ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
বিতান বলল, ‘‘ওয়র্ডসওয়র্থ স্বর্গের আলো নিয়ে অবশ্য অন্য রকম কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, স্বর্গের সব আলোই আসলে ভোরের আলো। দ্য লাইটস অব হেভেন ফল হোল এন্ড হোয়াইট/ অ্যান্ড ইজ নট স্যাটায়ার্ড ইনটু ডাইজ়/ দ্য লাইট ফরএভার মর্নিং লাইট।’’
আহিরী নিজেকে হালকা করার জন্য বলল, ‘‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওয়র্ডসওয়র্থ আবৃত্তি করাটা ঝঁুকির ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না? তোমার কবিতা শোনার জন্য ভিড় হয়ে গেলে সমস্যা হবে। চলো অন্য কোথাও যাই।’’
বিতান ঘুরে আহিরীর মুখোমুখি হল। বলল, ‘‘তোমাকে একটা কথা বললে রাগ করবে?’’
আহিরী বলল, ‘‘তোমার কোন কথাটা রাগ করার মতো নয়?’’
বিতান হেসে বলল, ‘‘আমি যে রাগ করার মতোই মানুষ। আহিরী, তোমার সঙ্গে অনেক রসিকতা করেছি, আজ কয়েকটা সিরিয়াস কথা বলব।’’
আহিরী একটু থমকাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘‘বাপ রে, হঠাৎ গুড বয় হয়ে গেলে যে বড়?’’
বিতান চোখ পাকিয়ে বলল, ‘‘যারা হাসিঠাট্টার মধ্যে থাকে তারা ব্যাড বয় না কি?’’
আহিরী এ বার খানিকটা রাগের সুরে বলল, ‘‘ব্যাড নয়, ওটা আসলে জীবনের রিয়েলিটিকে এড়িয়ে থাকার একটা ধরন। লুকিয়ে রাখারও বলতে পারো।’’
বিতান বলল, ‘‘যদি সেটা বাধ্যতামূলক হয়?’’
আহিরী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘‘কে তোমাকে বাধ্য করছে? নিজে যা ভাল মনে করবে সেটাই ঠিক।’’
বিতান বলল, ‘‘ঝগড়াটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে না করে, কোথাও গিয়ে করলে ভাল হত না?’’
আহিরী বলল, ‘‘স্যরি। এস গাড়িতে ওঠো।’’
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আহিরী বলল, ‘‘কোন দিকে যাবে? হোয়্যার ইজ ইয়োর হেভেন? সিট বেল্টটা লাগাও।’’
বিতান বলল, ‘‘আমার স্বর্গ সব সময়েই আমার বাড়ি, আমার ঘর। দেয়ার ইজ নো বস, নো চাপ। আগে ট্র্যাফিকের ভিড় টপকে চলো বাইপাসে উঠি।’’
আহিরী চুপ করে গাড়ি চালাতে লাগল। সেক্টর ফাইভের রাস্তাগুলো সরু। সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাতে হয়। যারা জায়গাটা বানিয়েছিল, তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। এই দেশে এটা বড় সমস্যা। পরিকল্পনার সময় কেউ দূরটা দেখতে চায় না। এখানেও বুঝতে পারেনি, এক সময় অফিস, গাড়ি, লোকজনের এতটা চাপ বাড়বে। একটা সময়ে পিক আওয়ারে গাড়ি নড়তে চাইত না। তাও তো ‘ওয়ান ওয়ে সিস্টেম’ দিয়ে এখন অবস্থা কিছুটা সামলানো হয়েছে। আহিরীর মনে হল, জীবনে এ রকম কোনও সিস্টেম থাকলে ভাল হত। পথের মতো জীবনের জটও ছাড়ানো যেত। বিতান কোথায় যেতে চাইছে? কফি শপে? রুবি মোড় থেকে একটু গেলে গলির মধ্যে ছিমছাম একটা কফি শপ আছে। কয়েক বার দুজনে বসেছে।
বিতান সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘সিরিয়াস কথা নম্বর এক হল, আজকের ইন্টারভিউতেও ফেল করেছি। নিজের ইচ্ছেতেই ফেল করেছি। ওরা জিজ্ঞেস করল, হায়দরাবাদ বা কোচিতে যেতে রাজি আছি কি না। বললাম, না।’’
আহিরী স্টিয়ারিং থেকে মুখ ঘুরিয়ে অবাক গলায় বলল, ‘‘কেন? রাজি নও কেন?’’
বিতান একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‘আমি গেলে তুমি খুশি হতে?’’
আহিরী উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘‘আমার খুশি হওয়া না হওয়ার কী আছে? চাকরি করতে হলে তো বাইরে যেতেই হবে। এখন ক’টা লোক কলকাতায় বসে আছে? আমাদের মতো যারা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় তাদের কথা আলাদা। তাও বাইরের ভাল কোনও ইনস্টিটিউটে চান্স পেলে চলে যাবে।’’
বিতান আহিরীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘‘তুমিও যাবে?’’
আহিরী খানিকটা তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘‘শিয়োর! ইউরোপ বা আমেরিকার কোথাও পড়ানোর চান্স পেলে ছেড়ে দেব? সে রকম হলে ওখানে গিয়ে আবার রিসার্চ করব। আমি তো তোমার মতো কেরিয়ার না করা, গুটিয়ে থাকা মানুষ নই।’’
বিতান মৃদু হেসে বলল, ‘‘কেরিয়ারের জন্য যোগ্যতা লাগে আহিরী ম্যাডাম।’’
যুবভারতী স্টেডিয়ামকে ডান দিকে রেখে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে বাইপাসে উঠল আহিরী। তার রাগ হচ্ছে। কলকাতার বাইরে যেতে হবে বলে ভাল চাকরির সুযোগ কেউ ছেড়ে দেয়!
‘‘তুমি বাইরে যেতে রাজি হলে না কেন?’’
বিতান বলল, ‘‘বললে বিশ্বাস করবে না।’’
সামনের গাড়িটাকে আলোর সিগনাল দিয়ে জায়গা দিতে বলল আহিরী। জায়গা দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই গ্লাসে তাকে দেখে নিয়েছে। মেয়েদের গাড়ি চালানো আজও এই শহর পুরো মেনে নিতে পারেনি। অ্যাক্সিলেটরে হালকা চাপ বাড়িয়ে আহিরী বলল, ‘‘তাও শুনি!’’
বিতান বলল, ‘‘আমার এখানে কাজ আছে।’’
সামনের গাড়িটার একেবারে গায়ের কাছে চলে গেল আহিরী। হর্ন দিল। লাভ হল না। ইচ্ছে করে যেন তাকে আটকাচ্ছে।
‘‘তোমার কাজ!’’
বিতান বলল, ‘‘বলেছিলাম, বিশ্বাস করবে না। যাই হোক, তোমাকে সেকেন্ড সিরিয়াস কথাটা বলি। আমি এখন যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটায় পার্ট টাইম কাজ করছি সেটাও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
সামনের গাড়িটাকে ওভারটেক করতে করতে আহিরী দঁাতে দঁাত চেপে বলল, ‘‘স্কাউন্ড্রেল!’’
বিতান ভুরু তুলে বলল, ‘‘কে? আমি তো?’’
আহিরী বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘‘ডোন্ট বি ওভারস্মার্ট। গালটা ওই গাড়ির ড্রাইভারের জন্য। যাক, এই কাজটা ছেড়ে দিয়ে ভাল করলে। ফুল বেকার হতে পারলে।’’
আহিরীর ব্যঙ্গ বিতান গা করল না। বলল,‘কোম্পানির মালিককে বলেছি, ভোরবেলা ফ্ল্যাটের জানলায় কীভাবে পাখি ডাকবে আমি কাস্টমারদের শোনাতে পারব না স্যার। আপনি বরং আমার জায়গায় কোনও হরবোলাকে রাখুন। ওরা পশুপাখির ডাক ভাল পারবে।’
আহিরী থম্ মেরে গাড়ি চালাতে লাগল। বিতান বলল,‘আমার হাতে আরও একটা সিরিয়াস কথা আছে। এটাই লাস্ট। কথাটা গাড়িতে বলা যাবে না। বলল, ‘‘তুমি কি শুনবে?’’
আহিরী বলল, ‘‘আমি শুনতে চাই না।’’
বিতান অল্প হেসে বলল, ‘‘তুমি রেগে গেছ আহিরী। আমি চাকরিটা নিলে তুমি খুশি হতে। সেটাই স্বাভাবিক। স্যরি।’’
আহিরী সত্যি রেগে গিয়েছে। কিন্তু এতখানি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় একটু লজ্জা পেল। ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘‘আমার রাগের কী আছে? তুমি নিশ্চয়ই সুবিধে অসুবিধে বুঝেই ডিশিসন নিয়েছ। এ বার বলো, কোথায় তুমি তোমার লাস্ট সিরিয়াস কথাটা বলতে চাও।’’
বিতান একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‘থাক। এক দিনে অনেক সিরিয়াস কথা বলা হয়ে গেছে। তুমিও অনেক রাগারাগি করলে। পরে কোনও দিন বলব। বরং চলো, আজ তোমাকে কফি বানিয়ে খাওয়াই। গরম কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করবে।’’
গিয়ার বদলে আহিরী অবাক গলায় বলল, ‘‘তুমি কফি বানাবে মানে!’’
বিতান চোখ বড় করে বলল, ‘‘কেন? আমি কফি বানাতে পারি না? শুধু কফি কেন, রান্নাও করতে পারি। সব সময় আমাকে তুমি শুধু আন্ডারএস্টিমেট করে গেলে আহিরী, আর আমার উপর রাগ করে গেলে। টিপিক্যাল মাস্টারনি টাইপ হয়ে যাচ্ছ। সবাইকে ছাত্র হিসেবে দেখছ, ধমক দিচ্ছ, আর জ্ঞান বিতরণ করছ— ভাল করে লেখাপড় করো, ভাল চাকরি পাও, ভাল সংসার করো।’’
আহিরী বলল, ‘‘কী বলব? লেখাপড়া না করে উচ্ছন্নে যাও?’’
বিতান বলল, ‘‘আবার ঝগড়া করছ? আমি রোজ খাই কী? ঘাস? নিজের রান্না নিজে করে খাই। তোমাদের মতো তো আমার বাড়িতে কুক নেই।’’
আহিরী বলল, ‘‘সারপ্রাইজ়িং! আমি তো জানি, তুমি ভাত সেদ্ধ ছাড়া কিছুই পারো না। ও হ্যঁা, ডিম ভাজতে পারো। আমাকে বলেছিলে।’’
বিতান মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘‘নিজেকে ডেভেলপ করেছি। সাহস থাকলে চলো, আজ পরীক্ষা হয়ে যাক। আজ আমার বাসস্থানে তোমার ডিনারের নেমন্তন্ন।’’
আহিরীর ভাল লাগছে। এত ক্ষণে সে সহজ হতে পেরেছে। সত্যি কি সে টিপিক্যাল মাস্টারনি টাইপ হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই হচ্ছে। সারা ক্ষণ ভবিষ্যতের কথা ভাবছে। বিতানের কেরিয়ার নিয়ে ভাবা মানে তো আসলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবা। বিতান বিতানের মতো। এলোমেলো। কেরিয়ারবিমুখ। সে অল্প নিয়ে থাকতে চায়। তার বিশ্বাস–অবিশ্বাস, ভ্যালুজ় তার মতো। এই মানুষটাকে সে ভালবেসেছে। সেই ভালবাসায় ভবিষ্যতের হিসেব কষা অঙ্ক ছিল না। তা হলে? এত টেনশন কেন? মা ভাল বিয়ের চাপ দিচ্ছে বলে? শুধু কি তা-ই? নিজের খচখচানি নেই? কলেজে পড়াছে, সমাজে এক ধরনের সম্ভ্রম পাচ্ছে, সে কেমন ছেলের সঙ্গে মিশছে পঁাচ জন দেখবে, তা নিয়েও কি চিন্তিত নয়? শুধু মায়ের চাপের কথা বললে কেন হবে? নিজের ওপর রাগ হল আহিরীর।
বিতান বলল, ‘‘কী হল, আমার হাতের প্রিপারেশনে ডিনার করবে তো?’’
আহিরী বলল, ‘‘সিরিয়াসলি বলছ না কি?’’
বিতান বলল, ‘‘অবশ্যই। আর একটু গেলেই আমার ফ্ল্যাট। তুমি তো কখনও গিয়ে দেখোনি আমি কেমন ভাবে থাকি। সেটাও দেখে আসবে।’’
আহিরী এ বার থতমত খেয়ে খেল। বিতানের সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে যাবে? যেখানে বিতান ছাড়া আর কেউ থাকে না। এই প্রস্তাব আগে কখনও বিতান তাকে দেয়নি। যাওয়া ঠিক হবে? আহিরী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। না, ঠিক হবে না। যে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন থাকবে কোনও ঠিক নেই, তার সঙ্গে একা ফ্ল্যাটে সময় কাটানোর কথা ভাবতে তার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্য কেউ হলে এই অস্বস্তি হত না। বিতান বলেই হচ্ছে। এই ছেলের সঙ্গে সে মনের দিক থেকে যুক্ত।
রুবি পেরিয়ে আরও খানিকটা গিয়ে বঁা পাশে গাড়ি দঁাড় করাল আহিরী। যতটা সম্ভব সুন্দর করে হেসে বলল, ‘‘আজ থাক। বাড়িতে চিন্তা করবে। ঘেরাওয়ের ঘটনাটার পর থেকে মা চিন্তা করে।’’
বিতান বলল, ‘‘ডিনার করতে হবে না। কফি খেয়ে যাও প্লিজ়।’’
বাঁ হাতটা বাড়িয়ে বিতানের হাতের উপর রাখল আহিরী। বলল, ‘‘আজ নয়। পরে এক দিন।’’
বাইরের রাস্তা আলো-ঝলমলে হলেও, গাড়ির ভিতরটা আলো–ছায়া মাখা। বিতান আহিরীর মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘‘পরে এক দিন কি আর সময় হবে আহিরী?’’ তার পর একটু হেসে, দরজা খুলে বলল, ‘‘থাক। তোমারও তো একটা প্রেস্টিজ আছে। চলি। গুড নাইট।’’
ক্রমশ