ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: তিয়াষা আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, ওর বন্ধু রিচা চলে যাওয়ার পরে স্রেফ তার সঙ্গে ফ্ল্যাটে থাকার জন্য দক্ষিণ বাংলায় পোস্টিং নিয়ে চলে আসে রিচার ভাই পিয়াস। অসমবয়সি জেনেও ছোট থেকেই পিয়াস প্রেমে পড়েছে তিয়াষার। তাকে পাওয়ার জন্য সে সব সময় সচেষ্ট।
হুমম...” অভিরূপকে চিন্তিত দেখায় একটু, কিছু ভাবছে। তার পর বলে, ‘‘কিন্তু একটু পরেই পেশেন্টের দল ঢুকতে শুরু করবে, আজ তো ভিজ়িট ডেট।’’
“সে তো স্যর... ভিড় হয়েই গেছে। আজ থার্টি থ্রি পেশেন্টস, আপনার স্যর ফিজ় ডবল করেও কোনও লাভ হল না। আমি বলি কী, রোগী দেখা শুরুর আগে এই রিপোর্টারের সঙ্গে একটু কথা বলেই নিন।”
“কেন?’’ পেশেন্টস ফাইল হাতে নিয়ে উদাসীন সুরে বলে অভিরূপ। আনমনা সে। অঞ্জলি জানে, ডাক্তারবাবু এখন এক সঙ্গে অনেক কিছু ভাবছে।
“এরা স্যর রিপোর্টার... যা খুশি লিখে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিছু করার থাকবে না। আপনার একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ নিলে হয়তো ওরা ঠিক ঘটনাটাই লিখবে।”
অঞ্জলির কথা শুনে অভিরূপের মন ফিরে আসে চেম্বারের টেবিলে। কথাগুলো শুনে ওর মাথা গরম হয়ে যায়। “যা খুশি লিখে দিলেই হল? সব তথ্য না দেখে? দেশে আইন-আদালত নেই? বেশ, ওর সঙ্গেই আগে দেখা করব। সেন্ড হার ইন... কুইক!’’
তিয়াষা টেবিলের উপরে তার মোবাইলের রেকর্ডার অন করে বসে আছে। উল্টো দিকের রিভলভিং চেয়ারে বসে অস্থির ভাবে মাথা দোলাচ্ছে অভিরূপ। তার সারা শরীর দুলে উঠছে মাঝে মাঝে। বোঝা যাচ্ছে, টেবিলের তলায় পা’দুটোও থেকে থেকেই নাড়াচ্ছেন তিনি। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে, বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে তিয়াষা জানে, এ সব হল গভীর চিন্তার বাহ্যিক প্রকাশ। মানুষ যখন ঠিক করে উঠতে পারে না কোন পরিস্থিতিতে ঠিক কী বলা উচিত, কী বললে তার সব দিক রক্ষা পাবে তখনই এই রকম অস্থির আচরণ করে।
সামান্য হেসে তিয়াষা বলে, “ডক্টর মুখার্জি, আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।’’
“আচ্ছা, এ সব বোধহয় সে দিনই আপনাকে বলা হয়েছে, তাই না? এক কথা আর কত বার বলতে হবে বলুন তো?’’ নড়াচড়া থামিয়ে স্থির হয়ে বসে কেটে কেটে বলে অভিরূপ।
“সে দিনের পরিস্থিতি কিছু আলাদা ছিল এটা আপনি মানবেন নিশ্চয়ই? তা ছাড়া আমাদের কাগজের রিপোর্টের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে, এটাও আমাকে নিশ্চয় বোঝাতে হবে না এক জন এমিনেন্ট ডক্টরকে!”
“এমিনেন্ট মাই ফুট... পুলিশ মিডিয়া যা পিছনে লেগেছেন দু’দিনে আমার এত দিনের প্র্যাকটিস জলে চলে যাবে,” কিছুটা বিমর্ষ গলায় বলে অভিরূপ।
তিয়াষা হাসে। কে জানে কোত্থেকে ওর ঠোঁটে এসে ভেসে যায় খানিকটা ছেলে-ভোলানো হাসি। ‘‘তা যাতে না হয় সে জন্যও তো আমাকে সবটা বলা দরকার ডক্টর।’’
ঢাকনা সরিয়ে কাচের গ্লাসে চুমুক দেয় অভিরূপ, “বলুন কী জানতে চান?”
“বিলাস পালের বাইপাস সার্জারি হয়েছিল, না কি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট? সেটা কে রেফার করেছিলেন?”
“কী মুশকিল, এগুলোর কোনওটাই তো হয়নি বিলাস পালের। আমি তো বলেছি প্রথম দিন থেকে।”
“কিন্তু রিপোর্ট বলছে বিলাস পালের হার্টে অপারেশন হয়েছিল এবং ...”
“দেখুন মিস... মিস...”
“তিয়াষা।”
“দেখুন তিয়াষা, এটা ঠিক যে বিলাস পালকে আমার কাছে রেফার করা হয়েছিল। আমি ওকে দেখেওছি। ওর কিছু ব্লকেজও পাওয়া যায় সি টি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করে। কিন্তু সেটা খুবই কম। তাই আমি কিছুই রেফার করিনি, শুধু কিছু ওষুধ দিয়েছিলাম।”
তিয়াষাকে চিন্তিত দেখায়। সে দ্রুত হাতে নিজের নোটস খুলে চোখ বোলায়। “এই তো, আপনার অফিস বলছে বিলাস পালের বাইপাস আপনি করতে বলেছিলেন।” অভিরূপের চোখের সামনে অফিস থেকে কালেক্ট করা পেশেন্টের বেড হেড টিকেট-এর কপি মেলে ধরে তিয়াষা।”
“হাউ স্ট্রেঞ্জ! এটাই তো আমি বুঝতে পারছি না! কে পেপার সই করল? এটা তো আমার সই নয়। যে ডাক্তার বিলাসবাবুকে দেখেছেন তাঁদের কারও সই নয় এটা,’’ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে অভিরূপ। ‘‘আপনি পড়ুন তো... পড়তে পারছেন নামটা?’’ তিয়াষা অনেক বার চোখ বোলায় কাগজটায়। অসম্ভব জড়ানো-প্যাঁচানো একটা সই। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
“আমার বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করেছে,” বলে অভিরূপ।
“কিন্তু কেন? এটা আপনার জায়গা। এই হাসপাতালকে লোকে আপনার নামে চেনে। তেরো বছরে আপনার হাতে অজস্র মানুষ প্রাণ ফিরে পেয়েছেন, সুচিকিৎসা পেয়েছেন। সবই তো এখান থেকে। তাঁরা আপনাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেন। এখানে আপনার শত্রু থাকতে পারে! ভাবতে একটু অদ্ভুত লাগছে,’’ কথাগুলো বলতে বলতে থেমে যায় তিয়াষা। অভিরূপ কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসছে। পরিচয় হওয়ার পর থেকে এই লোককে তো হাসতে দেখেনি তিয়াষা!
“শত্রু? হবে হয়তো। হয়তো আমি নিজেই তৈরি করেছি শত্রু। কিন্তু আমি আপনাকে তার খোঁজ কেন দেব? আপনি খুঁজুন। খুঁজে বার করুন। ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিজ়ম আপনি করছেন, আমি নয়।’’
তিয়াষা উঠে দাঁড়ায়, “বেশ তাই করব। তবে তার জন্য মাঝেমধ্যে আপনার সাহায্য দরকার হবে।’’
হাতের রেকর্ডারটা বন্ধ করতে গিয়েও একটু থামে তিয়াষা। “আচ্ছা, একটা কথা, বিলাস পাল কেন ভর্তি হয়েছিল এখানে?’’
‘‘দেখুন, রোজ হাজার মানুষ আসেন এখানে। এখানে একাধিক ডাক্তার আছেন। তাঁরা রেফার করলে তবেই রোগী ভর্তি হয়। বিলাস পাল অ্যাডমিট হয়েছিল, ডক্টর নম্রতা বেরার আন্ডারে। উনি এক জন কার্ডিওলজিস্ট। উনি আবার আমাকে রেফার করেছিলেন। তবে অফ দ্য রেকর্ড বলতে পারি, বিলাসের লিভারের সমস্যা ছিল।’’
“কেন? অফ দ্য রেকর্ড কেন?’’
“এটা মেডিক্যাল এথিক্স। আমি যেটুকুর জন্য রেফারড, শুধু তাই নিয়েই কথা বলব। তার বাইরে নয়।’’
“কিন্তু আপনি যখন নিজেই ষড়যন্ত্রের কথা বললেন, তখন কি আপনি এথিক্সের মধ্যে থেকেই কথা বলবেন ডক্টর মুখার্জি? আপনি তো জানেন, ইতিমধ্যে এফআইআর হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। আপনার নাম এখনও আসেনি, কিন্তু তার সমস্ত সম্ভাবনা আছে।’’
“উফ! আমি খুব ক্লান্ত তিয়াষা,” আবারও জল খায় অভিরূপ। “আচ্ছা, আপনি আছেন কেমন? সে দিন তো হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। ওষুধগুলো খাচ্ছেন তো নিয়মিত? অ্যান্ড আজ কিন্তু আপনার বার হওয়া উচিত হয়নি। আরও তিন-চার দিন আপনার বিশ্রাম নেওয়া উচিত।”
“জানি। কিন্তু রিপোর্টটা দেওয়া দরকার। দেরি হলে ক্ষতি হয়ে যাবে। আপনি মিডিয়ার প্রভাব অস্বীকার করতে পারেন না,” একটু অস্থির ভাবেই বলে ফেলে তিয়াষা। অভিরূপ একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওর দিকে। এ বার সেই বিখ্যাত ব্যারিটোন ভয়েসে বলে, “কার ক্ষতি? তিয়াষা?’’
এক সেকেন্ড বা তারও কম সময় তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয় তিয়াষা। একটু হেসে বলে,
“ধরে নিন না আমারই।’’
ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পরেও চুপ করে বসে থাকে অভিরূপ। মোবাইলে ভেসে উঠছে চুমকির নম্বর। ধরতে ইচ্ছে করে না। জানে সে, তুচ্ছ কোনও কথা নিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট করবে চুমকি। এখন কোনও ভাবে ওর সঙ্গে কথা বলার মন নেই। কখনওই থাকে কি? চকিত প্রশ্ন ঘনায় মনে। অভিরূপ বেল টেপে অন্যমনস্ক আঙুলে। অঞ্জলি বাইরেই অপেক্ষা করছিল। বাইরে রোগীর ভিড়। সবাই এসে এসে ওকেই জিজ্ঞেস করছে আর অভ্যস্ত তৎপরতায় হেসে হেসে সবাইকে ‘আর একটু’ অপেক্ষা করতে বলছে অঞ্জলি। কিন্তু আজ ডাক্তারবাবুর হাবভাব দেখে অঞ্জলির বেশ চিন্তাই হচ্ছে। তাই বেল বাজা মাত্র সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “বাইরে তো ভিড় হয়ে গেছে স্যর, পাঠাব?’’
মাথা তুলে তাকায় অভিরূপ, “আচ্ছা অঞ্জলি, তোমার কি মনে হয়, এখানে আমার কোনও শত্রু আছে? মানে কেউ আমার ক্ষতি চায়! নাম বলতে পারো?”
কী কথার কী উত্তর! ভিতরে ভিতরে চমকালেও নিজেকে সামলে নেয় অঞ্জলি। তেরো বছর ধরেই অভিরূপের প্রাইভেট সেক্রেটারি সে। মানুষটাকে অনেকটাই চেনে। তার উপর এখন যা ঝড় যাচ্ছে তাতে একটু-আধটু বেসামাল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অভিরূপ উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছেন জিজ্ঞাসু চোখে। মাথা নিচু রেখেই অঞ্জলি বলে, ‘‘আমার মতে আছে স্যর!”
“হোয়াট! কই? এ কথা তো... কাকে মনে হয় তোমার? বলো।”
কারও নাম করে না অঞ্জলি। বোধ হয় অভিরূপও বোঝে সেটা।
“ওকে... ওকে। শ্যাল টক লেটার। তুমি পেশেন্ট পাঠাও।”
চলেই যাচ্ছিল অঞ্জলি।
“শোনো, বিলাস পালের ফুল হিস্ট্রি ফাইলটা এক বার এনে দিও তো। অফিসে বলবে, আমি তিন দিন পরে ফেরত দেব।’’
“ওটা তো সিজ়ড হয়ে গেছে!”
“কম্পিউটারে তো আছে। চেষ্টা করো বার করতে।’’
“ওকে স্যর,” বেরিয়ে যায় অঞ্জলি।
ভিড় এড়ানোর জন্য ফিজ় দেড় হাজার টাকা করে দিয়েছে অভিরূপ। তবুও আজ তেত্রিশ জন এসে হাজির। এক নাগাড়ে দেখে যায় অভিরূপ। সরলা সরকার ফোকলা দাঁতে হাসছিল ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে।