ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: উদ্দালক প্রতিদিন রাতে হাসপাতালের গেটের বাইরে বেহালা বাজায়। তাকে হাসপাতালের ভিতর বেহালা বাজানোর প্রস্তাব দেয় ডাক্তার অভিরূপ। আর পাঁচ জনের মতো অভিরূপ উদ্দালককে পাগল ভাবে না। এ দিকে ডাক্তার সুমন সেন স্ত্রী রাকাকে ডিভোর্স দেওয়ার পরে আবার বিয়ে করতে চায়। সুমনকে বিয়ে করা মানে মেয়ে পিয়াকে কাছে পাওয়া। দোটানায় রাকা।
আজ এত দিন পরে এ কী প্রশ্ন করে বসল রাকা? যখন এই অভিযোগ তোলার মতো সম্পর্ক ছিল তখন কিছু বলল না। একরাশ লজ্জা ক্ষোভ এসে ওর মন ছেয়ে ফেলে।
সুমন এই ভাবনা বোঝে কি না বোঝা যায় না। সে একটুও উত্তেজিত হয় না। ঠান্ডা গলায় থেমে থেমে উচ্চারণ করে, “ওই সময়টার জন্য তোমার দায় কিছু কম ছিল না। পিয়া আসার পরে দিনের পর দিন তুমি আমাকে কাছে আসতে দাওনি। তুমি ভুলে গিয়েছিলে আমি এক জন মানুষ, যে দিনের শেষে শরীরের উষ্ণতা চায়, যার পরের দিনের লড়াইয়ের জন্য একটা আশ্রয় চাই। আমি কোনও দেবতা নই, মানুষ, তাই জয়িতার বাড়িয়ে দেওয়া শরীর না ছুঁয়ে নিজেকে পাথর করে রাখতে পারিনি। তুমি জানতে আমি পথভ্রষ্ট হচ্ছি, তবু আমাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা মাত্র করোনি। আর যে মেয়ে এসে তোমাকে এতটা দূরে ঠেলে দিল, আমিও প্রতিশোধ নিতে তাকেই তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছি!”।
“এত সব করে কী লাভ হল সুমন? তুমি একটু অপেক্ষা করতে পারলে না!’’
“হ্যাঁ, কোনও লাভ হয়নি। মাঝখান থেকে পিয়াটার ক্ষতি করে ফেলছি।’’ ভাঙা গলায় বলে সুমন। “বেটার লেট দ্যান নেভার। আমি সে দিন কোর্ট থেকে ফিরে অনেক অনেক ভেবেছি রাকা। চলো আমরা মেয়েটাকে একটা সুন্দর জীবন দিই। যেন আর কখনও ওর হাতের ওই রক্তজমা দাগ ফুটে ওঠার সুযোগ না পায়।”
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
অনেক ক্ষণ দু’জনেই কোনও কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল। রাকা উঠে দাঁড়ায়। এসি রুমে বসেও কেন যে সে ঘেমে যাচ্ছে! “আমাকে এ বার যেতে হবে। কাউকে কিছু বলে আসিনি। বাবা, বিল্ব সবাই চিন্তা করছে হয়তো।’’
“আর কেউ নেই চিন্তা করার?’’ সুমনের গলার বাঁকা সুর কান এড়ায় না।
“না! কই আর হল? সবার তো তোমার মতো স্টপগ্যাপ মেজ়ার কালেক্ট করার পারদর্শিতা থাকে না!’’
সুমন যেন ঠিকই করেছে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ঘুমন্ত রাকাকে জাগিয়ে তুলবে। অস্থির হাতে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় ওকে। “তুমি পিয়াকে নেওয়ার জন্য লড়াই করছ, বিয়েও করোনি, চাকরিও করো না। আমার টাকাও নিলে না। কী ভাবে মানুষ করবে ওকে? তোমার ওই ক’টা গানের টিউশন করে? কেন রাজি হচ্ছ না আমার কথায়? আর কত বার কী ভাবে বললে তুমি শুনবে আমার কথা?’’
এতগুলো কথা শুনেও রাকা একটুও উত্তেজিত হয় না। সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকে মনটাকে অনেক দূরে কোথাও পাঠিয়ে। তার পর যেন শূন্য থেকে ভেসে আসে ওর গলার স্বর, “তুমি ঠিক কী কী কারণে চাইছ ছেঁড়া তার জোড়া দিতে, সেটা আগে ঠিক করো। আমাকেই কী প্রয়োজন তোমার? নাকি পিয়ার জন্য গাইডেন্স... যা তুমি তোমার মা বা বোনের কাছে পাচ্ছ না!”
সুমন কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রাকা থামিয়ে দেয়, “আমি আমার মেয়েকে কী ভাবে মানুষ করব সেটা বোধহয় তোমার কনসার্নের মধ্যে পড়ে না, ওটা বিচারক দেখবেন। সব দিক খতিয়ে দেখে তিনি আমায় মেয়ের কাস্টডি দেবেন অথবা দেবেন না!”
“আহ...হা তুমি ভুল বুঝছ আমাকে। আমি তোমাকেই চাই। তোমাকেই চাইছি। কেন বুঝতে পারছ না?’’ সুমন দৃশ্যতই ছটফট করে।
“আর জয়িতা? এত দিন যে তুমি তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে? তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে? যেমন আমাকে দিয়েছিলে?’’ রাকা চেষ্টা করেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। এত কথার কোনও দরকার ছিল না, যদি না ও নিজে ভিতরে ভিতরে সুমনের প্রস্তাবটার মোহে পড়ে যেত। কী ভীষণ আকর্ষণ ওই হঠাৎ দেখানো স্বপ্নটায়! এক মুহূর্তে রাকাকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে অতীতের সব অপমান।
“তোমাকে অনেকগুলো কথা আমার বলা হয়নি। এ ভাবে হবেও না। একটু শান্ত হয়ে নিরিবিলিতে বসে বলতে হবে সব কথা। সব শুনলে জয়িতার ব্যাপারে তোমার কিছুটা ভুল ধারণা ভেঙে যাবে।’’
হাত তুলে সুমনকে থামায় রাকা। ক্লান্ত শোনায় ওর গলা, “থাক না। আর কী কোনও দরকার আছে? আমি তো কোনও জবাবদিহি চাইনি তোমার কাছে।’’
চোখে মুখে ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে সুমনের। সে বলতে যাচ্ছিল কিছু। কিন্তু মোবাইলটা বেজে উঠে ভেঙে দেয় কথার ঢেউ। কানে মোবাইল চেপে ক্রমশ গম্ভীর হয়ে যায় মুখ। কপালে ফুটে ওঠে গভীর ভাঁজ।
এত ক্ষণের সব কথা, সব বিভেদ সব ভুলে গিয়ে রাকা পাশে এসে দাঁড়ায়, চেপে ধরে সুমনের শার্টের হাতা।
“কী? কী হয়েছে?’’
“আমাকে এখনই ফিরতে হবে মেদিনীপুর। স্যরি। আমাদের বেরোতে হচ্ছে।’’
“কী হয়েছে? আমাকে বলা যায়?” খুব কুণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে রাকা।
দরজা লক করে হুড়মুড় করে লিফটে পা রাখে সুমন। পিছনে রাকা। গাড়ির সামনে এসে থামে সুমন। “পিয়া ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। নার্সিং হোমে নিয়ে গেছে...’’
“সে কী!’’ আঁতকে ওঠে রাকা।
“হ্যাঁ। আমাকে ফিরতে হবে। এয়ারপোর্ট মোড় থেকে তুমি ট্যাক্সি নিয়ে নাও প্লিজ়।’’ গাড়ি স্টার্ট করতে যাচ্ছিল সুমন। ওর হাতের উপর এসে পড়ে রাকার ঠান্ডা কোমল হাত, “শোনো, আমিও যাব তোমার সঙ্গে। ও পাশের দরজাটা খোলো।”
৮
ডক্টর অরুণ সাহা টেবিলের উপর দু’হাত ছড়িয়ে, হাতের উপর মাথা গুঁজে গুম হয়ে বসে ছিল। যেন ডাক্তার নয়, কোনও মহাকাব্য রচনার আগে নিবিষ্ট চিন্তামগ্ন স্রষ্টা। সামনে রাখা চায়ের কাপে ঠান্ডা চা। অদ্ভুত একটা আওয়াজ তুলে বুড়ো এসি মেশিনটা চেম্বারের ভিতরটুকু ঠান্ডা রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিকট গরমটা নেই ঠিকই, কিন্তু এসি চেম্বারের ইজ্জতও পুরোদস্তুর বজায় আছে তা বলা যাবে না। বোঝাই যায় যে অবিলম্বে নতুন মেশিন বসানো দরকার। আরও কত কিছুই দরকার। কিন্তু যে করবে তার কোনও মন আছে বলেই মনে হয় না। এই মুহূর্তে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
পান খাওয়া দাঁত বার করে হাসে উল্টো দিকের চেয়ারে বসা ডাক্তার অনন্ত মণ্ডল। পকেট থেকে রুপোর নস্যির কৌটো বার করে ঠুকতে ঠুকতে তাকিয়ে থাকে অরুণের দিকে। অরুণকে দেখতে দেখতে সেই হাসি আরও প্রকট হয়, “আরে বাবা... তুমি তো দেখছি ভেবে ভেবেই রাত কাবার করে দেবে। অত ভাবনা চিন্তা করার আছেই বা কী?”
“সরি অনন্ত। তোমার কথায় রাজি হওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে,” ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতো টং করে বেজে ওঠে অরুণ।
“আরে এক কথায় সম্পর্ক কাটলেই কি চলে? ব্যাপারটা এত সিম্পল আর তুমি পায়ে ঠেলছ। এক বার সিজ়র চালিয়ে জায়গাটা আবার সেলাই করে দেবে। ব্যস! কে আর কী দেখতে যাচ্ছে। তা ছাড়া কিছু পেতে গেলে কিছু রিস্ক তো নিতেই হবে।” উঠে জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে পিচ করে খানিকটা থুতু ফেলে আবার এসে বসে অনন্ত। এক টিপ নস্যি নেয়। তার পর হাঁচির স্রোত বন্ধ করতে নাকে চেপে ধরে ময়লাটে রুমাল। পুরো দৃশ্যটাই অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে দেখছিল অরুণ। বিরক্তিটা এই সমস্ত থুতু ফেলা নস্যি নেওয়া ইত্যাদির জন্য, না কি অনন্তর বক্তব্যের জন্য তা আলাদা করে বোঝা যায় না। অরুণের বিরক্তিকে আমল দেয় না অনন্ত মণ্ডল। সে হাত নেড়ে নেড়ে বুঝিয়ে চলে। ‘‘শোনো। গত দু’মাসে তোমাকে রানিডাঙ্গা পলাশপুর থেকে সাত জন পেশেন্ট রেফার করলাম। তুমি কী করলে? দু’জনকে মাইনর অপারেশন করে পরের দিনই ছেড়ে দিলে। আর পাঁচ জনকে বলেই দিলে অপারেশনের দরকার নেই। ভাল ভাল ওষুধ দিয়ে তাদের পেটে ব্যথাও ভাল করে দিলে। তারা গ্রামে ফিরে গিয়ে সবার কাছে আমার মুণ্ডুপাত করতে লাগল, আর তোমার নামে দু’ঢোক জল বেশি খাচ্ছে। “
“যার জন্য যা প্রয়োজন আমি ঠিক সেটাই করেছি। শুধু শুধু সার্জারি করে পয়সা নিতে আমি পারব না। আজ তো নয়, আমি প্রথম দিন থেকে একই কথা বলেছি।” অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে অরুণ। নাক কপাল কুঁচকে মোটা ভুরুর তলা থেকে বাজপাখির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অনন্ত মণ্ডল। এ বার নিঃশব্দ হাসিতে মুখ ভরিয়ে তোলে। “পারব না বললে তো চলবে না বন্ধু। তোমার বেটার হাফ তো তা বলছে না... বরং উল্টো কথাই বলছে।’’
“মানে?’’
“অ্যাই দ্যাখো!” অরুণের চোখের সামনে হোয়াটসঅ্যাপের পাতা খুলে মেলে ধরে অনন্ত মণ্ডল। যেখানে বিপাশা তাকে বারবার অনুরোধ করেছে আরও বেশি করে সার্জারি রেফার করতে। এমনকি দুঃখও প্রকাশ করেছে চাইল্ড স্পেশ্যালিস্টের টাকা রোজগার করার সুযোগ সার্জনের চেয়ে অনেক কম বলে। আবার অনন্তকে আশ্বাসও দিয়েছে অরুণের ব্যবহারে যেন কিছু মনে না করে, অরুণকে ও সামলে নেবে।
অরুণের মাথায় আগুন ধরে যায় মুহূর্তের জন্য। ছি ছি, কী নির্লজ্জ এই মহিলা! অরুণের ব্যক্তিগত জীবনটাকে নরক বানিয়েও ওর শান্তি নেই। প্রফেশনাল লাইফটাতেও সারা ক্ষণ পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করে চলেছে। চোয়াল শক্ত করে অরুণ। সেটা কিছুতেই হতে দেবে না ও। দরকার হলে নার্সিং হোম বন্ধ করে দেবে।