নাটা মল্লিকের ছেলে

সরকারের খাতায় তাঁরও ফাঁসুড়ে হিসেবে নাম আছে। নাটার বাবাও ফাঁসুড়ে ছিলেন। ফাঁসির মঞ্চে সূর্য সেনকে দেখে বলেছিলেন, ‘না, আমি পারব না!’তোমার শরীরের রক্তই তো আমার গায়ে বইছে। রক্তের জোর একটা ব্যাপার, আমি পারবই।’ ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু পারবি একটা জ্যান্ত মানুষের হাতে-পায়ে দড়ি বাঁধতে? তার পর পরাতে হবে গলা অবধি নেমে আসা কালো টুপি। এর পর ফাঁসির দড়ি গলায় পরিয়ে পাটাতনের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া।’ ‘এ সব তোমার মুখে আগেও শুনেছি...’ ‘হুঁ...কিন্তু এর পর? তুইও জানিস, সেও জানে, এর পর কপিকলের হ্যান্ডেল টানলেই লোকটা গর্তের মধ্যে চলে যাবে। সব শেষ।’

Advertisement

বিকাশ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share:

জাপানি চলচ্চিত্রকার নাগিসা ওশিমা-র বিখ্যাত ছবি ‘ডেথ বাই হ্যাংগিং’-এর একটি দৃশ্য

তোমার শরীরের রক্তই তো আমার গায়ে বইছে। রক্তের জোর একটা ব্যাপার, আমি পারবই।’
‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু পারবি একটা জ্যান্ত মানুষের হাতে-পায়ে দড়ি বাঁধতে? তার পর পরাতে হবে গলা অবধি নেমে আসা কালো টুপি। এর পর ফাঁসির দড়ি গলায় পরিয়ে পাটাতনের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া।’
‘এ সব তোমার মুখে আগেও শুনেছি...’
‘হুঁ...কিন্তু এর পর? তুইও জানিস, সেও জানে, এর পর কপিকলের হ্যান্ডেল টানলেই লোকটা গর্তের মধ্যে চলে যাবে। সব শেষ।’
‘তার আগে একটা ‘দম’ করে আওয়াজ হবে।’
১৯৮৭ সালের এক ফাঁসির প্রস্তুতির কথা শোনাচ্ছিলেন মহাদেব। মহাদেব মল্লিক আর তাঁর বাবা নাটা মল্লিকের তখনকার কথাবার্তার হুবহু বিবরণ দিচ্ছিলেন। মহাদেবের নাম এখন সরকারের ঘরে ফাঁসুড়ের লিস্টে আছে। ১৯৮৭-তে তাঁর অর্ধেক হাতেখড়ি। ‘অর্ধেক’, কারণ ফাঁসিটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। গড়িয়াহাটের বণিক পরিবারের গৃহবধূ খুনের মামলার আসামি চন্দ্রনাথের ফাঁসির আদেশ হয়ে গিয়েছিল, পরে রদ হয়। তার ‘ডেমো’, মানে মহড়াতে যেতে নাছোড়বান্দা হয়েছিলেন মহাদেব। নাটা প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না।
ফাঁসি দেওয়ার দিন কয়েক আগে মহড়া হয়। কখনও দু’বার, কখনও কখনও পাঁচ বার। পাঁচ বারের কথায় পরে আসছি। ‘ডেমো’তে বালির বস্তা ঝোলানো হয়, যার ওজন থাকে ফাঁসির ওজন হওয়া মানুষটার সমান। কপিকলের হাতল টানা থেকে ‘দম’ আওয়াজ— সবই পরীক্ষা করা হয়। প্রথম বার ফাঁসুড়ে আর তাঁর সহযোগীরাই শুধু থাকেন। ‘ফাইনাল ডেমো’-তে জেল-সুপার, ম্যাজিস্ট্রেট, মানে যত জন আসল ব্যাপারটায় থাকবেন সবাই হাজির থাকেন, শুধু ফাঁসির দড়ি পরার লোকটি ছাড়া।
মহাদেব বললেন, ‘বাবা তার পর বলল, তোর হাতেই লোকটার প্রাণ চলে যাবে, অথচ তুই তো আর পেশাদার খুনি নোস।’
‘আপনি কী বললেন?
‘বললাম, তুমি তো বলো আমরা নিমিত্ত মাত্র, হুকুমের চাকর। পরোয়ানা হাসিল করা কাজ। তুমি পারছ, দাদু পারত, আর আমি পারব না!’
এর পর নাটা রাজি হয়ে যান। তখন তাঁর এক নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন বড় খোকন। কাজের সময় চোয়াল শক্ত করে শুধু ওস্তাদের হুকুম তামিল করে যেতেন। কাজটা তাঁর কাছে এত সহজ ছিল, যেন গাছ কাটার আগে দড়ি বাঁধছেন। এমনই নির্লিপ্ত ছিল তাঁর ভঙ্গি। নাটা মল্লিক নিজে ছিলেন একটু অন্য রকম, তাঁর কাজের বিবরণ একটু পরে।

Advertisement

২০০৯ সালে মারা যাওয়া নাটা মল্লিক এখনও বিখ্যাত। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার নাম যা-ই হোক, এই রাস্তার অনেকেই ঠিকানা জানাতে বলেন ও লেখেন, ‘নাটা মল্লিকের বাড়ির রাস্তা’।

মল্লিকবাড়ির ঢোকার দরজার ডান দিকে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ, তার চারপাশের টাইল্স-এ শিব, কালীর ছবি। শিবলিঙ্গের নিয়মিত পুজো হয়, পুজো করেন তারক মল্লিক, রিটায়ার্ড সরকারি কর্মচারী, যিনি ফাঁসির দড়ির আশেপাশে নেই, এক বার দেখতে গিয়েছিলেন, তেমন ভাল লাগেনি।

Advertisement

তারক নাটার বড় ছেলে। ছোট ছেলে মহাদেব, বাবার পদাঙ্ক-অনুসারী, যাঁর সঙ্গে ঘরে বসে আমার কথাবার্তা চলছে। ঘরের মধ্যে নাটা মল্লিক এবং তাঁর বাবা শিবলাল মল্লিকের ছবি তো আছেই, তা ছাড়া আলাদা দু-তিনটি ফোটোফ্রেমে বাঁধানো খবরের কাগজের কাটিং, যার সবগুলোতেই নাটা মল্লিকের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি।

শিবলালের ছবির কথা যখন এলই তখন আপাতত তাঁর সম্পর্কে একটি তথ্য— তিনি কয়েকশো ফাঁসি দিয়েছিলেন, সবই অবশ্য স্বাধীনতার আগে, যার জন্য সরকারি টাকা পেয়েছেন আমৃত্যু অর্থাৎ ১৯৭২-এর ডিসেম্বর অবধি। মহাদেবরা তিন পুরুষ ধরে ফাঁসুড়ে, চার পুরুষের সম্ভাবনা নেই কেননা মহাদেবের দুই ছেলে স্কুলে নাইন আর এইটে পড়ে; তারা দাদুর গান, যাত্রা, বক্তৃতার ভক্ত (যেগুলোর ভিডিয়ো রেকর্ডিং বাড়িতে আছে) এবং দাদু-বাবার ফাঁসি দেওয়ার কাজে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়।

হ্যাঁ, ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিক কাওয়ালি গাইতেন। নিজের লেখা গান ‘ইয়ে দুনিয়া মে অপনা কাম করো/ দেশ কা কাম করো’ গাইতে গাইতে কথক ঠাকুরের মতো বিশ্লেষণ করতেন। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির খানিক ক্ষণ আগে বাবার গুনগুনানিতে কান পেতে মহাদেব শুনতে পেয়েছিলেন, ‘জিনা ইঁয়াহা, মরনা ইঁয়াহা/ ইসকে সিবা যানা কাঁহা’।

গুনগুন করাটা নাটার তেমন মুদ্রাদোষ না হলেও ফাঁসুড়েদের, হয়তো বা উত্তেজনা চাপতে, কিছু মুদ্রাদোষ এসে যায়। যেমন ‘গালজ্বলা’র ছিল। গালজ্বলা শিবলালের আমলের ফাঁসুড়ে। তাঁর আসল নাম যা-ই হোক, দুর্ঘটনায় গাল পুড়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর এই নাম হয়েছিল। তিনি ফাঁসির কাজ করার সময়, থেকে থেকেই জ্বলা জায়গাটার ওপর হাত দিতেন আর বিড়বিড় করে কিছু বলতেন।

চন্দ্রনাথ বণিকের ফাঁসি রদ হয়ে যাবার পর মহাদেব পরের কাজ পান ছ’বছর পর, ১৯৯৩-তে। জোড়া ফাঁসির কাজ। সে বারও তিনি বাবার শাগরেদ, কিন্তু কাজের সিংহভাগটাই করেছিলেন। মালদহের কার্তিক শীল আর সুকুমার বর্মনের এক সঙ্গে ফাঁসি। এরা একসঙ্গে এক পরিবারের কয়েক জনকে খুন করেছিল।

‘এক এক করে তাদের ঝোলানো হল?’ আমি শিউরে উঠি।

‘না একসঙ্গে। তাদের ‘রেডি’ করে, ফাঁসির দড়ি পরিয়ে পাশাপাশি দুটো পাটাতনের ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। সে কাজগুলো করেছিলাম বড় খোকনকাকা আর আমি। বাবা হ্যান্ডেল টানল, পাটাতন সরল, প্রায় একসঙ্গে দুটো ‘দম’ আওয়াজ। মিনিট পনেরো বাদে তলা থেকে ওদের দেহ দুটো বার করে আনা হল, ডাক্তার পরীক্ষা করল, ব্যস কাজ শেষ।’ ভাবলেশহীন মুখে জানালেন মহাদেব।

‘এইখানে আমি আরও একটা কাজ করেছিলাম। মোম, মাখন আর কলা দিয়ে দড়ি পালিশ করা। বাবা বলেছিল, যেখান থেকে আসে সেখানেও এ সব করে পাঠানো হয়। তবে সাবধানের মার নেই।’

হ্যাঁ, ভারতবর্ষের বক্সার জেলে ফাঁসির দড়ি তৈরি হয়। ১৯৩০ সাল থেকে এটা চলে আসছে। সূর্য সেনের ফাঁসির দড়ি এখান থেকে এসেছিল এবং ক্ষুদিরাম বসুর বেলায় আসেনি। সূর্য সেনের ফাঁসি হয় ১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪ আর ক্ষুদিরামের ১১ অগস্ট, ১৯০৮। এঁদের কথা কেন বললাম, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এই দড়িগুলো তৈরি করেন জেলের কয়েদিরাই। ফাঁসির দড়ি তৈরির মেশিনে জনা কয়েক মিলে এই কাজ করেন। অর্থাৎ, কয়েদিদের তৈরি দড়িতেই অন্য কয়েদির ফাঁসি। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ‘ফাঁসুড়ে’ বলে কোনও আলাদা পদ নেই। সেখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে থাকা কয়েদিদেরই শিখিয়ে পড়িয়ে ফাঁসি দেওয়ানো হয়। এর জন্যে তাঁরা মেয়াদ খাটার ক্ষেত্রে কিছু ‘ছুট’ পান।

‘তার মানে জোড়া ফাঁসি দেওয়া আপনার মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি? এত কঠিন মন আপনার?’ মহাদেবকে না জিজ্ঞেস করে পারি না।

‘দূর... তা নয়। কাজের প্রায় সাত দিন আগে থেকে ঠিকমত খেতে-ঘুমুতে পারিনি। দিনের দিন মনের অবস্থা আর এক রকম। ভেতরে ছটফটানি, কত ক্ষণে কাজটা শেষ করব এই চিন্তা। পুরো কাজটা যন্ত্রের মতো করে গেলাম, তার পর ‘দম’, মানে পড়ে যাওয়ার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বুকে ব্যথা ঢুকে গেল, কেমন যেন কান্না পেয়ে গেল।’

‘আচ্ছা, ফাঁসি দেওয়ার পরে ফাঁসুড়েরা তো কখনও কখনও অসুস্থও হয়ে যান।’

‘বাবা কখনও হয়নি। কিন্তু সূর্য সেনের ফাঁসির পর দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তেমন ভাবে আর কাজে ফিরে আসতে পারেননি।’

সূর্য সেন এবং ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির সময় শিবলাল ছিলেন। ক্ষুদিরামকে চিনতেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে হাতল টানতে হয়নি। এক জন ইংরেজ টেনেছিলেন। তাঁকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন শিবলাল। ফাঁসির দড়িটাও তৈরি করেছিলেন।

সূর্য সেনকে প্রথমে চিনতে পারেননি। তাঁর গাল দাড়িতে ভরে গিয়েছিল। যখন কাছটায় যান, চিনতে পেরে বলে উঠেছিলেন, ‘না, আমি পারব না।’ মাস্টারদা বলেছিলেন, ‘তোমার কাজ তুমি করো।’

মহাদেব ছোট বয়সে দাদুর কাছে এ সব কথা শুনেছিলেন। তাঁরও ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। হ্যাঁ, ফাঁসুড়েদেরও কষ্ট থাকে। যেমন পবন জল্লাদের কথা বলা যাক। পবন জল্লাদের নিঠারির খুনি সুরিন্দর কোলিকে ফাঁসি দেওয়ার কথা ছিল। মহাদেব যেমন নাটা-র, পবন তেমনই মাম্মুর সন্তান।

মাম্মু জল্লাদ ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন আফজল গুরু আর আজমল কসাবকে, তাঁর দাদু রামরাখের একটি ফাঁসি দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত করতে। রামরাখ ভগৎ সিংহের ফাঁসি দিয়েছিলেন। মাম্মু অবশ্য আফজল আর কসাবকে ফাঁসি দিতে পারেননি, কারণ এদের ফাঁসির আগেই তিনি মারা যান। এদের ফাঁসি তদারকিতে ছিলেন বাবু জল্লাদ, যিনি ইয়াকুব মেমনের ক্ষেত্রেও একই দায়িত্বে ছিলেন।

মাম্মুর বাবা কাল্লুরামের মাথাতেও বাবার ভগৎ সিংহকে ফাঁসি দেওয়ার কথাটা ছিল। তাই তিনি ইন্দিরা গাঁধীর হত্যাকারী সতবন্ত সিংহ ও কেহর সিংহকে ফাঁসি দিয়ে নাকি খুশি হয়েছিলেন। কাল্লুরাম কুখ্যাত অপরাধীদ্বয় রঙ্গা-বিল্লারও ফাঁসি দিয়েছিলেন।

নাটা মল্লিক মোট পঁচিশটা ফাঁসি দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে কুড়িটা, পরে পাঁচটা। শেষ ফাঁসি দেওয়া ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে, ২০০৪ সালে।

‘তখন বড় খোকন কাকা মারা গেছেন, আমি বাবার ডান হাত। পাঁচটা ‘ডেমো’ হয়েছিল।’ মহাদেব বলেন।

‘পাঁচটা ডেমো?’

‘সব কিছুই ছিল কী রকম এলাহি ব্যাপার। দলে দলে টিভি, খবরের কাগজের লোক। জেলের বাইরে পটাপট ছবি তোলা হচ্ছে, অনেকের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে, কেমন যেন একটা উৎসবের মতো। কাগজে রোজ খবর বেরুচ্ছে ধনঞ্জয় কী করছে, কী খাচ্ছে। কী করে খবরগুলো পাচ্ছে রিপোর্টাররা, আমি আর বাবা ভেবে পাই না। তার মধ্যেই এক দিন এক কাণ্ড করলেন এক রিপোর্টার।

‘কী কাণ্ড?’

‘বাবার কাছে এসে হাজির। অ্যাসিস্ট্যান্টদের দলে ভিড়ে ফাঁসি দেখবেন। যেমন পোশাক পরতে হবে তেমন পরবেন। দরকারে সারা গায়ে মদ ছিটিয়ে নেবেন।’

‘নাটা মল্লিক রাজি হয়েছিলেন?’

‘পাগল! বাবা বলল, আপনি কি আমাকে জেলে ভরতে চান? তা ছাড়া একটা লোকের এ ভাবে মৃত্যু দেখে কী করবেন?’

‘তার পর?’

‘‘তিনি নাছোড়বান্দা, ‘না, একটু দেখতাম।’ বাবা তাঁকে এক রকম তাড়িয়েই দিলেন। দেখুন, আমরা ফাঁসুড়ে হয়েছি পেটের তাগিদে। তা ছাড়া কাউকে না কাউকে তো সরকারের দেওয়া কাজটা করতে হবে। আর এঁরা মজা পাচ্ছেন! ভাবুন, একটা লোক যত অপরাধীই হোক না কেন, তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তা দেখতেও এত আগ্রহ! এরা মানুষ!’

এই প্রথম মহাদেব মল্লিককে বিষণ্ণ হতে দেখি।

mallikabikash@yahoo.co.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement