ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: সুমন বিদেশে চলে যেতে চায়। সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় প্রাক্তন স্ত্রী রাকা ও কন্যা পিয়াকে। তাই বিচ্ছেদের পরে আবার বিয়ে করতে চায় রাকাকে। প্রস্তাব মেনে নিতে পারে না রাকা। প্রশ্ন করে জয়িতার সঙ্গে সুমনের সম্পর্ক নিয়ে। এই বিতর্কের মাঝে সুমন জানতে পারে পিয়া ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। এ দিকে অরুণকে অনন্ত চাপ দেয় অকারণে রোগীর অপারেশনে। অরুণ জানতে পারে, এই চক্রে তাঁর স্ত্রী বিপাশাও সামিল।
যাই হয়ে যাক না কেন নিজের আত্মা বিক্রি করবে না অরুণ। ঠান্ডা চোখে সামনে তাকায় সে।
“অনন্ত... আমাদের কথা বোধহয় শেষ হয়ে গেছে, বেটার ইউ লিভ নাও।”
এ রকম জবাব অনন্ত আশা করেনি। সামান্য কালচে ছায়া ভেসে যায় মুখের ওপর দিয়ে। কিন্তু সেও বহু ঘাটের জল খাওয়া পাকা লোক। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে আরও খানিকটা জাঁকিয়ে বসে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘‘এই মেসেজগুলোর তো একটা মূল্য আছে, নাকি? বিপাশা আমার ছোট বোনের মতো। তার আব্দার আমি কী করেই বা ফেলি, তা ছাড়া নার্সিং হোমটা যখন তুমি খুললে, একবারে অতগুলো টাকাও তো বিপাশার কথাতেই দিয়েছিলাম। সেটারও তো একটা রিটার্ন থাকা উচিত।’’
কথা শেষ করতে না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অরুণ।
“শোনো অনন্ত, আঠেরো লাখ টাকা পাওনা আছে আমার কাছে। দরকার হলে আমার ফিক্সডগুলো ভেঙে কালই আমি ফেরত দেব সেটা। আর বিপাশার সঙ্গে ব্যাপারটা তুমিই বুঝে নাও। আর কোনও পেশেন্ট রেফার করবে না তুমি আমাকে,’’ কথা ক’টা বলে দিয়ে চেম্বারের বাইরে চলে যাচ্ছিল অরুণ। আর এক মুহূর্তও এই লোকটার সামনে থাকতে চায় না সে। বহু দিন আগের একটা ভুলের সূত্র ধরে এই লোকটা রাহুর মতোই লেগে আছে অরুণের জীবনে।
পলাশপুরের একই মাটিতে বেড়ে ওঠে অনন্ত ও অরুণের। অনন্তদের পাঁচ পুরুষের ব্যবসা। বেশ ধনী। অরুণের বাবা ছিলেন গরিব কেরানি। নিজের চেষ্টায় খুব কষ্ট করে অরুণ যখন এমবিবিএস পাশ করল, তত দিনে দক্ষিণের কোনও একটা কলেজ থেকে প্যারামেডিকেলের ডিগ্রি নিয়ে অনন্তও ডক্টর অনন্ত মণ্ডল হয়ে গ্রামেই জাঁকিয়ে বসেছে। অরুণ তখন সবে কলকাতার কিছু ওষুধের দোকানে বসছে।
অরুণের জীবনের প্রধান ভুল বিপাশাকে বিয়ে করা। বিপাশাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল অরুণ। বিয়ের আগে অরুণ বুঝতে পারেনি, ভালবাসা স্নেহ দয়া মায়া ইত্যাদি কোনও অনুভূতিই ছিল না বিপাশার মধ্যে। শুধু ছিল লোভ। ভয়ঙ্কর লোভ। প্রথমে বোঝেনি অরুণ। বোঝেনি তাই খুব সহজেই ওর ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল। ওর একটা নার্সিং হোম