ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: লেক রোডের যে কফি শপে এনা সাবুকে দেখা করতে ডেকেছিল, সেখানে পৌঁছয় সাবু। কফি শপে ঢোকার মুখে ফোন আসে দীপ্যদার। সে সাবুকে এক দিন তার বাড়ি যেতে বলে। বলে, সাবুর সঙ্গে আলাদা করে তার কথা আছে। সাবু অবাক হলেও রাজি হয়। কফি শপে ঢুকে সে একটু দূর থেকে এনাকে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পায়। উচিত-অনুচিতের চিন্তা দূরে সরিয়ে মোবাইল ক্যামেরায় সাবু ছবি তুলে নেয় তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের।
আগেই বলেছি বাবারা তিন ভাই। তার সঙ্গে বাবার দুই বিধবা পিসিমা ও দুই অবিবাহিত কাকা, আমাদের সঙ্গেই থাকে। বাবার কাকা মানে আমাদের দাদু। কুট্টিদাদু আর ছোটদাদু। বার বার ঠাকুরদা বলতে ভাল লাগে না আমার। খালি মনে হয় যেন রবীন্দ্রনাথকে দাদা বলে ডাকছি। মানে ওই চক্রবর্তীদা, ঘোষদা, সান্যালদা এমন আর কী।
কুট্টিদাদুর ছোটবেলায় কী একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল বলে কুট্টিদাদুর শিরদাঁড়া সারা জীবনের মতো বেঁকে সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। ছোটদাদু কিন্তু অমন নয়। লম্বা মানুষ। কুট্টিদাদুকে বয়সকালে কে দেখবে, এই ভেবে নিজে আর বিয়ে করেনি।
এ ছাড়াও কাজের লোক আছে চার জন। আর আমরা তো আছিই। সব মিলে এটাকে বাড়ি নয়, মোটামুটি একটা পাড়া বলা যেতেই পারে।
আর কে না জানে যেখানে লোক বেশি, সেখানে গাজন নষ্ট হবেই। আমাদের বাড়ির এক-এক জন এক-এক ধরনের। মানে এক-এক জনকে নিয়েই বিশাল বড় বড় সব নভেল লেখা হয়ে যেতে পারে।
বাবার দুই পিসিমার বয়স পঁচাত্তরের উপর, তাও তারা রোজ সকালে উঠে গলা সাধতে বসে। আপনারা ভাবছেন, বয়স হয়েছে বলে কি গান গাওয়া বারণ? গলা সাধা বারণ? ঠিক আছে আনন্দবাজারের অফিসে আপনাদের ঠিকানা পাঠিয়ে দেবেন, আমি ঠাকুমাদের আপনাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেব। দেখবেন ভীষ্মলোচনের ফিমেল ভার্শন কাকে বলে! বিশেষ করে যারা ভাড়াটে তুলতে পারছেন না, তাঁরা আমার দুই ঠাকুমাকে ট্রাই করতেই পারেন। নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখুন, দেখবেন ঢ্যাঁটা ভাড়াটেরা দু’দিনে হাওয়া হয়ে গিয়েছে।
তার পর আছে ছোটদাদু। সারা ক্ষণ টেনশন করে যায় লোকটা। সব সময় ভাবে এই বুঝি চোর এল। ডাকাত এল। আস্ত চাঁদটা ভেঙে পৃথিবীর মাথায় পড়ল। ওই যে ফণী ঝড়টা এসেছিল, সেই খবর পেয়েই কুট্টিদাদুকে নিয়ে প্লেনে করে আমদাবাদে তিলতুদির বাড়িতে চলে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘‘কলকাতা ধ্বংস হয়ে গেলে ওখানেই থেকে যাব।’’
এমন প্রায় প্রত্যেকেই ইউনিক ধরনের পাগল। ভগবান হয়তো টিপ করে করেই আমাদের বাড়িতে সবাইকে ছুড়ে মেরেছেন।
তবে একটাই রক্ষে, আমার ঘরটা চারতলার এক পাশে। তাই আমার জীবনে বা আমাদের গল্পে এদের আসার স্কোপ নেই।
আমাদের বাড়িতে বাগান আছে বলে চার দিকটা সবুজ ঘেরা। এমনিতেই দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলটায় গাছপালা ভালই আছে। দু’পাশের রাস্তা, লেক সব জায়গাতেই নানা রকমের গাছ। তার সঙ্গে আমার ঠাকুমার ইচ্ছে ছিল বলে বাড়ির বাগানেও বড়-বড় গাছ লাগানো রয়েছে। আমার ঘরের পাশেই বেশ বড় একটা আম গাছ। তাতে আবার হলুদ রঙের দুটো পাখি-দম্পতি থাকে। মাঝে মাঝে ওদের দেখি আমি। ভাল লাগে বেশ।
জুলাই মাসের এক তারিখ আজ। শনিবার। বৃষ্টি এসেও ঠিক আসছে না। আজ অফিস ছুটি আমাদের। আমি ঘরে বসে রয়েছি একা। সামনে শীর্ষেন্দুবাবুরই একটা বই খোলা। আগে পড়া। কিন্তু আবার পড়ছিলাম। কিন্তু একটা জায়গায় রিখিয়া বলে একটা মেয়ে আর আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরার কথা এমন ভাবে লেখা আছে যে, আমার এনার কথা মনে পড়ে গেল।
এনারও ছবি তোলার শখ। ওরও একটা কুকুর আছে।
এই সব মনে-পড়াগুলো আচমকা ধাক্কা খাওয়ার মতো। মনে হয় বুকের ভিতরে কেউ যেন করাত দিয়ে পাঁজরগুলো কাটছে। কষ্ট হয় এত! কিন্তু পালাবার উপায় নেই। যেন ধরেবেঁধে বধ করা হচ্ছে।
সত্যি বলছি আপনাদের, সুখে থাকতে ভূতের কিল খেতে যাবেন না। প্রেম-ভালবাসা ওই সিনেমা আর নাটক-নভেলের জন্যই রেখে দেবেন। সাধ করে বাঁশ কেটে নিজের জীবনে আনবেন না।
আমি বইটা রেখে উঠলাম। এখন বসে বসে এ সব ভাবলে আরও বিপদ হবে। এ ধরনের চিন্তাগুলো চোরাবালির মতো। আর সত্যি বলতে কী, এ সব কষ্টের মধ্যে কেমন একটা আনন্দও যেন আছে। কিসের যে আনন্দ কে জানে! কিন্তু আছে। আর সেটাই সবচেয়ে মারাত্মক। আচ্ছা, আমরা কি সবাই সেডিস্ট!
জেঠুর এক ছেলে, এক মেয়ে। তিলতুদি আর বনিদা। তিলতুদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমদাবাদে থাকে। ফলে এই গপ্পে ঢোকার কোনও চান্স নেই। বনিদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। আমাদের বিজ়নেসেই যুক্ত। এখন যদিও এখানে নেই। বিদেশে গিয়েছে একটা ট্রেনিং নিতে। ফলে সেও বাদ।
জেঠু বলেছিল আমাকেও ট্রেনিং নিতে পাঠাবে। কিন্তু আমি এনার থেকে দূরে যাব না বলে যাইনি। ফলে নাও, এখন এনা গিয়ে বাগালের কাজ এসে জুটেছে কপালে!
‘‘দাদা।’’
আমি দেখলাম তিতি এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। মুখটা গম্ভীর। একটা স্কার্ট আর টপ পরে রয়েছে। দেখেই বুঝলাম স্নান হয়ে গিয়েছে ওর।
মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই এমন। গম্ভীর আর ঠোঁটকাটা। আমি সামান্য ভয়ই পেয়ে গেলাম। দ্রুত ভাবতে শুরু করলাম কোথাও কি ভুল করেছি! ও আমার চেয়ে ছোট। কিন্তু বাড়ির সবার মতো আমিও তিতিকে ভয় পাই।
আমি মনে মনে ভাবি, আরও বড় হয়ে আমিও তিতির মতো হব। গম্ভীর। উচিত কথা বলতে পারা একটা শক্তপোক্ত মানুষ। কিন্তু তার পরেই যখন খুচরো নেই বলে রোগা, বাঁটকুল, গুটখা চিবোনো অটোওয়ালার কাছে ধ্যাতানি খাই, বুঝতে পারি, আমার যা মশলা তাতে বড় জোর শিঙি মাছের ঝোল হতে পারে, মাটন কষা কোনও দিন হবে না।
রিজু আমায় বলে, ‘‘তুই এ বার গুটখা খেতে শুরু কর।’’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘‘কেন?’’
রিজু বলে, ‘‘তুই সারা ক্ষণ অমন কুড়ি-শূন্য গোলে হারা টিমের ডিফেন্ডারের মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াস তো, গুটখা খেলে দেখবি কনফিডেন্স পাবি। দেখবি আমাদের শহরে যে সব লোক বেশ মস্তান-মস্তান ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সবার দাঁতের অবস্থা পাংচার! সব ব্যাটা সারা ক্ষণ খচর মচর করে গুটখা চিবোচ্ছে! শিয়োর গুটখায় এমন কিছু একটা আছে, যাতে মনের মধ্যে অসভ্যতা আর কনফিডেন্স বেড়ে যায়। আ কাইন্ড অব ডোপিং!’’
এক দিন রিজুকে গামছা দিয়ে লাইট পোস্টের সঙ্গে বেঁধে পেটাবার ইচ্ছে আছে আমার। তখন বুঝবে গুটখা না খেলেও কী করা যায়!
আমি দু’পা এগিয়ে গেলাম তিতির দিকে।
তিতি বলল, ‘‘তোর মোবাইল কই?’’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘‘আপাতত ইউজ় করছি না।’’
‘‘কেন?’’ তিতি এখনও গম্ভীর।
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। পারলাম না বোধহয়। বললাম, ‘‘ইয়ে চোখে চাপ পড়ে। ড্রাই আই হয়। ব্রেন ক্যান্সারও নাকি হয়। মানে শুনেছি আর কী! তুইও আর মোবাইল ইউজ় করিস না।’’
‘‘তুই আর মোবাইল ইউজ় না করলে কি এনাদি ফিরে আসবে?’’
লারউডও বোধহয় এত ভাল বডিলাইন বল করতে পারত না। সোজা এসে যেন আমার মুখে লাগল বলটা।
তিতি বলল, ‘‘মেজ জেঠিমা সন্দেহ করলেও শিয়োর নয়। প্লাস বাড়ির আর কেউ তো জানেই না। কিন্তু আমি জানি। বিলু বলেছে আমায়!’’
বিলু তিতির ক্লাসমেট। এনাদের পাড়ায় থাকে।
আমি বললাম, ‘‘ও বাদ দে।’’
‘‘তুই দিতে পারছিস বাদ? সারা ক্ষণ এমন ছেঁড়া কাঁথার মতো মুখ করে ঘুরছিস। দেখে মনে হচ্ছে আমরা সবাই মারা গিয়েছি এক সঙ্গে!’’
‘‘আরে দূর। কী সব আজেবাজে কথা বলিস!’’ আমি হেসে ব্যাপারটা হালকা করতে চাইলাম, ‘‘বল না কী হয়েছে।’’
‘‘ল্যান্ডলাইনে ফোন এসেছিল। মিস্টার বাগালে বলে এক জন ফোন করেছিলেন। মানডে অবশ্যই তোকে ফোন করতে বলেছেন।’’
‘‘লাইনে আছেন এখনও?’’ আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম।
‘‘থাকলে আমি এত ক্ষণ দাঁড়িয়ে তোকে এ সব কথা বলি? না, ছেড়ে দিয়েছেন। রিজুদাকে নাকি ফোন করে পায়নি। জেঠুরাও তো জানিস ছুটির দিনে ফোন ধরে না। তাই বাড়িতে ফোন করলেন। দাদা, তুই এ ভাবে কাজ করবি? মোবাইলটা লাক্সারি নয় আর। ওটা নেসেসিটি। বোঝ একটু। পৃথিবীতে তুই একা নোস, যার ব্রেক-আপ হয়েছে। গ্রো আপ।’’
শালা রিজু, ফোন ধরিসনি কেন! দাঁড়াও, সোমবার তোমার হচ্ছে।
সে দিন বাগালে লোকটাকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। আরে, এই তো সেই ভদ্রলোক! যাকে ট্রামে করে যাওয়ার সময় ইয়াব্বড় একটা গাড়িতে চেপে যেতে দেখেছিলাম। বিশাল মোটা আর আঙুলে আংটির মেলা জমিয়ে দেওয়া সেই মানুষ!
আধ ঘণ্টা মিটিং চলেছিল আমাদের। বলেছিলেন যে চারটে প্রোজেক্টের কাজের মধ্যে দুটো কাজ উনি আমাদের দিয়ে করাতে চান। কিন্তু আমাদের প্রাইস লোয়েস্ট হতে হবে। তবে টেকনিক্যালি উনি সব রকম সাহায্য করবেন। আরও বেশ কয়েকটা কোম্পানি এই কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের কাজের পারফরম্যান্স আর কোম্পানির গুডউইল দেখে উনি চান আমরাই কাজটা পাই।
টেকনিক্যাল ডিটেল সবটাই উনি দিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। তার পর বলেছিলেন, ‘‘আরও কিছু ডেভেলপমেন্ট হলে আমি জানিয়ে দেব। তত দিন আপনারা এটা স্টাডি করে নিন। গেট ইয়োর কনফিউশনস ক্লিয়ারড। দেন কোট ইয়োর বেস্ট প্রাইস।’’
কথা শেষে উঠে আসার সময় আমি আর রিজু আমাদের ভিজ়িটিং কার্ড এগিয়ে দিয়েছিলাম। তবে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, আমার মোবাইল নম্বর কাজ করছে না। এমনি অফিসের বাইরে যোগাযোগ করতে হলে বাড়ির ল্যান্ডলাইন বা রিজুর নাম্বারে যেন উনি ফোন করে নেন।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সেই চন্দন সিং নামক লোকটির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল আমাদের।
‘‘আবার দেখা হবে,’’ বলে ও বাগালের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
লোকটাও নিশ্চয়ই কাজের ধান্দাতেই এখানে এসেছে। আমি রিজুকে বলেছিলাম, ‘‘মোবাইলটা অন রাখবি। বাগালে ফোন করলে ধরবি কিন্তু।’’
কিন্তু বাগালে রিজুকে ফোনে পায়নি। কী করছে ফোন অফ করে! আর একটা অমলা জুটিয়েছে না কি? সোমবার ওর হচ্ছে।
তিতি চলে যাওয়ার আগে বলে গেল, স্নান সেরে যেন নীচে আসি। ঠাকুমারা কী যেন একটা পুজো করবে তার লিস্টি তৈরি করছে। আমাকে নাকি সেটা লিখে দিতে হবে।
ঠাকুমারা সারা ক্ষণ কী এত পুজো করে কে জানে! এক দিকে পুজো করে আর এক দিকে, রিকশাওলার সঙ্গে দু’টাকা ভাড়া কমানো নিয়ে ঝগড়া করে! জমাদার দেরি করলে প্রায় তাদের কান ধরে ওঠবোস করায়! তরকারিওলার সঙ্গে আড়াইশো লঙ্কার দাম নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধায়! বনগাঁ থেকে মিষ্টি বিক্রি করতে আসা দিদিকে তার বরের থেকে আলাদা থাকার মন্ত্রণা দেয়!