ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: মিডিয়া থেকে জনগণ, ডাক্তার অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরব গোটা সমাজ। বিলাস পালের মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করেছে সকলে। কিন্তু এক মাত্র সেই জানে, সে ষড়যন্ত্রের শিকার। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে সে। কিন্তু এই সময় পাশে পায় সাংবাদিক তিয়াষাকে। সে তাকে ভাল উকিলের কাছে নিয়ে যেতে চায়। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দেয় সুপরামর্শ। অভিরূপের হাতে হাত রাখে তিয়াষা। সেই স্পর্শে অভিরূপের ভাল লাগে। আশার আলো দেখে সে।
চেম্বারের কোনায় ছোট্ট বেসিন থেকে ঘাড়ে মুখে জল বোলাতে বোলাতে সামনের আয়নায় তাকায় অরুণ। মাথা নাড়ে নিজের মনে। ধার করে নিজের নার্সিংহোম যখন দাঁড় করাতে পেরেছে, এটাকে বাঁচিয়েও রাখতে পারবে ঠিক। তার জন্য মানি স্কুইজিং মেশিন হওয়ার দরকার পড়বে না ওর। এক জন ডাক্তার মানুষের ভরসার জায়গা, মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার মহান ব্রত রয়েছে তার উপর। ডাক্তারের কখনও সাজে না অর্থলোলুপ পিশাচ হওয়া। এটা শুধু কথার কথাই নয়, এটা ডাক্তার অরুণ সাহার অন্তরের বিশ্বাস। কিন্তু বিপাশাও তো এক জন ডাক্তার। তারও তো এটাই আদর্শ হওয়া উচিত। সে কেন এই ভাবে ভাবে না? আয়নার ভিতর দিয়ে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে অরুণের।
ছোট্ট একটা টোকা পড়ে দরজায়। পর্দার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বাবুয়া, অরুণের ক্লার্ক কাম পিওন কাম সেক্রেটারি। “স্যর আসব?”
“কী হল বাবুয়া? একটু টিফিন করতেও দেবে না? কী বলছ বলো?”
বাবুয়া ভিতরে এসে দাঁড়ায়। একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দেয়, “স্যর ইনি এক বার দেখা করতে চাইছেন, আমি বলেছিলাম আপনি টিফিন করবেন, একটু অপেক্ষা করতে। কিন্তু...’’
অরুণ কার্ডটা নিয়েই লাফিয়ে ওঠে, ‘‘আরে কী কাণ্ড! ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ? ছি ছি...কই কোথায়?’’ বলতে বলতে নিজেই শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে আসে করিডোরের সামনের দিকে ছোট্ট লাউঞ্জে। অভিরূপ রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। পিছন থেকে গিয়ে কাঁধ জড়িয়ে ধরে অরুণ।
“তুমি নিজে এসেছ? কী কাণ্ড! আমাকে একটা ফোন করে দিলেই তো আমি চলে যেতাম। এস এস, ভেতরে এস। বাবুয়া, আমার সব প্রোগ্রাম দু’ঘণ্টার জন্য পিছিয়ে দাও। আর হ্যাঁ, কেউ এখন ভিতরে যেন না আসে। আর শোনো, খুব ভাল করে তৈরি করে দু’কাপ কফি পাঠাও। বাকি কী পাওয়া যাবে পরে দেখছি।’’
“এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই অরুণ।’’
“তা বললে কি হয়?” অরুণ চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “দ্য গ্রেট কার্ডিয়োলজিস্ট ডক্টর অভিরূপ মুখার্জি নিজে এসেছে। আমার রিকভারির তো ইজ্জতই বেড়ে গেল গো।’’ অভিরূপকে বসিয়ে অরুণ নিজেও মুখোমুখি বসতে বসতে বলে। বহু বছর বাদে বন্ধুকে সামনে পেয়ে যে সে অকৃত্রিম খুশি হয়েছে সেই ছটা লেগে থাকে তার চোখে মুখে। কিন্তু অভিরূপের নিস্তেজ গলায় পর মুহূর্তেই সব খুশিতে জল পড়ে যায় যেন।
“তোমার কাছে নিজেকে রিকভার করতেই এসেছি। বলতে পারো নিজের হারানো মানসম্মানটা খানিকটা ঝালিয়ে নেওয়া আর কী। তোমাকে দেওয়ার কিছু নেই। নিতেই আসা।’’
“দাঁড়াও দাঁড়াও... হারানো মানসম্মান... মানে? তুমি এই রিসেন্ট বুলশিটটার কথা বলছ? মানে যেটা নিয়ে মার্কেট তোলপাড় হচ্ছে? ওই বিলাস পাল ডেথ কেস?” অভিরূপ মাথা নাড়ে।
“ওটা নিয়ে তুমি চিন্তা করছ? তুমি?’’ হেসে মাথা নাড়ে অরুণ।
“কী বলছো? আমার নাম এফআইআর-এ আসবে যে কোনও সময়।’’
থামিয়ে দেয় অরুণ, “হওনি তো? এখনও পর্যন্ত অ্যারেস্ট হওনি, আর সেটা এত সহজও নয়। তোমাকে এক বার ছুঁয়েই দেখুক না, আমরা পুরো ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন রাস্তায় নেমে যাব না? সব বন্ধ করে দেব।’’ জোরের সঙ্গে বলে অরুণ। অভিরূপ অবাক হয়। সে তিয়াষার পরামর্শে অরুণের কাছে এসেছিল। অরুণ ওদের অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। কয়েকজন মানুষের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে গেলে পাশে জনবল চাই— এ কথাটা তিয়াষাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অভিরূপকে কিছু বলতেই হল না অরুণকে।
এমন ভরসার হাত সে না চাইতেই বাড়িয়ে দিল যে মনে মনে লজ্জা পায় অভিরূপ। সত্যি, শুধু নিজের প্রফেশনে ডুবে থেকে দিনের পর দিন এই অপরিসীম বন্ধুত্বকে কতটা দূরে রেখেছিল ও। অরুণের উপরে, এমনকি তিয়াষার উপরেও কৃতজ্ঞ বোধ করে সে।
“শোনো, নাথিং টু বি ওয়ারি অ্যাবাউট... অ্যান্টিসিপেটরি তুমি পাচ্ছই, তিয়াষা বলেছে আমাকে। খুব ভাল উকিলের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরাও থাকব সে দিন।’’
“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, তিয়াষা বলেছে মানে? তিয়াষাকে কোথা থেকে চিনলে তুমি?’’ অবাক হয়ে তাকায় অভিরূপ। অরুণ হাসে।
“ওকে কি তুমি আগে থেকেই চিনতে? ওর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার ব্যাপারে? কী আশ্চর্য! আমায় তো কিচ্ছু বলেনি!’’ ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন করে যায় অভিরূপ। ইতিমধ্যে ঘরে চলে এসেছে অর্ডারমাফিক খাদ্য পানীয়। অরুণ হাসতে হাসতে কফির কাপ টেনে নিয়ে বসে পড়ে, “তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন? যাকে তুমি চিনতে পারো, তাকে আমি চিনতে পারি না? কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো... খাও।’’
অভিরূপ এসে বসে, আনমনা হাতে তুলে নেয় কফির কাপ। চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে ঝি-ঝি ডাকা এসি মেশিনটার দিকে। অরুণ খুশি খুশি মুখে তখন ড্রয়্যার টেনে বার করে ফেলেছে একটা থ্যাঙ্কস গিভিং কার্ড, তাতে এক বছর আগের তারিখ। ডক্টর অরুণ সাহাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে নীচে সই করেছে তিয়াষা মিত্র। কার্ডটা এগিয়ে মেলে ধরে অরুণ, “ওর পরিচিত এক জন হাউসমেডকে বিনা পয়সায় সার্জারি করেছিলাম, সেই থেকেই পরিচয়। তোমাদের হাসপাতালের রিপোর্টিংটা প্রথমে দেখেই আমি ওকে ফোন করেছিলাম। নিয়মিত আপডেটও পাই ওর কাছেই। ভারী ব্রাইট অ্যান্ড ওয়ার্ম পার্সোনালিটি কিন্তু মহিলার, সমস্ত কিছুতে একটা ফাইট করার মেন্টালিটি আছে, হুইচ ইজ় রেয়ারলি ফাউন্ড নাউ আ ডেজ়।’’