হবে। এই স্বপ্নটাও ফাঁদে পড়ার আর একটা কারণ। আর ঠিক সেই সময়, সুযোগ বুঝে এগিয়ে এল অনন্ত, টাকার ঝুলি নিয়ে। তিরিশ লাখ টাকা এক কথায় ধার। শুধু মুখে বলেছিল, মাঝে মাঝে গ্রামের পেশেন্ট পাঠালে দেখে দিও। অরুণের তাতে আপত্তি করার কথা নয়। খুব ভালবেসেই ও শুরু করেছিল কাজ। কিন্তু দু-তিন বছর যেতে না যেতেই অনন্তর আসল উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল অরুণের কাছে। প্রথমে পরোক্ষ ভাবে, তার পর সরাসরি বলতে শুরু করে। পলাশপুরের গরিব অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত রোগীদের সামান্য কিছু হলেই এখানে পাঠিয়ে অকারণ সার্জারি করিয়ে মোটা টাকা আদায় করতে চায় অরুণের মাধ্যমে। তার একটা বিশাল অংশ কমিশন হিসেবে পেতে চায় অনন্ত। অনন্তর উদ্দেশ্য বোঝা মাত্রই সাবধান হয়ে গিয়েছিল অরুণ। শুরু করেছিল ধার শোধ দেওয়া। কিন্তু এখনও আঠেরো লাখ বাকি। কিছু ফিক্সড আছে, সেটায় না হলে ফ্ল্যাটও বিক্রি করে দেবে, মনে মনে ভাবে অরুণ। আর এই চাপ নেওয়া যাচ্ছে না। নার্সিং হোম অরুণের কাছে শুধু টাকা রোজগারের জায়গা নয়। এটা ওর সাধনার জায়গা। সেই জায়গাটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই নোংরা ছায়ার বাইরে নিয়ে আসতে হবে। মনে মনে নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে চেম্বারের দরজা ঠেলে বাইরে পা বাড়ায় অরুণ। আর তখনই কানে আসে অনন্তর কথাগুলো।
“আদর্শ? আদর্শ ধুয়ে ধুয়ে জল খাবে তুমি? কত হাতি ঘোড়াকে দেখলাম... টাকার কাছে সব্বার সব আদর্শের ঢাক ফুটো... বুঝলে?’’
“কী বলতে চাইছ? আমি কারও মতো নই। আমার আদর্শ আমার কাছে।’’
“থাক... থাক! তোমার প্রাণের বন্ধু ডাক্তার অভিরূপ মুখার্জিকে মনে পড়ে? তিনি তো খেল দেখিয়ে দিলেন।’’
অরুণ থেমে যায়। টেবিলের কাছে ফিরে আসে সে, “কী? কী হয়েছে অভিরূপের?’’
“কেন? তুমি শোনোনি কিছু? ক’দিন ধরেই তো তিনি টিভি কাগজে হেডলাইন! কত দেখলাম... বলে সব মাছই খায়... নাম হয় শুধু বোয়াল মাছের!’’
“না, আমি কোনও খবর দেখিনি। বাপ্পার স্কুলের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাজে না বকে কী হয়েছে সেটা বলো,’’ একটু চঞ্চল শোনায় অরুণের গলা। অভিরূপ ওর ক্লাসমেট। ওদের ব্যাচের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে সাকসেসফুল বলা যায়। অভিরূপের যথেষ্ট নামডাক কলকাতায় ও শহরের বাইরে। বহু দিন যোগাযোগ না থাকলেও, অরুণ বন্ধুগর্বে খানিকটা গর্বিতই। যত দিন যাচ্ছে যে যার নিজের কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তবু কোথাও একটা টান তো থেকেই যায়। তাই হয়তো চোখে প্রশ্ন নিয়ে অরুণ তাকায় অনন্তর দিকে।
“তিনি তো এ বার অ্যারেস্ট হলেন বলে,’’ নাকে নস্যি নিতে নিতে বলে অনন্ত।
“মানে?’’
