Partition of Bengal

হৃদয়ের গভীরে আজও অমলিন সোনার বাংলা

অথচ তাঁদের শিকড় রাজস্থানে। হাল সাকিন কলকাতায়। ও-পার বাংলায় তাঁর মাতৃভূমি। বাংলাদেশের নামে আজও আবেগে ভাসেন সল্ট লেকের ধর্মনিষ্ঠ মারোয়াড়ি বধূ ও তাঁর পরিজন।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৪ ০৫:০৩
Share:

বানান করতে হবে, প্র-ত্ন-ত-ত্ত্ব-বি-দ!

Advertisement

“কে পারবি বানানটা ঠিক করে বল?” ফরিদপুরের জিলা স্কুলে ক্লাস ফোরের ছেলেদের মাঝে ঘুরে ঘুরে মাস্টারমশাইয়ের বাজখাঁই কণ্ঠ যেন পাক খাচ্ছে। বানান বলতে গিয়ে ভুল করে তত ক্ষণে অনেকেই বাংলার স্যরের ধমক খেয়েছে। শেষমেশ কোণের বেঞ্চিতে বসা মারোয়াড়ি ছেলেটার দিকে নজর পড়ল শিক্ষকের।

“কী রে, বানান করতে পারবি তুই? বল, দেখি কেমন শিখেছিস?”

Advertisement

আজ থেকে কমসে কম ৬৩-৬৪ বছর আগের কথা। পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদপুরে নিজের স্কুলবেলার গল্প বলতে বলতে ৭৪ ছুঁই-ছুঁই শম্ভু বাগাড়িয়া যেন নিমেষে সেই ক্লাস ফোরের বালক হয়ে ওঠেন। “কী হল, বিশ্বাস করবেন! গোটা ক্লাস সে দিন ওই বানান বলতে ফেল মেরে গেসে! একমাত্র আমি একটু থতমত খেয়ে ঠিক বানানটা বলে দিলাম। বাংলা এখনও কিস্যু ভুলিনি। এই তো দেখুন, প য়ে র-ফলা, ত য়ে ন-ফলা…ত, ত য়ে ত য়ে ব ফলা… ঠিক হইসে না!”

অধুনা কলকাতার বাঙুরের বাসিন্দা শম্ভু বলতে থাকেন, “তার পর সে এক কাণ্ড! সার বলে, ও একটা মারোয়াড়ি ছেলে হয়ে পারল, আর তোমরা পারলে না! আমার পাশে নাসির না জামাল কে বসেছিল, তারে দেখিয়ে বলে, ‘ধর, ওর কান ধর!’ আমি বলছি, না সার পারব না! সার বলে, ‘ধরতেই হবে!’ আর বন্ধুগুলা কটমট করে আমার দিকে চায়, ‘অ্যাই, কান আস্তে ধরবি বলছি!’”

পাঁচ দশক আগে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসা শম্ভুর লব্জে এখনও জলজ্যান্ত বাংলাদেশ ঝকমক করছে। কলকাতার বাংলা নয়, পূর্ব বাংলার টানটাই স্পষ্ট। শম্ভুর ভাইঝি সোনিয়া চৌধুরী আগেই বলেছিলেন, “আমার কাকার বাংলা শুনলে আপনি মারোয়াড়ি বলে বুঝতেই পারবেন না! একেবারে বাংগালিদের মতো ‘মাইরি, মাইরি’ করে কথা বলে! আর কাকার বন্ধু নাসির কাকা, জামাল কাকারা ছিল আমাদের ফরিদপুরের বাড়ির প্রাণ! এখনও ফোনে শম্ভুকাকার সঙ্গে ওদের কথা শুরু হলেই পুরা ‘শালা, ব্যাটা’ বলে গালাগালি দিয়ে আড্ডা জমে ওঠে! আমরা বোনেরা শুনে কুটিপাটি হাসি!”

বছর দশেক আগে সোনিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ, উত্তর কলকাতার কাশী বোস লেনের সাবেক পুজোয়। সম্ভবত নবমীর ছাপ্পান্ন ভোগের প্রসাদ খেতে গিয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুগ্গাঠাকুর এ কালে কাশী বোস লেনেই ভোগ খেতে আসেন! বাঙালি এবং মারোয়াড়ি রন্ধনকলার মিশেলে কলকাতার দুগ্গাপুজোয় এমন চমৎকার ভোগের আস্বাদ সত্যি এক অভিজ্ঞতা। তবে সে প্রসঙ্গ আজকের জন্য নয়। ফরিদপুরে সোনিয়ার বাপের বাড়ির গল্পও তখনই শুনতে পাই! সোনিয়া কাশী বোস লেনের পুজোর প্রবীণ কুলপতি, অধুনা প্রয়াত গোবিন্দরাম চৌধুরীর বৌমা। গোবিন্দরাম বলতেন, “এ আমার বঙ্গালি বহু!”

সোনিয়ার ফরিদপুরেই জন্ম, সদ্যোজাত বাংলাদেশে! ক্লাস এইট পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করে কলকাতায় এসেও বাংলা মাধ্যমেই ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলায় লেখা কোনও চিঠি পড়ার দরকার হলে গোবিন্দরাম তাঁর ‘বঙ্গালি বহু’কেই ডেকে নিতেন।

গত এক দশকে গঙ্গায়, পদ্মায় কম জল গড়ায়নি! দুই বাংলার সম্পর্ক মোটেও চিরবসন্ত মধুমাসে স্থিত হয়ে নেই। কিন্তু সোনিয়া আর তাঁর পরিবারের বাংলাদেশ-কাহিনি বরাবরই অশান্ত সময়ে স্নিগ্ধ শীতলপাটির প্রলেপ বয়ে এনেছে। কখনও কোনও তিক্ততার ছাপ পড়লেও তা মূল সুরের তাল কাটতে পারেনি। গত বছর দেওয়ালির ক’দিন আগে সল্ট লেকে সোনিয়াজির শ্বশুরবাড়িতে, ওঁর একাদশীর উপোসের দিনে নানা গল্প হচ্ছিল। বলছিলেন, “আমিও তো বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসার পরে মোটেও ভাল হিন্দি বলতে পারতাম না। ঘরে মারোয়াড়ি ভাষা আর সারা দিন বন্ধু হাসিনা, জাহিদা, কাকলী, সায়রা বানুদের সঙ্গে বাংলা! হিন্দি কোন দুঃখে বলতে যাব!” বাংলাদেশ আজও আক্ষরিক অর্থেই তাঁর মাতৃভূমি।

সোনিয়ার মা, মাঝসত্তরের জানকী দেবী ফরিদপুরে থাকেন। ইন্ডিয়ায় ছেলে বা মেয়েদের বাড়ি ঘন ঘন বেড়াতে আসেন। কিন্তু কিছু দিন বাদেই নিজের বাসায় ফিরতে অস্থির! সোনিয়া বলেন, “আমার মায়ের হিন্দিও বাংলাদেশি টানের।” এ পরিবারের বাংলা-প্রীতি নিয়ে অজস্র মজার গল্প! সোনিয়ার কাকা শম্ভুকেও কলকাতায় আত্মীয়-কুটুমরা মজা করে ‘শালা বাঙাল’ বলে খেপাতেন! শম্ভু বলেন, “আমিই বা কেন ছাড়ব! শুনিয়ে দিয়েছি, শালা তুমি নিজে কী? ব্যাঙ্গলে ব্যবসা করো, আবার যত নকশা…”

অথ মারোয়াড়ি কথা

মারোয়াড়িরা না কি মরুদেশের মানুষ। তবে নিছকই পশ্চিম রাজস্থানের ঊষর মরুভূমির দেশ নয়। গোটা রাজস্থান, লাগোয়া হরিয়ানার কিছু জেলা ছেড়ে বেরিয়ে তাঁদের ভারত-জয়ের সূত্রপাত। আর তাঁদের বঙ্গযোগ খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে সেই আকবরি আমলে। বঙ্গদেশের শাসক সুলেমান কররানিকে শায়েস্তা করতে মোগল বাদশা আকবর সেনা পাঠালেন। সেই সেনাদের রসদদার হিসেবেই প্রথম মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর বাংলায় আগমন ঘটে বলে শোনা যায়।

বাংলার ইতিহাসে বহুচর্চিত মুর্শিদাবাদের জগৎ শেঠদের প্রসঙ্গও এ লেখার বিষয় নয়। তবে উনিশ শতক থেকে কলকাতাই মারোয়াড়িদের বিশেষ পছন্দের। সম্ভবত এখানে বোম্বাইয়ের তুলনায় গুজরাতি, সিন্ধি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম বলে। প্রাক্-দেশভাগ কালে পূর্ববঙ্গেও তাঁরা ভালই ছেয়ে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, ১৯৬০-এর দশকের গোড়াতেও পূর্ব পাকিস্তানে পাট কারবারের শতকরা ৬০ ভাগ মারোয়াড়িদের হাতে ছিল। শান্তিতে ব্যবসার আবহ। পাসপোর্ট দেখিয়ে টুক করে ঢুকে ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখে ফেরা। স্কুলে ছোটরা পাকিস্তানি জাতীয় সঙ্গীতে ধাতস্থ। ১৯৬৫ ও ১৯৭১-এর যুদ্ধের হাওয়ায় সেই সুখের দিন তছনছ হল। বেশির ভাগ মারোয়াড়ি পূর্ববঙ্গ ছাড়লেও কেউ কেউ এখনও থেকে গিয়েছেন। সংখ্যাটা কমছে। কিন্তু কলকাতার চিনা, পার্সি, ইহুদি, আর্মেনীয়দের মতো বাংলাদেশের শ’আটেক মারোয়াড়িও সে-দেশের বৈচিত্রের স্মারক।

ফরিদপুরের চকবাজারে সোনিয়াদের পারিবারিক বাসাবাড়ির সামনের রাস্তাটার নাম এখন রামকৃষ্ণ আগরওয়ালা সড়ক। তাঁর পরিচয়, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক। বাসার পাশে কুমার নদের খালের ঘাটেও রামকৃষ্ণের ছবি। ফরিদপুরে বন্ধুমহলে তিনি আবার রামিয়া। সোনিয়ার বাবা, শম্ভুর মেজদা রামকৃষ্ণ আগরওয়াল জীবনের শেষ পর্যন্ত দাদা, পরদাদার আপন করা ভূখণ্ডকেই আঁকড়ে ছিলেন। সোনিয়ার মনে আছে, বোধহয় ২০০৯-১০ সাল নাগাদ শেষ বার ফরিদপুরের চকবাজারের বাসায় সব আত্মীয়-কুটুমকে নিয়ে বসেছিল তাঁদের ‘এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’! তার ঢের আগেই ওঁরা চার বোন, অগ্রজ উত্তম বাগাড়িয়া, কাকা, পিসিরা ইন্ডিয়ায় ব্যবসা বা সংসারে থিতু। শুধু সোনিয়ার মা-বাবা, বুড়োবুড়িই বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন। ফরিদপুরের বাসায় বাবা চোখ-জুড়োনো লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বলে রাখা ভাল, আদতে রাজস্থানের ঝুঝনু জেলার বাগাড়ের মাটির এই পরিবার আগরওয়াল বর্গভুক্ত হলেও বাগাড়িয়া পদবিটি ব্যবহার করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সাধারণত মারোয়াড়ি মানেই তিনি আগরওয়ালা।

একদা বর্ষায় উপচে-ওঠা কুমার নদকে এক ধারে রেখে ফরিদপুরে আগরওয়ালদের শতাধিক বছরের পুরনো বসতবাড়িটি আজও মস্ত জায়গা জুড়ে। শম্ভু বলেছিলেন, “বাংলাদেশে আমাদের ফ্যামিলি ফেমাস ছিল! সিমেন্ট, লোহা, কাপড়, চিনি, টিনের পাত... কত কিছুর কারবার।” সোনিয়ার সারা ক্ষণ চোখে ভাসে, বাপের বাড়ির দোতলার ছাদে চড়ুইপাখির জল খাওয়ার আধার বা দিওয়ালির রাশি রাশি পাঁপড়ের আটা মাখার ধুমধাম! মস্ত আঙিনা-ঘেরা বাসাবাড়ির এক দিকে একতলায় পর পর ঘর। পিছনে দু’তলা। রামকৃষ্ণ গত হওয়ার পরে সোনিয়ার দাদা উত্তমকে পারিবারিক দুর্গাপুজো সারতে বছরে এক বার ফরিদপুরে যেতেই হয়। পারিবারিক সুহৃদ প্রলয়দা, রাজুদারা ব্যবসা সামলান। মাকে দেখেন। গোশালার গরুগুলো তাদের অভিভাবক খালেক ছাড়া কারও কথা শুনবেই না। সোনিয়ার বাবার প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী, নারায়ণের মন্দিরে শিব, গণেশ, হনুমানও পুজো পান! এই আগরওয়াল-কাম-বাগাড়িয়াদের পারিবারিক শিকড়ের থান ঝুঝনুর রানি সতী দাদি কিংবা রাজস্থানের খাটুর খাটুশ্যামের মতো মারোয়াড়ি লোকদেবতারাও বাংলাদেশে সুখে আছেন। তাঁদেরও সযত্ন আয়োজনে নিজের মন্দিরে বসিয়েছেন রামকৃষ্ণ।

মুক্তিযুদ্ধের দিনে

এতগুলো দশকের সবটাই খুব মসৃণ হয়তো কাটেনি। তবু উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অভিযাত্রারও শরিক হয়েছেন বাগাড়িয়ারা। মেয়েদের মনে পড়ে গোটা ফ্যামিলি জড়ো হলেই বাবা বলে উঠবেন, “তোরা কী সব গদর-টদর উল্টাপাল্টা বই দেখিস! আমি ওর থেকে অনেক বড় কাণ্ড লাইভ দেখেছি!”

সেই শুনে সোনিয়ার চাচিরা ভাশুরঠাকুরের পিছনে লাগতেন, “এই রে! আবার বাংলাদেশের গল্প শুরু হবে!”

সোনিয়ারা চার বোন, পিসিরা, একজোট হলেও সেই এক গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গড়পড়তা বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের মতো এই মারোয়াড়িরাও ইতিহাসের ঝড়ঝাপটা সয়েছেন। সোনিয়ার ঠিক উপরের দিদি ববিতা— এখন পদবি দিওয়ান, আলিপুরে থাকেন— কলকাতার নামী জুয়েলারি পরিবারের বধূ। তাঁর ন’দিন বয়সে একরত্তি মেয়েকে নিয়ে গোটা পরিবার ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সন্তর্পণে ইন্ডিয়া পাড়ি দেয়। পৌঁছতে দু’মাস লেগেছিল। সোনিয়া বলেন, “আমার উল্টোডাঙার পিসি পুষ্পার কোলে ছিল মেজদি (ববিতা)! পিসি এখনও হুবহু বলে কী ভাবে একটা খাল পেরনোর সময়ে ববিতা ওর হাত থেকে ছুটে গেছিল। খালে কতটা জল কেউই বুঝতে পারেনি! হাত উঁচু করে দুধের বাচ্চাকে সামলে খাল পেরোতে গিয়েই হোঁচট! ভাবুন, সবার কী টেনশন… বাচ্চা পড়ে গেছে, খোঁজ খোঁজ! দেখ বেঁচে আছে কি না… ভাগ্যিস দিদিকে তখনই পাওয়া যায়!”

ইতিহাসের তাৎপর্য-মাখা, এই পারিবারিক কাহিনি বার বার বলার পরে সোনিয়ার পিসি পুষ্পা ববিতাকে অবধারিত হাসতে হাসতে বলবেন, “বাপ রে বাপ, তুই যদি ওই দিন মারা যেতিস, আমার যে কী-ই অবস্থা হত!”

সোনা আর রতন

শম্ভুর মনে আছে, কুখ্যাত সামরিক শাসক টিক্কা খানের অত্যাচারে কী ভাবে ফরিদপুরের মতো শান্ত শহরটাও নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। কিন্তু স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমে অবিশ্বাসের ফাটল ধরেনি। “শহরে মিলিটারি এন্টার করসে দেখে আমরা হেঁটে, নৌকা পেরিয়ে টাউন থেকে ভিতরে ফকিরপাড়ায় চলে যাই! তখন স্থানীয় মুসলিমদের কাছেই শেল্টার পেয়েছি।” ঢাকা জেলার জয়পাড়ায় দূর সম্পর্কের আত্মীয়ঘরে বেশ ক’টা দিন পরিবারের মেয়ে-বৌদের নিয়ে থাকতে হয় সদ্যতরুণ শম্ভুকে। বড়দা, মেজদারা তখন আরও ক’জনকে নিয়ে কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা হয়ে জলঙ্গী দিয়ে ইন্ডিয়ার পানে গিয়েছেন!

শম্ভু জানালেন, “অ্যাট দ্যাট টাইম, মোবাইল বলে কিছু ছিল না! দাদারা সাত দিনে ফিরে আসব বলে কোনও খবর নাই! আমরা তো ধরেই নিয়েছি, স্লটারিং হয়ে গেসে! ২২-২৩ দিন বাদে হঠাৎ রাত তিনটায় ফিরে মেজদা আমার বাবারে জড়ায়েধরে বাচ্চার মতো কেঁদে উঠলেন! সিনটা এখনও দেখতে পাই!” স্মৃতি ঠেলে শম্ভু বলেন, “এর কিছু দিন বাদে আমরা কয়জন কৃষ্ণনগরের কাছ দিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকি! তবে সোনা আর রতন না-থাকলে সেটা সম্ভব হত না!” ওই দুর্দিনে স্থানীয় দুই মুসলিম যুবা যেন বুকে করে পরিবারটিকে আগলে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছনোর ব্রত নিয়েছিলেন। সেই রাতটা শুধু ঝোপ, খাল, বিল পেরিয়ে হাঁটা আর হাঁটা! সারা ক্ষণ মিলিটারি, রাজাকারের ভয়! সোনা, রতনেরা বোঝাচ্ছেন, থামা ঠিক হবে না! সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ শম্ভুর মনে হচ্ছিল, এ বার প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে! “আমার বাবা, ছোট ভাই, বোনেরা এগিয়ে গিয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম আমি! আর উঠতে পারছি না! তখনই ওই সোনা তার পাহাড়ের মতো চেহারায় আমায় নিজের কোলে তুলে নিল! কোনও দিনও ভুলতে পারব না, ওর কথাগুলি।” শম্ভু লজ্জা পাচ্ছেন দেখে ওঁকে কোলে নিয়ে এগোতে এগোতে সোনা বলেন, “আমার জান থাকতে কিছু ভাববেন না, আগে আমি মরব, তার পর যা হওয়ার হবে!”

