের ছুটে চলার শব্দ আর অশান্ত দুলুনি। কামরার মধ্যে শীত বাড়ছে।
সাধু বললেন, “আপনি যদি কাউকে হত্যা করার কথা চিন্তা করেন তা হলে কী ভাবে এগোবেন?”
হাতের খবরের কাগজটা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে অনুরাগ ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, “কী অদ্ভুত প্রশ্ন! আমি কখনও সে রকম চিন্তা করিনি। করবই বা কেন?”
“আপনাকে আমি রাগিয়ে দিতে চাইনি। ক্ষমা করবেন। কেবল তর্কের খাতিরে জিজ্ঞেস করছি। আপনার মতো এমন এক জন বলবান মানুষ কী ভাবে খুন করবেন?”
“আপনি মৌন থাকতে শেখেননি! এ সব ফালতু আলোচনার মানে কী?” অনুরাগ সরকার সিট থেকে লাফিয়ে উঠে কোমরে দু’হাত রেখে জ্বলন্ত চোখে তাকালেন, “ঠিক আছে, যদি জানতে চান, শুনুন। আপনাকে কী ভাবে খুন করব জানেন? খুব সোজা। প্রথমেই দু’টো জানালার পর্দা টেনে দেব এই ভাবে। তার পর করিডরে বেরোবার দরজাটা লক করে দেব, যাতে হঠাৎ কেউ ঢুকে না পড়ে। তার পর সিরিয়াল কিলারটার মতো সামনে এসে দাঁড়াব...
অনুরাগ দু’টো পেশিবহুল হাত সন্ন্যাসীর দিকে বাড়ালেন। তিনি সম্মোহিতের মতো অনুরাগকে দেখছেন, সিটের ধারে এগিয়ে বসেছেন। উত্তেজনায় টানটান। সাধু যেন স্পষ্ট অনুভব করছেন, দু’টো শক্ত হাত চেপে বসছে শিকারের গলায়। সে ছটফট করছে। চিৎকার করার চেষ্টা করছে, পারছে না। কর্নেল অনুরাগ সরকার হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে সিটে গা ছেড়ে দিলেন। বললেন, “হ্যাঁ, এ ভাবেই আমি খুন করব। বাইরে কোনও শব্দ যাবে না, কেউ জানবে না। তার পর আপনার ডেডবডি সিটে শুইয়ে দিয়ে খবরের কাগজটা খুলে আপনার মুখ ঢেকে দেব, যেন পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছেন...”
সন্ন্যাসী শান্ত গলায় বললেন, “আমি হলেও কিছুটা আপনার মতোই করতাম। জানলা-দরজা বন্ধ করে দিতাম। তার পর...” কম্বলের আড়াল থেকে চকিতে লম্বা সরু একটা তার বের করলেন, “এই দেখুন আগেই ফাঁস লাগানো আছে।”
অনুরাগ ছিটকে উঠেছেন। সাধু বলতে লাগলেন, “তার পর বিদ্যুৎ বেগে আপনার পিছনে সরে গিয়ে তারের ফাঁস গলায় পরিয়ে দিয়ে ঠিক এই ভাবে হাঁটু চেপে ধরব আপনার মেরুদণ্ডে। তার পর হ্যাঁচকা টান। তার কেটে বসছে আপনার গলায়। ফাঁস ছাড়াতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। বঁড়শিতে গাঁথা মাছের মতো ছটফট করছেন। পূর্বাশ্রমে পিতাঠাকুর আমাকে দুর্বল বলে রগড় করতেন, পরিশ্রমের কাজ আমি নাকি পারব না! কিন্তু দেখুন, আপনার মতো শক্তিশালী লোক কেমন অসহায়, তাই না?”
অনুরাগের প্রাণহীন দেহটা বার্থে শুইয়ে দিয়ে সাধু তার মুখ খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে দিলেন। স্যুটকেস থেকে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট বের করে পরে ফেললেন। পরচুলা আর গ্লাভস ভরে ভোরবেলার দিকে নেমে গেলেন ট্রেন থেকে।