“মানে আবার কী? লিভার পেশেন্টকে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করিয়ে দিয়েছে। গাদা খানেক স্টেন্ট ও নাকি বসিয়েছে। সে পেশেন্ট তো টেঁসে গিয়েছে দু’দিনের মধ্যে। এখন এফআইআর করেছে পেশেন্ট পার্টি। তদন্ত চলছে।’’
“ও মাই গড! কবে হয়েছে এ সব? আমি তো কিছুই জানি না! হি মাস্ট বি ইন ট্রাবল। আমাকে তো খোঁজ নিতে হচ্ছে,’’ ছটফট করে ওঠে অরুণ।
“সেই তো বলছি, এ রকম হাইটের ডাক্তার যদি এমন ফলস অপারেশন করতে পারে, তা হলে ভেবে দেখ ওদের ওখানে দিনে দুপুরে কী পুকুর চুরিটা চলছে! আর তুমি সামান্য ক’টা অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করতে পারছ না? আজকের দিনে বাঁচতে গেলে কিছু কারচুপি তো করতেই হবে।”
অরুণকে কিছুটা পথে আনা গিয়েছে মনে করে আরও কথা বলে যেতে চাইছিল অনন্ত। তাতে জল ঢেলে দিয়ে অরুণ বলে, “বাঁচার জন্য কারচুপির দরকার সকলের পড়ে না অনন্ত। অভিরূপের তো কখনওই নয়। কিছু ভুল হচ্ছে তোমাদের।’’
দরজাটা ঠেলে এ বার সত্যি সত্যিই বেরিয়ে আসে অরুণ। এই মুহূর্তে সাতাশ জন পেশেন্ট ভর্তি আছে। তাদের এক বার দেখে নিয়েই অভিরূপের নার্সিং হোমে যাবে। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। অরুণ পিছিয়ে যায় অতীতে। ডাক্তারি পড়ার সময় বই কেনার মতো টাকা ছিল না অরুণের। নিজের নতুন কেনা বইগুলো নিয়ে হোস্টেলের ঘরে এসে অরুণের সামনে দাঁড়াত অভিরূপ। বইগুলোর সঙ্গে এগিয়ে দিত হাতটাও। বলত, ‘‘তুমিই আগে শুরু করো।’’ তেমনই আজ অরুণও হাত এগিয়ে দিয়ে বলতে চাইছে, ‘এই যে আমি আছি পাশে, ভয় কোরো না অভিরূপ।’
পকেট থেকে মোবাইল বের করে অভিরূপকে ফোন করে অরুণ। কয়েক বার রিং হওয়ার পর, ভারী গলার সাড়া ভেসে আসে, ‘‘হাই! ডক্টর অরুণ সাহা! প্রায় দু’বছর পরে কথা হচ্ছে। তাই তো? আজকাল তুমি ভারী ব্যস্ত থাকো বোঝাই যাচ্ছে।”
“আমি... আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই অভিরূপ। কোথায় এবং কখন তোমায় পাওয়া যাবে বলো?”
“দেখা করতে চাও তো চলে এস। তোমার কি অ্যাপো দরকার হয়েছে কখনও? আমি সব সময় তোমার জন্য ফ্রি অরুণ!’’
“ঠাট্টা নয় অভি, বলো কোথায় দেখা করা যাবে।’’
“উমমম... আচ্ছা... বেশ তা হলে চলে এস হোটেল চেন্নাইয়ে। ন’টায়। থার্ড ফ্লোর কফিশপে। থাকব আমি।’’
“এত জায়গা থাকতে কলকাতার বুকে চেন্নাই হোটেলটাই বাছলে তুমি? ওকে, তাই হবে।”
অভিরূপ হাসে, “আরে না না, এখানে এক জনের সঙ্গে অফিশিয়াল মিট আছে। কাল তো আমি বেরিয়ে যাচ্ছি থাইল্যান্ড। এই ভেনুটা ওরই ঠিক করা। তোমাকেও অ্যাড করে নিলাম। ওর খুব বেশি সময় লাগবে না। প্লিজ় না বোলো না।”
“কিন্তু উনি তো আমার জন্য বিরক্ত হতে পারেন। আমি না হয় অন্য কোনও দিন... তুমি ফিরে আমায় কল কোরো নাহয়,” ইতস্তত করে অরুণ।
“ইটস ওকে, আই থিঙ্ক শি ওন্ট বি ডিস্টার্বড। আরে, তুমি তো আমার বন্ধু। কোনও সমস্যা হবে না। তুমি চলে এস। শার্প অ্যাট নাইন।’’
ফোনটা বন্ধ করার পরেও কথাগুলোর রেশ অরুণের কানে থেকে গেল। কোনও মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে অভিরূপ। বলল তো অফিশিয়াল। কিন্তু পেশেন্ট বা পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে কফিশপে মিট করবে কি অভিরূপ? আচ্ছা, দেখাই যাক। মনে মনে বেশ খানিকটা কৌতূহল অনুভব করে অরুণ, আবার এত দিন পরে এত রাস্তা পার করে এসেও নিজের অনুসন্ধিৎসা দেখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে একটু।
ওই হাসিটাই ভুল ছিল। সামনের বারান্দাটা ফাঁকা। সে দিকে পা বাড়ানো মাত্র পিছন থেকে প্রায় লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় বিপাশা। দুই চোখে আগুন জ্বলছে। যেহেতু নিজেরও চেম্বার টাইম এটাই তাই গলার আওয়াজটা নিচু। সাপের মতো হিসহিস করে অরুণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, “হয়ে গেল কথা? এত তাড়াতাড়ি? আবার একা একা হাসছ? বাইরে হাসার লোক পেয়ে গেছ তা হলে? তাই আর ঘরের দিকে নজর পড়ে না?’’
ক্রমশ