অরুণের মুখে তিয়াষার প্রশংসা শুনতে শুনতে ভিতরটা কেমন জ্বালা জ্বালা করে অভিরূপের। কী অসহ্য এই কথাগুলো। তার মানে ভাল মতো যোগাযোগ রয়েছে ওদের মধ্যে। অভিরূপের ব্যাপারটা নিয়েও নিয়মিত আলোচনা করে গিয়েছে ওরা। যার বিন্দুবিসর্গও বলা হয়নি অভিরূপকে। অভিরূপের এ কথা এক বারও মনে হয় না, এতখানি জীবন পার করে এসে কত শত মানুষকে চিনেছে তিয়াষা, কত রকমের সম্পর্কে জড়িয়েছে, তার কোনও কিছুই তো জানবার কথা নয় ওর। কোনও বাধ্যবাধকতা কি তৈরি হয়েছে ওদের মধ্যে যে সব কথাই শেয়ার করতে হবে? সামান্য একটা অলিখিত সম্পর্কের সুতো দু’জনের মাঝখানে ঝুলে আছে কোথাও, কিন্তু মাত্র এইটুকুর জোরে বোধহয় সামান্য অভিমানও করা যায় না তিয়াষার উপর। মনে হয় না। এ সমস্ত কোনও কথাই মনে হয় না অভিরূপের। শুধু যে মনটা নিয়ে এসেছিল, সেটাতে কেমন জল পড়ে যায়। সুগন্ধী কফিতে চুমুক দিয়েও অচেনা বিস্বাদে ভরে থাকে মুখ। এটাও আর জানতে ইচ্ছে করে না যে বেল নিয়ে কী কথা হয়েছে তিয়াষার সঙ্গে অরুণের।
অভিরূপের ভাবান্তর অরুণের চোখে পড়ে না। সে মনের আনন্দে বলে চলেছে কথা। বহু দিন পরে বন্ধুকে কাছে পেয়ে প্রতিদিনের কঠিন জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে অনাবিল ঝরনাধারা।
“বুঝলে অভিরূপ, এই তিয়াষা মেয়েটিকে দেখে প্রথম দিন আমার কী মনে হয়েছিল বলো তো?’’
“কী আশ্চর্য, সে কথা আমার জানার বিষয় নয়,’’ ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে অভিরূপ, “আর আমি সে সব শুনে কীই বা করব?’’
“আহা শোনোই না। মনে হল ঠিক যেন মধুবালা এসে দাঁড়িয়েছে। তুমি তো জানো কলেজে পড়ার সময় আমি মধুবালার কী সাংঘাতিক ভক্ত ছিলাম। মেয়েটিকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভরাট চেহারা... বাঁকানো ঠোঁট...’’
“আঃ... অরুণ! আমার দেরি হচ্ছে, চলি এখন,’’ শব্দ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় অভিরূপ। কেন যে হঠাৎ করে মাথার মধ্যে দপদপ করতে শুরু করেছে! এই ক’দিনের গন্ডগোলে ওর নিজের শরীরটাই খারাপ হচ্ছে বোধহয়। এক বার প্রেশার চেক করতে হবে।
“এ কী? তুমি চলে যাচ্ছ? তোমার হিয়ারিংটা তো শুক্রবার পড়েছে। আমরা সবাই যাব। ডোন্ট ওরি।’’
তারিখটা এই প্রথম শুনল অভিরূপ। সে দিন উকিলের বাড়ি আলোচনা হয়েছিল কিছুটা। সাধারণত ফাইলিংয়ের সময় অভিযুক্তকে উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু অভিরূপের জন্য কী কারণে উনিই ওটা ম্যানেজ করে নেবেন বলেছিলেন। কথা ছিল ফাইলিংয়ের পর উকিল তিয়াষাকে ডেট জানিয়ে দেবেন। সেখান থেকেই ও নিজে জানতে পারবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিয়াষা অভিরূপকেও না জানিয়ে আগে তারিখটা অরুণকে জানিয়েছে। মাথার দপদপানিটা আরও যেন বেড়ে যায়। অরুণের ক্রমাগত বলে যেতে থাকা অনেক কথার একটারও জবাব না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের গাড়িতে গিয়ে ওঠে অভিরূপ।
অরুণের কাছে এসেছিল যখন, মনটা অন্য রকম ছিল। আসার পরে প্রথমে ওর সঙ্গে কথা বলে নিজেকে অনেকটা হালকাও লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যে এমন মুড অফ হয়ে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না অভিরূপ। অরুণ যতই তিয়াষার কথা বলছিল ততই যেন জিভের ভিতর থেকে একটা তিক্ত কষায় স্বাদ ছাপিয়ে পড়তে চাইছিল সারা শরীর জুড়ে। কেন অরুণ তিয়াষাকে অনেক আগে থেকে চিনবে কেন তিয়াষার সঙ্গে এত কথা হবে কেন তিয়াষা অরুণকেই সব বলবে... অজস্র অর্থহীন প্রশ্নের ঝাঁক এসে ভিড় করে উইন্ডস্ক্রিনে। নিজেকেও অবাক লাগে অভিরূপের।