ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
তোমার ফ্ল্যাটের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। পারমিশন ছাড়া ভিআইপির ফ্ল্যাটে যেতে অ্যালাও করছে না। আটকে দিয়েছে। এসে উদ্ধার করো।’’
বিতান চিৎকার করে বলল, ‘‘তুমি... তুমি এসেছ আহিরী? এক মিনিট দাঁড়াও আমি আটতলা থেকে লাফ দিচ্ছি।’’
আহিরী প্রতিজ্ঞা করেছে, বিতানের ফ্ল্যাটে সে কিছুতেই এমন আচরণ করবে না যাতে বিতানের মন খারাপ হয়ে যায়। তাকে যেন একজন খিটখিটে মাস্টারনি মনে না হয়, যার একটাই কাজ, সবাইকে নিজের ছাত্রছাত্রী ভেবে জ্ঞান দেওয়া। সত্যি তার ভাবনাচিন্তা কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে এত ভাবার কী হয়েছে? মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে বলে? না কি বিতান ফাইনাল কিছু বলছে না তাই? যা খুশি হোক। এখন এ সব গোল্লায় যাক। আজ শুধু একটাই কাজ, বিতানের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করা। বড্ড বকাবকি করা হয়ে গেছে। ছেলেটা এমনিতেই চাপে থাকে, তার উপর সেও যদি চাপ দেয়, বেচারি যায় কোথায়?
এক মিনিট না হোক, বিতান খুব তাড়াতাড়ি এসে হাজির হল। তখনও তার চোখ ছানাবড়া হয়ে আছে। গাড়ি পার্ক করিয়ে, লিফটে করে নিজের ফ্ল্যাটে এসেও বিতানের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, আহিরী এসেছে।
আরাম করে বসার জন্য আহিরী সোফার বদলে ডিভানটাই বাছল।
‘‘হাঁ করে দেখছো কী? যাও কী সব রান্না করবে করো। আমার তো হেভি খিদে পেয়েছে। সেই জন্যই তো গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম।’’
বিতান থতমত গলায় বলল, ‘‘আমার মাইরি বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি এটা তুমি তো!’’
আহিরী বলল, ‘‘তোমাকে মাইরি বিশ্বাস করতে হবে না। তুমি খাবারের ব্যবস্থা করো।’’
বিতান চোখ বড় করে বলল, ‘‘এ কী! আহিরী তুমিও স্ল্যাং ইউজ় করছ!’’
আহিরী ডিভানে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল, ‘‘আরও জানি। শুনবে? ভাবো কী? আমি স্টুডেন্ট ক্যান্টিনে আড্ডা মারা প্রফেসর। চাইলে তোমাকেও ঝক্কাস কয়েকটা শিখিয়ে দিতে পারি। আচ্ছা বলো তো...’’
বিতান ঘাবড়ে যাওয়ার অভিনয় করে বলল, ‘‘ওরে বাবা, থাক থাক। বলতে হবে না। অত সহ্য হবে না।’’
আহিরী হাসতে হাসতে বলল, ‘‘ছেড়ে দিলাম।’’
বিতান ভুরু কুঁচকে খানিকটা ঝঁুকে পড়ে বলল, ‘‘কী ব্যাপার বলো তো আহিরী, এইটুকু সময়ের মধ্যে এতটা বদলে গেলে! এত ক্ষণ ধমকধামকের ওপর ছিলে, পারলে কান ধরে ওঠবস করিয়ে ফেলো, এখন কমপ্লিটলি চেঞ্জড!’’
আহিরী একটা উদাসীন ভাব দেখিয়ে বলল, ‘‘তাতে কী হয়েছে? বদলের জন্য কি অনেক বেশি সময় লাগে? কুঁড়ি থেকে ফুল হতে কত ক্ষণ লাগে? মোমেন্টস? দুম করে কোন মুহূর্তে ফুটে যায়। গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কত সময় ধরে? বাইরে দঁাড়িয়ে দেখলেন জ্যোৎস্নায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। ব্যস, মনে হল, সংসার অসার। তিনি বেরিয়ে পড়লেন। তার পর ধরো... গাছ থেকে আপেল পড়তেই নিউটন ‘ইউরেকা’ বলে লাফ দিয়েছিলেন। কত সময় লেগেছিল?’’
বিতান চোখ গোল গোল করে বলল, ‘‘বাপ রে, তুমি তো দেখছি নাটকের ডায়লগও দিচ্ছ!’’
মিউজিক সিস্টেমে নিচু গলায় গান বাজছে—‘সাচ আ ফিলিং কামিং ওভার মি/ দেয়ার ইজ় ওয়ান্ডার ইন মোস্ট এভরিথিং আই সি/ নট আ ক্লাউড ইন দ্য স্কাই, গট দ্য সান ইন মাই আইজ়/ অ্যান্ড আই ওন্ট বি সারপ্রাইজ়ড ইফ ইট্স আ ড্রিম।’
সত্যি খানিকটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আহিরীর। খুব ভাল লাগছে। ভাগ্যিস এসেছে! নইলে আজকের গোটা দিনটাই তেতো হয়ে থাকত। বিতানের ওপর শুধু রাগই হত। মনে হত, ছেলেটা স্বার্থপর। তার কথা একটুও ভাবছে না। রাগ হত নিজের ওপরেও। ছেলেটাকে শুধু বকঝকাই করে। তার সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে না। বিয়ে করবে বলে তো বিতান তার সঙ্গে মিশতে শুরু করেনি। সেও করেনি। টাকা ফেরত দেওয়ার ছুতো করে কলেজে প্রথম যে দিন এসেছিল বিতান, সেই রাতেই তাকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল আহিরী।
‘‘সে দিন পাখির ছবি কী তুলেছিলেন? দেখাবেন না?’’
একটু পরে বিতান লিখে পাঠাল, ‘‘দেখানোর কোনও চান্স নেই, পাখি সব উড়ে গেছে।’’
আহিরী লিখল, ‘‘মানে!’’
‘‘ছবি পছন্দ হয়নি। ক্যামেরা থেকে মুছে দিয়েছি।’’
‘‘অন্যায় করেছেন। কিছু ছবি নিশ্চয়ই ভাল হয়েছিল।’’
‘‘না হয়নি। পাখিদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওরা বলেছে, এর পর ওদের কাছে মোবাইল দিয়ে দিলেই হবে। ওরা সেলফি তুলে পাঠিয়ে দেবে। সে ছবি ঢের ভাল হবে। তখন আপনাকে দেখাব।’’
আহিরী মুচকি হেসে লিখল, ‘‘অবশ্যই দেখাবেন। মানুষের সেলফি দেখে দেখে ক্লান্ত। এ বার পাখিদের সেলফি দেখতে চাই। শুধু বলে দেবেন, ওরা যেন আকাশে ওড়ার সময় ফোটো তোলে।’’
এর কিছু ক্ষণ বাদে বিতান একটা ফোটো পাঠিয়েছিল। বকের মতো একটা সাদা পাখি ঝিলের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। মুখ আর ঠোঁটটা লাল। ঘাড় এক পাশে কাত করে দার্শনিক একটা ভাব নিয়ে বসে আছে। খানিকটা উদাসীনও।
ছবির তলায় বিতান লিখেছিল, ‘‘এটা আমার সেলফি। এই মাইগ্রেটরি বার্ডটি বরফের দেশ সাইবেরিয়া থেকে এসেছে। আবার ফিরে যাবে।’’
খুব মজা পেয়েছিল আহিরী। এক জন বুদ্ধিমান রসিক মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। যে মানুষটার কোনও ভান নেই। এই ভাললাগাটাই ধীরে ধীরে ‘ভালবাসা’ হয়ে গিয়েছে।
বিতান একটা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল।
‘‘বোর হচ্ছ না তো? আর একটু ওয়েট করো। তার পরই গরম গরম সার্ভ করব।’’
আহিরী বলল, ‘‘দেখো, এমন গরম খাবার দিয়ো না যাতে তোমার মুখ পোড়ে। তার আগে অনুগ্রহ করে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দাও। অনেক ক্ষণ থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। হাতমুখ না ধুয়ে আর পারছি না। নতুন সাবান আছে?’’
বিতান শশব্যস্ত হয়ে বলল, ‘‘ওহো স্যরি। আমার আগেই দেখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। নো চিন্তা, একেবারে প্যাকেট ছিঁড়ে সাবান দিচ্ছি।’’
আহিরী উঠে পড়ে বলল, ‘‘ঘরদোর এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখ কী করে?’’
বিতান হাত উল্টে বলল, ‘‘আমাকে কিছু করতে হয় না। লোকজন আছে। অনুভব দূর থেকে কন্ট্রোল করে। তবে আমার আর ভাল লাগছে না। এখান থেকে চলে যাব ঠিক করেছি। অনুভবকেও বলেছি।’’
ড্রয়িংরুম লাগোয়া ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাল বিতান। ভিতরে পা রেখে একটু থমকাল আহিরী। এই ঘরটা অগোছালো। বিছানা এলোমেলো। এক পাশে জামাকাপড় ডঁাই করে ফেলে রাখা। বেডসাইড টেবিলে বইপত্র, ছাই-ভর্তি অ্যাশট্রে। একটা ব্যাচেলর-ব্যাচেলর ভাব। ঘরের গন্ধটাও কেমন যেন পুরুষমানুষের শরীরের গন্ধের মতো। সিগারেট, ঘাম, আফটারশেভ লোশন মিশলে যেমন হয়। এই অগোছালো ঘরটা বেশি পছন্দ হল আহিরীর। বিতানের চরিত্রের সঙ্গে যায়। মাপে ছোট এই যা। তা হোক।
বিতান তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে খাটের জামাকাপড় সরাতে গেল। লজ্জা পাওয়ার হাসি হেসে বলল, ‘‘এই সবই কাচা হয়েছে। ভাঁজ করে রাখতে পারেনি।’’
আহিরী হাত তুলে বলল, ‘‘থাক। ভাল লাগছে। যাই বলো এই ঘরটা আমার বেশি পছন্দ।’’
বিতান বলল, ‘‘মাস্টার বেডরুমটা খুব টিপটপ করে সাজানো। ওটা তালা মেরে রেখেছি। অনুভবকে বলে দিয়েছি, ওই ঘরে শুলে আমার ঘুম হবে না। আমি গেস্ট রুমেই থাকব। তুই যদি চাপাচাপি করিস পালাব। ও আর কিছু বলেনি। তবে আমি এমনিই এ বাড়ি ছেড়ে দেব।’’
আহিরী কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। এখন এ সব কথা ভাল লাগছে না। তার ভিতরটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। সে বলল, ‘‘সে যখন ছাড়বে দেখা যাবে। এখন তো ছাড়ছ না। এ বার ঘর থেকে ভাগো দেখি। ওইটা ওয়াশরুম তো? ফ্রেশ টাওয়েল আছে?’’
বিতান হকচকিয়ে বলল, ‘‘টাওয়েল! টাওয়েল দিয়ে কী হবে?’’
আহিরী ফিক করে হেসে বলল, ‘‘তোমার মুখে চাপা দিয়ে খুন করব।’’ তার পর চোখ বড় করে শাসানির ভঙ্গিতে বলল, ‘‘টাওয়াল দিতে বলেছি দাও। হাতমুখ মুছব কী দিয়ে? শাড়ির আঁচল দিয়ে?’’
বিতান বিছানায় রাখা কাপড়চোপড়ের স্তূপ ঘেঁটে সত্যি একটা কাচা তোয়ালে বার করে ফেলল। আলমারির তাক থেকে একটা নতুন সাবানও দিল।
‘‘বাহ্, তুমি তো দেখছি বেশ সংসারী! গুডবয়।’’
বিতান বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরের দরজায় লক লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল আহিরী। ছোট বাথরুম কিন্তু পরিচ্ছন্ন। বেসিনের কল খুলে হাত পেতে দিল। আহ্, কী আরাম! এক মুহূর্ত ভাবল আহিরী, তার পর দ্রুতহাতে শাড়ি-জামা খুলে বাথরুমের আধখোলা দরজা দিয়ে ছুড়ে দিল ঘরের খাটে।
নগ্ন হয়ে শাওয়ারের তলায় মাথা বঁাচিয়ে দঁাড়াল আহিরী। চুল যেন না ভেজে। আহ্, কী শান্তি! সারা দিনের ক্লান্তি, বিরক্তি, অভিমান ধু্্য়ে যেতে লাগল জলের ধারায়। আহিরী গুনগুন করে গাইতে লাগল, ‘অ্যান্ড দি ওনলি এক্সপ্ল্যানেশন আই ক্যান ফাইন্ড... ইয়োর লাভ পুট মি অ্যাট দ্য টপ অব দ্য ওয়র্ল্ড...’
শাওয়ার বন্ধ করে গা মুছতে মুছতে আহিরী নিজের মনেই অবাক হল। সত্যি সে বদলে গেল না কি? এই প্রথম সে বিতানের সঙ্গে কোনও বাড়িতে একা আছে, অথচ মনে হচ্ছে, এই বাড়িতে সে আর বিতান বহু কাল ধরে থাকে। একসঙ্গে খায়, গল্প করে। ভালবাসে, ঝগড়া করে। ইমোশনকে সে চিরকাল নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। আবেগ কেউ যেন দেখে না ফেলে। বুদ্ধিমতী মেয়ে হওয়ার এটাই সমস্যা। প্রেম করার জন্য কত পুরুষ যে হঁাকপাক করেছে তার ঠিক নেই। এখনও করে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে রোজই কেউ না কেউ প্রেম নিবেদন করছে। বিবাহিত, অবিবাহিত দুই–ই আছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা ‘প্রেম– প্রেম’ বলে কান্নাকাটি করে, আসলে সেক্স চায়। ফঁাদে ফেলে যদি দেখা করা যায়। আবার কেউ কেউ আছে, সত্যি প্রেমে কাতর। একটা সময় মাথা গরম হয়ে যেত। ফোন করলে ধমকাত, আর বিরক্ত করলে ‘থানায় যাব’ বলে ভয় দেখিয়েছে। এখন আর এ সব গায়ে লাগে না। বিতান সবটার দখল নিয়েছে। এক দিন সে ফোন না করলে আহিরীর মন খারাপ হয়ে যায়। তবে চট করে সে প্রকাশ করে না। ভালবাসার মানু্ষের উপরে রাগ অভিমান খুব জটিল ব্যাপার। তারা যে কখন কী করবে বোঝা যায় না।
তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল আহিরী। নিজের পোশাকের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল। মুচকি হাসল একটু। বিতানকে চমকে দিলে কেমন হয়? বড় রসিকতা-করিয়ে এ বার তার রসিকতা দেখে কুপোকাত হয়ে যাক। খাটের উপরে পড়ে থাকা নিজের শাড়ি, জামা, অন্তর্বাস থেকে হাত সরিয়ে নিল আহিরী।
বিতান হাতে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। ঘেমেনেয়ে একসা। ঘরে ঢুকেই সে চমকে উঠল। ডিভানে এটা কে বসে আছে!
‘‘এ কী! আহিরী... তুমি!’’
আহিরী হাতের ম্যাগাজিনটা সরিয়ে রেখে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘‘না আমি নই, তুমি।’’
বিতান থতমত গলায় বলল, ‘‘এ সব কী পরেছ!’’
ক্রমশ