ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: ট্রেনে বিপাশাদির দেওয়া নাড়ু খেতে গিয়ে সাবুর মনে পড়ে গেল পুঁটির কথা। পুঁটিকে ফোনে না পেয়েই সে গিয়েছিল পুঁটির অফিসে। সেখানে সে শোনে পুঁটি-এনার ব্রেকআপ কাহিনি। সাবু এনাকে পছন্দ করে না, কিন্তু পুঁটির খারাপ লাগবে ভেবে সে চুপচাপ থাকে। বিপাশাদির সঙ্গে কথা বলে ট্রেন থেকে নামার পরই সাবুর ফোনে ফোন আসে এনার। অন্য দিকে মেট্রোয় যেতে যেতে পুঁটিকে বোঝানোর চেষ্টা করে যায় রিজু...
রিজু বলল, ‘‘কেন চুপ করব? আমরা সবাই এক সঙ্গে পড়তাম। এনা, সাবু এরা আমারও বান্ধবী। তখনই বলেছিলাম এই মেয়ের চক্করে পড়িস না। শুনলি না! কী? না হাত দু’টো কী সুন্দর! থুতনির আলতো টোলটা কী ফাটাফাটি! নে এখন বোঝ! তোকে ফাটিয়ে দিয়ে গিয়েছে! এমনিতেই তো মাসে দু’বার তাড়াত তোকে। কুকুরের মতো খাটাত। নোট লিখে দে। ফোটোকপি করে দে। ফোন রিচার্জ করে দে। জুতো সেলাই করে এনে দে। এটা করে দে, ওটা করে দে। তার পর দরকার ফুরোলেই লাথি মেরে তাড়াত। তুই শালা কাঙাল। তাও ল্যাংল্যাং করতে গিয়েছিস। বেশ হয়েছে!’’
আমার মনে হল বাজে কাগজের মতো রিজুকেও দলামোচড়া করে ট্রেনের জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে দিই! আজকাল যে কেউ এসে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে আমায়!
ও কী করে বুঝবে প্রেম কী জিনিস! অমলা বলে একটা মেয়ে ওকে ভালবাসত কলেজে। আর জন্তুটা সেই সুযোগে মেয়েটার ঘাড় ভেঙে নানা রেস্তরাঁয় খেত। মলে গিয়ে জামাকাপড় কিনত। এমন কী নিজের টিউশনের ফিও নিত এই বলে যে, ওর বাবা মদ খেয়ে নাকি সব টাকা উড়িয়ে দেয়!
এ দিকে রিজুর বাবা খুব ভাল মানুষ। নিরীহ। ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। জীবনে মদ কেন, এক চামচ কাশির সিরাপও খাননি।
মেয়েটা যে কী ভালবাসত ওকে! আমরা সাবধান করতাম অমলাকে। বলতাম, ‘‘রিজু কিন্তু তোকে ভালবাসে না!’’
তাতে রিজু রেগে যেত খুব। আমায় কত বার একান্তে বলেছে, ‘‘শালা, আমার আমদানি বন্ধ করে কী লাভ হচ্ছে তোর?’’
তার পর ফাইনাল ইয়ারে কালীপুজোর ঠিক আগে যখন অমলা বলল, এ বার বাড়িতে ও বলে দেবে ওদের রিলেশনের কথা, তখন রিজুব্যাটা ভাইফোঁটার দিন ওদের বাড়ি গিয়ে অমলার মাকে বলেছিল, ‘‘কাকিমা, আমি রিজু। অমলার ভাইয়ের মতো। ওর থেকে ফোঁটা নিতে এসেছি!’’
টানা দু’সপ্তাহ কেঁদেছিল মেয়েটা। তার পর কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। কয়েক মাস পর পরীক্ষা দিয়ে, রেজ়াল্ট বেরোবার আগেই বিয়ে করে নিয়েছিল চেন্নাইয়ে চাকরি করা একটা ছেলেকে। অমলা এখন যমজ বাচ্চার মা। সুখে আছে। আর ওই রিজুব্যাটা আমার জীবন নরক করে তুলবে বলে আমাদের কোম্পানিতেই কাজে জয়েন করেছে!
ট্রেনটা ময়দান ছাড়ল। আমি এ বার দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। পার্ক স্ট্রিটের প্ল্যাটফর্মটা বেশির ভাগ প্ল্যাটফর্ম যে দিকে তার উল্টো দিকে পড়ে। আমরা দু’জনেই দরজার কাছে দাঁড়ালাম।
রিজু বলল, ‘‘তোকে তখন থেকে কী জিজ্ঞেস করছি? শুনেছিস?’’
আমি দু’দিকে মাথা নাড়লাম। সত্যি শুনিনি। আসলে ওই যে বললাম। সবাই নর্মাল কলকাতায় ঘুরে বেড়ালেও আমি ঘন তরল ভর্তি বাটির মতো কলকাতায় থাকি এখন। সব কিছু বুঝতে পারি না।
ও বলল, ‘‘মিস্টার বাগালকে কি ফোন করেছিলি? না কি সেটাও ভুলে গিয়েছিস?’’
আমি চোখটা বড় বড় করে মাথাটা সামান্য ঝাঁকিয়ে নিজেকে সজাগ করার চেষ্টা করলাম। মনে পড়ল যে, ফোনটা করা হয়নি।
আসলে বাবা সেই যে বলেছিল মিস্টার বাগালের সঙ্গে দেখা করতে, তার পর আমি এক বারই ফোন করেছিলাম ওঁকে। উনি বলেছিলেন যে এখন নয়, সাত দিন পরে দেখা করতে যাই যেন।
আজ সেই সপ্তম দিন। আজ দেখা করার কথা। এটাই আমি নোট করে রেখেছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কী, ফোন করে যে এক বার কনফার্ম করে নেব সেটাই মনে নেই।
‘‘শালা!’’ রিজু দাঁত কিড়মিড় করে আমার হাতে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিল, ‘‘যা ভেবেছি! তোর কী হয়েছে বল তো! এমন সাইলেন্ট মড়াকান্না জুড়েছিস কেন? এ ভাবে কাজকম্ম হবে? এনা কিন্তু দিব্যি আছে। আর তুই হেদিয়ে শেষ হচ্ছিস! শোন, তুই এক কাজ কর। কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আয়। একটু ফ্রেশ হয়ে আয় মনে মনে।’’
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। সত্যি এ ভাবে কাজ হবে না। আমি কিছুতেই মন দিতে পারছি না। সারা ক্ষণ এনার কথা মাথায় আসছে। খালি মনে হচ্ছে, ও কী করে এটা পারল? অন্য এক জনকে ওর ভাল লাগছে! এটা সম্ভব! মাথার ভিতরে আবার বোলতা কামড়াল আমায়।
আর ঘুরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! মানে ঘুরতে গেলে কি মনটাকে কলকাতায় রেখে যাব? না কি কারও কাছে দিয়ে যাব এই বলে যে, সাবধানে রাখিস ভাই, এসে আবার ফেরত নিচ্ছি! লোকজন জ্ঞান দিতে ওস্তাদ। কিন্তু ভেবে দেখে না কী বলছে।
মা-ও কালকে রাতে খেতে বসে এই কথাই বলছিল। দোষের মধ্যে কী করেছি, না, মাংসের বাটির মধ্যে রুটি না ডুবিয়ে পাশে রাখা জলের গ্লাসের মধ্যে রুটি ডুবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলাম! আর তাতেই মায়ের মনে হয়েছে, আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। যে মানুষ মাংসের ঝোল আর জলের পার্থক্য বোঝে না, সে কি সুস্থ!
তার পর থেকেই মা জেরা শুরু করেছে। কেন আমি এমন করছি! কেন সারা ক্ষণ গুম হয়ে আছি। দাড়ি কামাচ্ছি না। কারও সঙ্গে কথা বলছি না। তার পর আচমকা, যেন নতুন ধাতু আবিষ্কার করেছে, এমন ভাবে চিৎকার করে উঠে বলেছিল, ‘‘ও এ বার বুঝেছি! তুই তো মোবাইলও ইউজ় করছিস না! সব ক’টাই কি এক কারণে? পুঁটি, সত্যি বল তো, সব ঠিক আছে? এনার সঙ্গে কিছু হয়েছে তোর?’’
শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ, ফেলুদা সবাই আমার মায়ের কাছে ফেল! নিজে নিজেই এমন সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক মিলিয়ে দেবে যে, জানাজানি হয়ে গেলে ফিল্ডস মেডেল বাঁধা!
আজ সকালেও ঘুম ভেঙে ওঠা থেকে শুরু করে অফিসে বেরনো পর্যন্ত মা সমানে টিকটিক করে গিয়েছে। আমি উত্তর দিইনি। কী দেব উত্তর! এনা কেন আমায় ছেড়ে অন্যের কাছে গেল, সেটা কি আমিই ছাই জানি না কি? তা ছাড়া মা গেস করেছে শুধু। মাকে শিয়োর হতে দিয়ে লাভ কী!
আজ কলকাতায় মেঘ করে আছে। আমরা মেট্রো থেকে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তাঘাট ভিজে। মানে মাটির তলায় যখন ছিলাম, তখন মাটির উপর বৃষ্টি হয়েছে। চার দিকে জল জমে আছে বেশ। আমাদের ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে যেতে হচ্ছে।
রিজু বলল, ‘‘অফিস থেকে গাড়িতে এলে এ সব পোহাতে হত না! তা না, উনি সাধু হয়ে যাবেন! কাকুকে বলব, তোর জন্য জোড়া বলদের একটা গাড়ি কিনতে। খোঁজ করলে শিয়োর পাওয়া যাবে। ওতেই তুই যাতায়াত করবি!’’
আমি বললাম, ‘‘একটু হাঁটতে শেখাও দরকার। সারা ক্ষণ গাড়ি গাড়ি কেন?’’
রিজু উত্তর হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই ‘পুঁটি’ বলে একটা ডাক শুনলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লামাদাদু।
একটা ঢোলা পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে আছে মানুষটা। কাঁচাপাকা চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। চোখে চশমা। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন।
আমি উঠে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম।
লামাদাদু এগিয়ে এল সামনে, ‘‘কী রে, কী খবর তোর? ফোন করলে বন্ধ বলছে! পাগলিকে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ও জানে না তোর কী খবর! ব্যাপারটা কী?’’
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে সামান্য হাসলাম।
‘‘শরীর ঠিক আছে? গালে দাড়ি, চোখদু’টো লাল, ডার্ক সার্কল... ব্যাপার কী?’’ লামাদাদু চিন্তিত মুখে এগিয়ে এল।
আমি হেসে বললাম, ‘‘কিছু না। ওই ব্যবসা নিয়ে টেনশন চলছে...’’
রিজু আর থাকতে না পেরে পাশ থেকে ফুট কাটল, ‘‘সেই! মুকেশ আম্বানি!’’
লামাদাদু থতমত খেয়ে গেল সামান্য। তার পর বলল, ‘‘জানিস তো আমার বাড়িতে চুরি হয়ে গিয়েছে! তোর করে দেওয়া পাখির ওই বসার জায়গা, জল রাখার জায়গা সব ভেঙে দিয়েছে। চুরির চেয়ে বেশি রাগ মিটিয়েছে!’’
আমি স্পষ্ট মনে করতে পারলাম না। সাবু কি বলেছিল আমায় এই নিয়ে কিছু?
আমি বললাম, ‘‘তুমি ভাল গার্ড রাখো বাড়িতে। কখন কী হয়ে যাবে!’’
লামাদাদু মাথা নাড়ল নিজের মনে। তার পর বলল, ‘‘চারটে খঞ্জনা আসত, জানিস! আর বেশ কিছু পাতি টুনিটুনি, বেগুনি মৌটুসি, বাবুই, নীলগলা বসন্ত, মদনা টিয়া, ফটিকজল, বেনেবৌ, ছোট সহেলি আরও কত কী! আমি খাবার, জল রাখছি এখনও, কিন্তু ঠিক হচ্ছে না জানিস। তুই এমন সুন্দর বসার জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলি! সেগুলো নেই। ওরাও সে ভাবে আসছে না।’’
হ্যাঁ, আমি তৈরি করে দিয়েছিলাম। কাঠের কাজ করতে আমার ভাল লাগে খুব। ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় মানিকদার দোকান ছিল। শুধু যে ফার্নিচার তৈরি করত মানিকদা তা কিন্তু নয়। সঙ্গে নানা রকম মূর্তিও করত। দারুণ লাগত দেখতে আমার। আমি বসে থাকতাম মানিকদার কাছে। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে। তার পর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও একটু আধটু পারি এখন। বাড়ির ছাদের ঘরে একটা ছোট্ট ওয়ার্কশপ আছে আমার।
আচ্ছা, লামাদাদু কি পরোক্ষ ভাবে বলতে চাইছে যে, আমি গিয়ে আবার ও সব তৈরি করে দিই! কিন্তু আমার তো ইচ্ছে করছে না একদম। আমি ছাদের ওই ঘরটায় তালা দিয়ে দিয়েছি।
আমি বললাম, ‘‘দাদু, একটা মিটিং আছে। আমি পরে তোমার সঙ্গে কথা বলি?’’
লামাদাদু একটু অপ্রস্তুত হল। বলল, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুই আয়।’’
আমিও হেসে মাথা নেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
রিজু আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘‘এমন ভাবে আচমকা কেউ কথার মাঝে চলে যায়! কী যে করছিস পুঁটি। আচ্ছা একটা কথা বল তো?’’
‘‘কী!’’ আমি তাকালাম ওর দিকে।
‘‘উনি যে সব নাম বললেন, ওগুলো কী?’’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘‘আরে, পাখি তো! শুনলি না!’’
রিজু থমকে গেল একটু, ‘‘আমি আসলে মন দিইনি। তার পর আচমকা নামগুলো শুনে ভাবলাম মিষ্টির নাম বলছেন! শোন না, এখানে মিটিং হয়ে গেলে একটা কোনও রেস্তরাঁয় যাবি? মানে লাঞ্চটা আর কী! আমায় বেশ খাওয়াবি তুই আজ!’’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘‘কেন খাওয়াব?’’
রিজু আমতা আমতা করল। তার পর ঠোঁট চেটে বলল, ‘‘মানে, এমনি আর কী! এই যে এমনি এমনি মনখারাপ করছিস! তেমন এমনি এমনিই একটু খাওয়া না আমায়! আমি ব্রাহ্মণসন্তান, তোর পুণ্য হবে।’’
‘‘দত্ত কবে থেকে ব্রাহ্মণ হল রে?’’ আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম।
রিজু বলল, ‘‘আঃ, অত টেকনিক্যাল ভুল ধরিস কেন? একটু খাওয়া না!’’
‘‘কানের গোড়ায় খেতে চাইলে দিতে পারি!’’ আমি হাতটা দেখালাম ওকে।
রিজু বিড়বিড় করে বলল, ‘‘বেশ হয়েছে এনা ছেড়ে চলে গিয়েছে! কিপটে অ্যাসোসিয়েশনের ফাউন্ডার মেম্বার ছেলের সঙ্গে কে ঘুরবে?’’
অফিসটা চারতলার উপরে। পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। দরজার মাথায় কারুকাজ করা আর্চ। কাঠের সিঁড়ি। খাঁচার মতো লিফট। কেমন একটা পুরনো ঠান্ডা হাওয়া যেন আটকে আছে থাম আর খিলানের মধ্যে।
পুরনো কলকাতাকে মুছে ফেলার চেষ্টা বেশ কিছু দিন ধরেই হচ্ছে। পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন খাঁচা-বাড়িতে ছেয়ে যাচ্ছে সব দিক। তাই মাঝে মাঝে এমন হারিয়ে যাওয়া কলকাতার বাড়ি দেখলে চোখের আরাম হয়। মনেরও। বুঝি, টাকাই যখন সব কিছু নির্ধারণ করতে শুরু করে, তখন মনের ভাল লাগাকে পিছনের সিটে গিয়েই বসতে হয়।
‘‘তুই মাঝে মাঝেই স্ট্যান্ডবাই মোডে চলে যাচ্ছিস! উপরে যাবি? না কি হাঁ করে এখানে দাঁড়িয়ে লিফট দেখবি?’’ রিজু খোঁচা দিল আমায়।
উপরে উঠে দেখলাম অফিসটা বেশ বড়। বিলিতি কোম্পানি। অফিসের সাজসজ্জাও খুব সুন্দর। রিসেপশনে যে মেয়েটা বসে রয়েছে, তাকে দেখেই রিজু আবার ফিসফিসে গলায় বলল, ‘‘এখানেই আমি চাকরির চেষ্টা করব! তোরা অফিসে একটা ভাল রিসেপশনিস্টও রাখতে পারিস না!’’
‘‘শালা, সেক্সিস্ট পিগ!’’ আমি চাপা গলায় বললাম।