ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: আহিরী বিতানের বানানো পাস্তা খেতে খেতে গল্প করতে লাগল। বিতান বলল, আহিরীর তাকে ভুলে যাওয়াই উচিত, সে জীবনে কিছুই করতে পারেনি। শ্রীকণা সকাল থেকেই একটা শারীরিক অস্বস্তি বোধ করছেন, সেই নিয়েই সৌহার্দ্যর ব্রেকফাস্ট তৈরিতে মন দিলেন।
ছেলের ব্রেকফাস্ট করতে করতে শ্রীকণা বুঝতে পারলেন, মাথাটা ভারী লাগছে। বয়স হয়েছে, শরীর তো মাঝে মাঝে বিগড়োবেই। ছেলেটা না বুঝতে পারলেই হল। শ্রীকণা চা বসালেন। কিছু ক্ষণের মধ্যে টোস্ট, ডিমসেদ্ধ, আপেল এনে টেবিলে রাখলেন।
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘তুমি খাবে না?’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘আমি এখন খাই? আমাকে কি অফিস ছুটতে হবে? বল কী বলবি।’’
সৌহার্দ্য টোস্ট তুলে কামড় দিয়ে সহজ ভাবে বলল, ‘‘মা, মনে হচ্ছে কলকাতার পালা শেষ। মনে হচ্ছে কেন, শেষই ধরে নাও। যাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চলছে তারা আমার ডিমান্ড প্রায় সব ক’টাই মেনেছে। দু–একটা খুচরোখাচরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সেগুলো ফাইনাল হলেই আমাকে জানিয়ে দেবে। সেই মেল দেখতেই এই সাতসকালে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসেছি।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘দিল্লি না মুম্বই?’’
সৌহার্দ্য চামচে ডিমসেদ্ধ কাটতে কাটতে বলল, ‘‘আর একটু দূরে। ইংল্যান্ড। লন্ডনে অফিস, ওয়ার্কশপ আউটস্কার্টে। সব জায়গাতেই যাতায়াত করতে হবে।’’
শ্রীকণার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘‘বাঃ খুব ভাল। মুখটা বাড়া, একটু আদর করে দিই।’’
সৌহার্দ্য মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘‘আদর পুরোটা কোরো না। একটু ধরে রেখো। অফার লেটারটা ওরা পাঠাক, তার পর বাকিটা করবে।’’
সৌহার্দ্য মায়ের দিকে মাথাটা ঝঁুকিয়ে দিল। শ্রীকণা হাত বাড়িয়ে ছেলের থুতনি ছুঁলেন। তাঁর চোখের কোল ভিজে উঠল। কপালে চন্দনের টিপ নিয়ে ছেলের প্রথম দিন ছায়াপাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার ছবিটা চোখে ভেসে উঠল।
সৌহার্দ্য টোস্টে জ্যাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘‘ছেলের বিলেত যাত্রার খবরে তুমি কিঞ্চিৎ ইমোশনাল হয়ে পড়লে। আমি তোমার আবেগকে সম্মান দিয়েই বলছি, আজকাল চাকরি করতে দেশের বাইরে যাওয়াটা কমন প্র্যাকটিস। কোম্পানি একটু বড় হলেই পাঠিয়ে দেয়। কখনও দু–তিন বছরের অ্যাসাইনমেন্টে, কখনও পাকাপাকি।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘তোর বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন।’’
সৌহার্দ্য কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘‘শিয়োর। অফার লেটারের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স দেখলে আরও খুশি হতেন।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘আজ আর গাল দিস না। আজ একটা শুভ দিন।’’
সৌহার্দ্য চোখ বুঁজে পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, ‘‘বাবাকে আমি তো কখনওই গাল দিই না। উনি যা করেছেন, আমার ভালর জন্যই করেছেন। সেই ভাল আমার হচ্ছেও। প্রফেশনে একটার পর একটা বেটার অফার পাচ্ছি। সেইমতো জাম্পও দিচ্ছি। কিন্তু মা, আমি যে আমার অন্য রকম ভাল চেয়েছিলাম। এই বিদেশ যাওয়াটা যদি আমার অ্যাকাডেমিক কারণে হত আমি খুশি হতাম বেশি।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘যা হয়নি তা নিয়ে এত অনুশোচনা ঠিক নয়।’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘আমি কি অনুশোচনা করি? তোমাকে মাঝে মাঝে বলি এই যা। আমি তো আমার কেরিয়ারকে আমার পিঠে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছি। শুধু অফিস নয়, আমার জীবনযাপনও সে রকম। পার্টি করি, গার্লফ্রেন্ড মেনটেন করি, অফিসে কী ভাবে ম্যানেজমেন্টের নজরে থাকা যায় তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’’
শ্রীকণা কপালের দু’পাশে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করছেন। তিনি চোখমুখ স্বাভাবিক রাখলেন।
‘‘ঠিক আছে হয়েছে। তুমি কী করো তার অত ফিরিস্তি আমাকে দিতে হবে না। যাওয়া কবে?’’
সৌহার্দ্য চা খেতে খেতে বলল, ‘‘বললাম যে। আগে সবটা ফাইনাল হোক। তবে এই অফিসকে আজই হয়তো মেল করে দেব। তোমাকে বলার দুটো কারণ আছে। এক, বিদেশ যাওয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। তুমি সেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করো। আমি আগে গিয়ে জয়েন করব। তার পর তোমার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য দেশ। ইচ্ছে করলেই তো কাউকে নিয়ে গিয়ে পাকাপাকি রেখে দেওয়া যায় না। ভিসার অনেক নিয়মকানুন আছে।’’
শ্রীকণা নিচু গলায় বললেন, ‘‘আমি আর কোথাও যাব না সোহো। আমাকে আর টানিস না। আমার ক্লান্ত লাগছে। আমি এখানেই থাকব। মাঝে মাঝে নাহয় তোর কাছে ঘুরে আসব।’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘এখানে একা তুমি কী করে থাকবে!’’
শ্রীকণা হেসে বললেন, ‘‘একা কোথায়? কত লোক আছে। তা ছাড়া আমাদের উর্বরা আছে না? ওদের সঙ্গে আরও জড়িয়ে যাব। ওখানে কত কাজ!’’
কলকাতা আসার পর থেকেই ‘উর্বরা’ সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত শ্রীকণা। মেয়েদের হাতের কাজ শেখান। ছায়াপাতায় থাকবার সময় সেলাই করতেন। সেই বিদ্যে কাজে লাগছে। ওখানে কত মেয়েদের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের যে কত যন্ত্রণা, কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে তার ঠিক নেই। ঘুরে দঁাড়ানোর জন্য আবার নতুন করে লড়াই করছে। এখানে কাজ খুব ভাল লাগে শ্রীকণার। এই রকম জায়গায় গেলে বোঝা যায়, কলকাতা শহর শুধু ব্যস্ত, স্বার্থপর নয়, শহরটার খুব বড় একটা মন আছে। মায়ের এই কাজে সৌহার্দ্যেরও সমর্থন রয়েছে। ফাংশন, এগজ়িবিশন হলে ডোনেশন জোগাড় করে দেয়।
সৌহার্দ্য একটু চিন্তিত হয়ে বলল, ‘‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘আর কিছু দেখার নেই। এটাই ফাইনাল। তুই চলে গেলে সব সময়ের জন্য এক জন লোক রেখে আমি এখানেই থেকে যাব। এখন তো সব সময় যোগাযোগ করা যায়।’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘তোমাকে ভিডিয়ো কল, স্কাইপ— সব শিখিয়ে দেব।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘তা হলে কিসের চিন্তা?’’
সৌহার্দ্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘‘মা, এ বার আমি তোমাকে দু’নম্বর কথাটা বলব। মন দিয়ে শুনবে।’’
শ্রীকণা নড়েচড়ে বসলেন। ছেলের এই ভঙ্গি তিনি চেনেন। ছেলে সত্যি সিরিয়াস কথা বলতে চায়। সৌহার্দ্য একটু ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করল। সম্ভবত মনে মনে গুছিয়ে নিল।
‘‘মেয়েটির নাম আহিরী রায়। মোটের ওপর সুন্দরী, লেখাপড়া করেছে। কলেজের টিচার। স্মার্ট, আধুনিক, সাহসী মনের মেয়ে। নিজে গাড়ি চালিয়ে কলেজে যায়। ক্যান্টিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আড্ডা মারে। প্রিন্সিপাল না টিচার-ইন-চার্জ ঘেরাও হলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করে ঘেরাও তোলার ব্যবস্থা করে। পরিবারটিও শিক্ষিত। বাবা বড় কোম্পানির উঁচু পদে আছেন। মেয়েটি এখনও বিয়ে করেনি।’’
এতটা বলে সৌহার্দ্য থামল। শ্রীকণা ভুরু কঁুচকে বললেন, ‘‘ব্যাপার কী? একটা অবিবাহিত মেয়ে সম্পর্কে এত খোঁজখবর নিয়েছিস যে বড়?’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘আমি নিইনি। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ব্যাচমেট অর্জক নিয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাট চুকিয়ে ফিজিক্স পড়তে চলে গিয়েছিল। তার পর কম্পিউটার সায়েন্স। অর্জক এখন আমেরিকায়। এই মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল, আর এগোয়নি। কিছু দিন আগে তার সঙ্গে হঠাৎই ফেসবুকে যোগাযোগ হল। তার পর হোয়াটসঅ্যাপ-এ কথা বলি। চাপা স্বভাবের ছেলে। অনেক দিন পরে যোগাযোগ হলে বন্ধুদের যেমন বিয়ে-থা, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে প্রশ্ন করতে হয়, আমিও করলাম। দেখলাম, বাঙালি মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে অভিমান। চেপে ধরতে আহিরী রায়ের কথা বলল। কলকাতায় এসে মেয়েটির সঙ্গে দেখাও করেছে। প্রোপোজ়ও করে গেছে। কিন্তু সাড়া পায়নি। আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন মেয়েটির আরও পরিচয় জানতে পারলাম, চমকে যাই।’’
সৌহার্দ্য থামল। শ্রীকণা শরীরে আবার অস্বস্তি বোধ করছেন। বঁা কঁাধের কাছটায় একটা ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা লুকিয়ে তিনি বললেন, ‘‘কী পরিচয়?’’
সৌহার্দ্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শ্রীকণার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘শি ইজ় দ্য ডটার অব মাই বস।’’
‘‘তাই!’ শ্রীকণার গলাতেও বিস্ময়। বললেন, ‘‘এ তো একেবারে গল্পের মতো!’’
সৌহার্দ্য হাত বাড়িয়ে মায়ের হাত ধরে চোখের পাতা না ফেলে দঁাতে দঁাত চেপে বলল, ‘‘মা, গল্পটা আর একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’
শ্রীকণা অবাক হয়ে বললেন, ‘‘মানে!’’
সৌহার্দ্যর চোখ ঝকঝক করছে। সে আরও নিচু গলায় বলল, ‘‘ইউ উইল টক টু দিস ফ্যামিলি। আমি অপেক্ষা করছিলাম, এখন আমার আর কোনও বাধা নেই। আহিরী রায়ের বাবার কোম্পানি আমি ছেড়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে সব কনট্যাক্ট নম্বর দিয়ে দেব। ইফ আই অ্যাম নট রং, তুমি মেয়েটির মাকে চিনতেও পারো। ওঁর নাম বনানী রায়। উনিও তোমাদের ওই উর্বরা সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত। আমি অফিস থেকে শুনেছি, বছরে এক বার করে ডোনেশন যায়।’’
শ্রীকণা সাগ্রহে বললেন, ‘‘কী নাম বললি?’’
‘‘বনানী রায়।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘মনে হচ্ছে চিনি।’’
মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে সৌহার্দ্য বলল, ‘‘তুমি ওঁর সঙ্গে কথা বলো।’’
শ্রীকণা শরীরের অস্বস্তি ভুলে হেসে বললেন, ‘‘পাগলের মতো এ সব কী বলছিস সোহো! তোর বন্ধুর হয়ে আমি কী বলব? আমি কে? তার বাড়ির লোককে বুঝতে দে। তারা বলুক।’’
সৌহার্দ্য এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘‘বন্ধুর জন্য নয়, তুমি আমার জন্য বলো।’’
শ্রীকণা থমকে গেলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘‘তুই কি আবার আমার সঙ্গে ঠাট্টা শুরু করছিস সোহো?’’
সৌহার্দ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। পায়চারি করতে করতে অনেকটা নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘‘আহিরী রায়ের পাত্র হিসেবে আমি তো কিছু কম যোগ্য নই। তার বাবার কোম্পানিতে ইতিমধ্যেই আমি আমার ক্রেডিবিলিটি প্রমাণ করেছি। নিজের অ্যাসাইমেন্ট তো করেইছি, যা আমার কাজের মধ্যে পড়ে না, তাও করেছি। কোম্পানির ভিতর একটা বড় সাবোটাজ় হচ্ছিল। কম্পিউটার সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমি নোটিস করায় ওরা অ্যালার্ট হয়েছে। না করালে বড় ক্ষতি হয়ে যেত। দে আর ভেরি হ্যাপি।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘তুই সত্যি ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?’’
সৌহার্দ্য শ্রীকণার চেয়ার ধরে, চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘‘না মা, বিয়ে করতে চাই না। বিয়ের সব ফাইনাল করে বিদেশ চলে যেতে চাই।’’
শ্রীকণা চমকে উঠলেন। ছেলে এ সব কী বলছে! এ তো অমানুষের মতো কথা! এ সব ভাবনা ওর মাথায় এল কী করে! শ্রীকণা বুঝতে পারছেন, তার কান, মাথা গরম হয়ে আসছে। শরীর ভারী লাগছে।
‘‘কী পাগলের মতো বকছিস সোহো? বিয়ে করব বলে পালিয়ে যাবি!’’
সৌহার্দ্য বাঁকা হেসে বলল, ‘‘ইয়েস। প্লিজ় আর কিছু জানতে চেয়ো না। পালিয়ে যাওয়ার কথাটা আমি তোমার কাছে লুকোতে পারতাম। লুকোইনি। যাতে তুমি আমাকে পরে ভুল না বোঝো।’’
শ্রীকণা ধমক দিলেন, ‘‘আমি কক্ষনও এ কাজ করব না। তুই এ রকম বিশ্রী একটা কথা আমাকে বললি কী করে? তুই এত নিচুতে নেমেছিস!’’
সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল, ‘‘আমি জানতাম তুমি এ রকম একটা কিছু বলবে। তোমার মতো নরম মনের মানুষের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। ঠিক আছে, আমি কিন্তু একটা সুযোগ...’’ একটু থেমে সৌহার্দ্য বলল, ‘‘আমি সব বলে দিলে তুমি হয়তো আমার ওপর এ ভাবে রাগ করতে না।’’
ক্রমশ