শম্ভু শুনেছেন, পরে গ্রামে রাজাকারদের হামলায় সোনার প্রাণ যায়। রতনের খবর অনেক চেষ্টাতেও পাননি। তবে সেই সকালটা এখনও নিজের পুনর্জন্মের মনে হয়। বৃদ্ধের দু’চোখ চিকচিক করে, “ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ জীবনে কম দেখলাম না! এমন ফেরেশতার মতো মানুষ কখনও দেখি নাই!” বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সঙ্গে রক্ত ঝরানোর বন্ধনের কথা বলেন। এই মারোয়াড়িদের পারিবারিক ইতিহাসে, ছোটদের কাছে বড়দের বলা গল্পে সোনা-রতন নাম দু’টি প্রাণের বন্ধনে চিরতরে গাঁথা হয়ে থাকে।

সোনিয়া ও হাসিনা

মুক্তিযুদ্ধের ঝড় থামলে রামকৃষ্ণ বাগাড়িয়ার সন্তানেরা পরে এক শান্ত বাংলাদেশে সবাইকে কাছে-টানা অবিস্মরণীয় ভালবাসার স্বাদ পেয়েছিলেন। প্রিয় সখী হাসিনার সঙ্গে এখনও কিছু দিন অন্তর ফোনে কথা না-হলে শান্তি নেই সোনিয়ার। ফরিদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহপাঠিনী হাসিনা শোনান, “টিফিনে সোনিয়ার পরোটা, আচার আমরাই লুঠ করে নিতাম! ওর কত দিন খাওয়াই হত না। ফরিদপুর নিউ মার্কেটের কাছে সোনিয়াদের বাসায় গেলেও মাসিমা পাঁপড়, নাড়ু, ওদের নিজেদের গরুর দুধের মিষ্টি খাওয়াবে! স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে এমন পারিবারিক সম্পর্ক আমি তো আমার মেয়েদের স্কুলেও দেখি না।”

ক্লাস এইটের পর সোনিয়া কলকাতায় হেদুয়ার কাছের স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু সহপাঠী, বন্ধুদের সঙ্গে এমন আন্তরিক সম্পর্ক আর গড়ে ওঠেনি!

সব থেকে মজার কথা হল, এ সম্পর্কের টান এত বছরেও পাল্টায়নি ছিটেফোঁটা। সোনিয়া ফরিদপুরে গেলে দেখা করতে ঠিক আসবেনই সকন্যা হাসিনা বা ফরিদপুরের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস, বন্ধু সামসুন্নাহার জলি। হাসিনা, জাহেদারা কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে এলেও সব কিছু বন্দোবস্ত করার ভার সোনিয়ার উপর। সোনিয়াদের এক পারিবারিক বন্ধুর ছেলে ইমরান, ওরফে বাকু এখন পাইলট। এক বার স্রেফ ওঁর সঙ্গে দেখা করতেই কলকাতায় হাজির তিনি! এসেই বায়না, ওখানে চল, এটা খাওয়া, সেটা খাওয়া! সোনিয়া বলেন, “কী-ই যে মজা হল, বাকুকে হাওড়া ব্রিজ, কোয়েস্ট মল সব ঘুরিয়ে দেখালাম। একটাই কথা বলেছিলাম, ভেজিটেরিয়ান খাবার খেতে হবে! মনে পড়ছিল, ছোটবেলায় আমরা সপরিবার ওদের বাড়ি খেতে গেলে সব সময়ে কত যত্নে আলাদা করে নিরামিষের বন্দোবস্ত করত!”

মেলামেশার এই খোলা আকাশ না থাকলেই বোধহয় মানুষে মানুষে এত তিক্ততা গড়ে ওঠে, মনে করেন সোনিয়া। নিষ্ঠুর বাস্তব বলে, উপমহাদেশের এ প্রান্তে কোনও অঘটন ঘটলে বরাবরই অন্য প্রান্তে তার ছায়া পড়ে। আমাদের দুর্ভাগা খণ্ডিত জাতিকে বার বার যুগে যুগে তার খেসারত দিতে হয়। তবু জীবনের বেশির ভাগটা ভারতীয় নাগরিক পরিচয়ে কাটিয়েও বাংলাদেশের নামে ভিতরটা মোলায়েম না হয়ে পারে না সোনিয়ার!

অযোধ্যায় পারিবারিক গুরুদেবের আশ্রমে যজ্ঞের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তিনি। আবার বরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে ছবি দেখে এসে বলছেন, “হল-এ ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনে বুকের ভিতরটা যে কী হচ্ছিল আমার… এখানে তো এ গানে কেউ উঠে দাঁড়ায় না, কিন্তু আমার কাছে গানটা আজও আলাদা।”

বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছে। সোনিয়ার ভাশুরপো লোকেশের দুই খুদে পুত্তুর এসে জিজ্ঞেশ করে, “দাদি কৌন সা টিম? ইন্ডিয়া ইয়া বাংলাদেশ!” সোনিয়া হাসেন, “আমি ওদের বলি, বাংলাদেশ! তখন নাতিরা আমায় রাগায়, বাংলাদেশ হার গিয়া!”

শম্ভু ও নাসির

ক্রিকেটে ইন্ডিয়ার হার নিয়ে বাংলাদেশের টিটকিরিতে অবশ্য শম্ভু হাড়ে চটেছেন। রেগে বলেন, “ইন্ডিয়া হারলে টিটকারি মারাটা ওরা শিখসে তো পাকিস্তানের কাছে!”

তবে ইডেনে গত বিশ্বকাপেই নাসির এসে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের ক্লাব হাউসের টিকিট ধরালে আপত্তি করতে পারেননি! পাকিস্তান আমলেও দুই বন্ধু পাসপোর্ট হাতে ঢুকে ইডেনে কত টেস্ট দেখেছেন! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একপেশে খেলায় বন্ধুর আশাভঙ্গে মনখারাপই হচ্ছিল শম্ভুর। নাসির, জামালদের কথা বলতে গর্বে বুকের ছাতি ফোলে তাঁর, “নাসির তো ১০০০ কোটির মালিক হবে! শুগার মিল, সিমেন্ট, টাইলস ফ্যাক্টরি! আর জামালের মাকে সবাই বলত রত্নগর্ভা! ওরা ন’টা ভাইবোন, সবাই হাইলি এডুকেটেড। নাসিরের ভাই হাসান সাবকন্টিনেন্টের সেরা স্টুডেন্ট। আমেরিকায় বিরাট ডাক্তার।”

এই বন্ধুদের কাছে জীবনের প্রাপ্তির বহর বলতে শম্ভুর গলা বুজে আসে, “সে বার ঢাকায় যা খাতিরদারিটা করল!” বাসের মাঝখানের একটা প্যাসেজ শম্ভু এবং তাঁর স্ত্রীর জন্য ছেড়ে দেন নাসিরেরা। থাকা-খাওয়ার এলাহি ব্যবস্থা! দারুণ সব ভেজিটেরিয়ান ফুড। নাসিরের ওয়াইফ বলে, “শম্ভুদা আপনি আইসেন বলেই এমন গ্যাদারিংটা আমরা পাইলাম! আবার আসুন!”

শম্ভু বলেন, “নাসিরের ছেলে কানাডায় থাকে। চাইনিজ় মেয়ে বিয়া করসে! আমার স্ত্রীর অসুস্থতায় ওর বিয়ার দাওয়াতে যেতে পারিনি! মনটা খুব খারাপ হয়েছিল।”

ফরিদপুরের বাড়িতে এই নাসির, জামাল, আতিয়ারদের ঘরের ছেলের মতো দেওয়ালির মাটির প্রদীপের সলতে পাকাতে আর পাঁপড়ের আটা মাখতে বসিয়ে দিতেন শম্ভুর ভাবি, সোনিয়ার মা জানকী। শম্ভু বলেন, “এদের পাল্লায় পড়ে আমি আন্ডা তক খা লিয়া থা! তবে আর কিছু খাইনি!” রমজানে বন্ধুদের ইফতারির অপূর্ব পিঁয়াজু, ছোলার স্বাদও এত দিন বাদেও শম্ভুর মুখে লেগে থাকে!

অলৌকিক দেশ

আজ এত বছর বাদে ইউক্রেন, রাশিয়া, ইজ়রায়েল থেকে এই উপমহাদেশ— গোটা পৃথিবীর হালই শম্ভুকে ব্যথিত করে। বলেন, “দেখুন, আমাদের বন্ধুদেরও সবার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস এক ছিল না। কিন্তু নিজেদের সম্পর্কে আজও পলিটিক্স ঢুকতে দিই না! হিন্দু-মুসলিমে কিছু ফারাক হয়তো আছে। তবে সাধারণ মানুষ ঝগড়া চায় না, মিলেজুলে থাকতে চায়। রায়ট মুষ্টিমেয় লোক বাধায়। সেটাই ফ্ল্যাশ হয়! আমাদের ভালবাসার গল্পগুলি শুনা যায় না!”

তাঁদের ফরিদপুরের বন্ধু, অধুনা কোন্নগরবাসী কমল দাস, ওরফে বুড়োর একটা কথা এখন বার বার বলেন শম্ভু! “বুড়ো আমায় বলেছিল, আমরা ছেলেবেলার যে জীবন ফেলে এসেছি, কোটি টাকা দিলেও তা আর ফিরে পাব না, বুঝলি!”

শম্ভুর ভাইঝি সোনিয়া সংসারে ব্যস্ত গৃহবধূ। হেঁশেল, ঠাকুরঘর, সন্তানদের মঙ্গলকামনায় জীবন কাটে। তাঁরও মনে হয়, ফরিদপুরে ওঁদের ছোটবেলার সেই জীবন, ওঁর মেয়ে হয়তো বা লন্ডনে এমবিএ করতে গিয়ে কিছুটা বুঝেছে। তবু সেই পুরনো মাধুর্য খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

আচারনিষ্ঠ মারোয়াড়ি বধূ তথা ফরিদপুরি কন্যা হঠাৎ বলে ওঠেন, “আমায় যদি বলা হয় আশপাশে শুধু মারোয়াড়ি থাকবে, ভাল লাগবে না। আমার বাঙালিও চাই, মারোয়াড়িও চাই, হিন্দুও চাই, মুসলমানও চাই, সব চাই! আমি এ ভাবেই থেকেছি! এখন আমি একা থাকতে পারব না।”

শম্ভু বিশ্বাস করেন, হিন্দুরা হিন্দুদের কালচার নিয়ে গর্ব করবে, মুসলিমরাও নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাববে, এটা ঘটেই থাকে। কিন্তু এ উপমহাদেশের ভিতরে একটা জাদুও আছে। বৃদ্ধের ক্লান্ত চোখে আলো ঠিকরে পড়ে যখন বলেন, “আমাদের এই দেশটা আসলে অলৌকিক, জানেন! না হিন্দু, না মুসলিম, না শিখ, না ঈশাই— কেউ একে একা সৃষ্টি করেনি, সকলে মিলে করেছে! কোনও একটা জিনিস এত বিউটিফুল হতে গেলে কারও একার চেষ্টায় হওয়া সম্ভব নয়।”

এ দেশ কিংবা উপমহাদেশের ক্রান্তিলগ্নে এমন কিছু বিশ্বাস বা জীবন কি চার পাশের চিৎকারে একটু বেসুরো শোনাল? পতন-অভ্যুদয়ের পথে যুগ-যুগ-ধাবিত যাত্রীরাই হয়তো এর জবাব জানেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement