ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: কমলেশ এক দিন শ্রীকণার সঙ্গে যা করেছিলেন, সৌহার্দ্য আজ তার বসের মেয়ের সঙ্গে একই জিনিস করতে চাইছে, ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন শ্রীকণা। কমলেশ ত্রিপাঠীকে বললেন নিলয়কে অন্য কোনও কাজে বাইরে পাঠিয়ে দিতে। রাতে নবনীর সঙ্গে তাঁর কথা হল বিতানকে নিয়ে।
নবনী নাক দিয়ে ফুঁয়ের আওয়াজ করে বললেন, ‘‘শিক্ষা আর বুদ্ধির দৌড় দেখতে পারছি। একটা অকর্মণ্য, অযোগ্য, বেকার ছেলেকে নিয়ে ঘুরছে। আমার বিশ্বাস, ওই বদ ছেলে আহিকে নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কেও কিছু বলেনি। ফ্যামিলিটাও খুব খারাপ। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ওর বাবা এক জন কমবয়সি মহিলাকে বিয়ে করে। সেই মহিলা...’’
কমলেশ স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘থাক, আমি জানি।’’
নবনী ভুরু কঁুচকে বললেন, ‘‘জানো! তুমি কী ভাবে জানলে?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘তুমি বলার পর আমি কিছু খোঁজখবর নিয়েছিলাম।’’
নবনী খানিকটা তেড়েফুঁড়েই বললেন, ‘‘তা হলে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছ কেন? তোমার আহ্লাদের মেয়েকে ডেকে বলো, সে যেন নিজের পায়ে কুড়ুল না মারে।’’
কমলেশ পাশ ফিরে শুতে শুতে বললেন, ‘‘নবনী, প্রেমে পড়লে মানুষের নিজের ভালমন্দ মাথায় থাকে না। এখন শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।’’
নবনী উলটো পাশ ফিরতে ফিরতে চাপা গলায় বললেন, ‘‘নিজের ভালমন্দ কী ভাবে বুঝতে হয় তুমি তো জানতে। জানতে না? এখন মেয়েকে শেখাতে পারছ না?’’
সেই পুরনো খোঁচা। কমলেশ চুপ করে রইলেন। ইচ্ছে করলেই তিনি বলতে পারতেন, বিতানকে নিয়ে আহির সঙ্গে তার কথা হয়েছে। আজ সন্ধেবেলাই হয়েছে। একটু-আধটু কথা নয়, অনেকটা কথা। নবনী তাদের উর্বরা অর্গানাইজেশনের কোনও একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিল। সেই সুযোগে কমলেশ তার মেয়েকে স্টাডিতে ডাকেন। বিষয় যতই সিরিয়াস হোক, কমলেশ ‘ক্যাজ়ুয়াল মেথড’ ব্যবহার করলেন। ম্যানেজারি কায়দা। কোনও কোনও সময় গুরুগম্ভীর আলোচনার থেকে এই পদ্ধতি বেশি কাজ দেয়।
আহিরী এসে বলে, ‘‘বাবা, খুব ব্যস্ত আমি। খাতা দেখছি।’’
কমলেশ হালকা গলায় বললেন, ‘‘বসতে হবে না। তোকে তিনটে প্রশ্ন করব, ঝটপট উত্তর দিয়ে চলে যাবি। কোনও প্রশ্ন করবি না। পরেও কখনও করবি না। কাউকে বলতেও পারবি না। দেখি তুই কত বড় স্মার্ট হয়েছিস। এগ্রি?’’
আহিরী মজা পাওয়া গলায় বলে, ‘‘এগ্রি।’’
‘‘তোর কি বিতান নামে কোনও অকর্মণ্য, হাফ বেকার ছেলের সঙ্গে রিলেশন হয়েছে?’’
আহিরী ঘাড় কাত করে বাবার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। বলল, ‘‘হয়েছে। হাফ নয়, দু-এক দিনের মধ্যে ফুল বেকার হয়ে যাবে। ছোটখাটো একটা পার্টটাইম কাজ করছে, সেটাও ছেড়ে দেবে।’’
‘‘তুই কি ওই ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছিস?’’
আহিরী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘‘অবশ্যই চাইছি। বিয়ে করে আমি ওকে পিটিয়ে মানুষ করতে চাই। তবে বিতান চায় না। ও মনে করে, ওর মতো সামান্য এক জন মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা আমার জন্য লজ্জার ও ক্ষতিকর হবে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আমি কি উদাহরণ দিতে পারি? এটা কোনও প্রশ্ন নয়।’’
কমলেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। ভিতরে ভিতরে চমকেও উঠছেন। কিন্ত ভান দেখালেন অবজ্ঞার। বললেন, ‘‘পারিস। তবে সংক্ষেপে।’’
আহিরী বলল, ‘‘রিসেন্টলি আমাদের কলেজের একটি ব্যাড টাইপ মেয়ে কলেজের গেটে আমাদের দুজনকে দেখতে পায় এবং মোবাইলে ফোটো তোলে। কোনও ভাবে বিতান সেটা দেখেছে। সেটা নিয়েও সে অপরাধবোধে ভুগছে। এতে আমার কতটা ইমেজ নষ্ট হতে পারে তাই নিয়ে ভাবছে।’’
কমলেশ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘ওই ছেলেটার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দে।’’
আহিরী অবাক হয়ে বলল, ‘‘তুমি কি বিতানকে ফোন করবে?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘নো কোয়েশ্চেন।’’
আহিরী কঠিন গলায় বলল, ‘‘আর যদি আমি না দিই?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘বেশি কিছু হবে না। এক জনের মোবাইল নম্বর জোগাড় করা বিরাট কোনও সমস্যা নয়। তবে তোর সাহস এবং আমার প্রতি বিশ্বাসের একটা পরিচয় পাব। এ বার তুমি কেটে পড়তে পারো।’’
একটু পরে আহিরী ফোন নম্বর লেখা একটা কাগজের টুকরো এসে ধরিয়ে দেয়। কমলেশ ছদ্ম গাম্ভীর্য দেখিয়ে বলেন, ‘‘আশা করি তোমার এই বন্ধুটিকে তুমি কিছু বলবে না।’’
আহিরী বলল, ‘‘আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের বহর দেখে অবাক হচ্ছি বাবা।’’
কমলেশ হেসে বললেন, ‘‘রাইটলি সার্ভড। একেই বলে মুখের মতো জবাব। কার মেয়ে দেখতে হবে তো।’’
আহিরী বলল, ‘‘আজ শিখলাম, বড় ম্যানেজারদের এটা একটা কায়দা। পেটের কথা বের করতে র্যাপিড ফায়ার করে বসে। আমি কলেজে অ্যাপ্লাই করব। এই কলেজে বেশি দিন থাকা হবে বলে মনে হচ্ছে না।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘কেন? তোদের ওই শর্মিষ্ঠা দত্ত না কে আবার জ্বালাচ্ছেন?’’
আহিরী বলল, ‘‘না। ঘেরাওয়ের ঘটনার পর থেকে আমাকে সমঝে চলে। এক জন আমার পাকিং–এর জায়গা অকুপাই করেছিল। না বলতেই সে গাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। অর্কপ্রভ সেনও এখন ‘ম্যাডাম ম্যাডাম’ করেন। নতুন বাড়ি তৈরির ব্যাপারে কী সব গোলমাল হয়েছে। শর্মিষ্ঠা দত্তকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘তা হলে কলেজ ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন?’’
আহিরী হেসে বলল, ‘‘মা আমাকে আমেরিকায় পাঠিয়েই ছাড়বে মনে হচ্ছে। পাত্রটি একটু হ্যাংলা টাইপ, হোয়াটসঅ্যাপ বেশি করে, তবে মন্দ নয়, আমার পাশে মানাবে।’’
কমলেশ একটুও দেরি না করে বললেন, ‘‘তুই যাবি আহি?’’
আহিরী ঠোঁটের কোণে হেসে বলল, ‘‘স্যর, আপনার র্যাপিড ফায়ারের পালা শেষ। এ সম্পর্কে আর কোনও প্রশ্নের জবাব আপনি পাবেন না। অফিসের জেনারেল ম্যানেজার নয়, এ বার বাবা হিসেবে মেয়ের উত্তর বুঝে নিন।’’
পিতা–কন্যার এই গভীর ও গোপন কথোপকথন কি নবনীকে বলা যায়? কখনওই নয়। সে আদিখ্যেতা ভেবে আরও রেগে যেত।
কমলেশ রায় কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন।
মুখ তুলে সামনের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালেন কমলেশ। তার পর ফাইলপত্র সরিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে উঠে পড়লেন।
১৬
বিতান মন দিয়ে খাচ্ছে। তার খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে নতুন কিছুই ঘটেনি, কমলেশ রায় নামের ভদ্রলোকটির সঙ্গে সে মাঝেমধ্যেই লাঞ্চ করে।
কমলেশ রায় একটা চিকেন স্যান্ডউইচ নিয়েছেন। স্যান্ডউইচ শেষ করে কফি নিয়ে বসেছেন। ইচ্ছে করেই বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এই মাঝারি ধরনের রেস্তরাঁটা বেছেছেন কমলেশ। বড় কোথাও গেলে বিতানের অস্বস্তি হতে পারত।
বিতান রেস্তরাঁর দরজায় দঁাড়িয়ে ছিল। কমলেশকে দেখে এগিয়ে আসে।
‘‘আহিরীর মোবাইলে আপনাদের ছবি দেখেছি।’’
কমলেশ হেসে বলেন, ‘‘আমি কিন্তু ছবি না দেখেই তোমাকে চিনতে পেরেছি। দাড়ির কথাটা তো জানতাম। তা ছাড়া এই মুহূ্র্তে এখানে হ্যান্ডসাম ইয়ং ম্যান তো এক জনই রয়েছে।’’
বিতান বলে, ‘‘থ্যাঙ্ক ইউ।’’
বিতানকে আজ সত্যি সুন্দর লাগছে। জিনসের ওপর নীল রঙের হাফ-স্লিভ একটা শার্ট পরেছে। এলোমেলো চুলে লম্বা–চওড়া চেহারার তরুণটিকে সুপুরুষ লাগছে। কমলেশ মনে মনে মেয়ের তারিফ করলেন। ভিতরে যাই থাক, বাইরে থেকে মেয়েদের প্রেমে পড়বার মতোই। ছেলেটি খুব স্মার্টও। প্রেমিকার বাবার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে এত স্বচ্ছন্দ থাকা সহজ নয়। অন্তত গড়পড়তা বাঙালি ছেলের পক্ষে তো নয়ই। আজ সকালে ফোন করেই ছেলেটি সম্পর্কে একটা ভাল ধারণা তৈরি হয়েছিল কমলেশের। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘‘আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই বিতান। কথাটা জরুরি। এখনই বলা দরকার।’’
বিতান একটুও না চমকে বলে, ‘‘বলুন।’’
কমলেশ বলেন, ‘‘এ ভাবে হবে না। কথা বেশি নয়, কিন্তু মুখোমুখি বসা দরকার।’’
বিতান ঠান্ডা গলায় বলে, ‘‘আচ্ছা বসব। আপনি বলুন কোথায় যেতে হবে।’’
কমলেশ একটু ভেবে নিয়ে বলেন, ‘‘আজ দুপুরে তুমি কী ভাবে প্লেসড?’’
‘‘চারটে পর্যন্ত কিছু নেই।’’
বিতানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, ‘‘ফাইন, তুমি আমার সঙ্গে আজ লাঞ্চ করো।’’
বিতান অস্ফুটে বলে উঠেছিল, ‘‘লাঞ্চ!’’
‘‘এনি প্রবলেম?’’
বিতান একটু ভেবে বলল, ‘‘না, ঠিক আছে। কোথায় যাব?’’
সময় আর রেস্তরাঁর ঠিকানা বলে কমলেশ একটু হালকা ঢঙে বললেন, ‘‘আমি চাই আমাদের এই সাক্ষাতের ঘটনাটা শুধু আমি আর তুমি জানব।’’
বিতান বলল, ‘‘অবশ্যই।’’
কালই ছেলেটিকে খানিকটা বুঝতে পেরেছিলেন কমলেশ, আজ আরও ভাল করে বুঝছেন। এই ছেলের নিজেকে নিয়ে কোনও রকম কুণ্ঠা নেই। খাওয়ার মাঝখানেই বিতান কথা বলতে চেয়েছিল। কমলেশ হাত তুলে বলেছিলেন, ‘‘আগে ধীরেসুস্থে খাও, তার পর।’’
বিতান খাওয়া শেষ করে কফির বদলে আইসক্রিম নিল।
‘‘এ বার বলতে পারেন।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘কথা শুরুর আগে আমি কি তোমার ফ্যামিলির বিষয়ে কিছু জানতে পারি? তোমার ব্যাপারে কেবল ওইখানেই আমার একটা ইনফর্মেশন গ্যাপ আছে।’’
বিতান একটু চুপ করে থাকে। তার পর অল্প কথায় মায়ের মৃত্যু, বাবার আবার বিয়ে, তাকে বাড়ি থেকে কার্যত তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে।
‘‘ওই মহিলা এখন অসুস্থ বাবাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে চাইছেন। বাবাও আর থাকতে চান না। আজও আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করলেন। অথচ এক সময় ওই মহিলা আর তাঁর মেয়ের জন্য কী না করেছে মানুষটা।’’
বিতান মুখ নামাল। কমলেশ নরম গলায় বললেন, ‘‘স্যরি, আমি জানতাম না। ভালবাসা যে শেষ পর্যন্ত কী চেহারা নেয় কে বলতে পারে?’’
বিতান মুখ তুলে বলল, ‘‘আমার ক্ষতি হল। এই গোলমালে লেখাপড়াটাও ঠিকমতো হল না। জীবনের উৎসাহটাই হারিয়ে ফেললাম। যাক, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবাকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসব। যে ক’টা দিন বঁাচবেন, আমিই দেখব।’’ বিতান থেমে একটু হেসে বলল, ‘‘যদিও আমার নিজেরই থাকার জায়গা নেই। তা হোক, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’
কমলেশ থমকালেন। বিভূতির দেওয়া রিপোর্টে ছেলেটার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কাল আহির কাছে শুনে সেই ধারণা বদলেছে। বুঝতে পেরেছেন, আহি এমন কোনও ছেলেকে ভালবাসতে পারে না, যার কিছু নেই। ঘরবাড়ি, চাকরি না থাকলেও কিছু তো আছে। কমলেশ এখন বুঝতে পারছেন, ছেলেটির মনের জোর আছে। মুমূর্ষু বাবার বিষয়ে যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে আহির ব্যাপারে নেবে না কেন? এই জোর ভাঙতে কতটা আঘাত দরকার? নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করলেন কমলেশ। এটা একটা মনের লড়াই হবে। অর্ধেকেরও কম বয়সি যুবকের সঙ্গে মনের লড়াই। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভেবে তিনি বুঝেছেন, বাবা হিসেবে এটাই তাঁর কর্তব্য।
ক্রমশ