Dinosaur

রবীন্দ্রনাথের নামে নাম রাখা হল ডাইনোসরের

বাঙালির ডাইনোসর চর্চা শুধু গল্পকথা নয়। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের ফসল। কিন্তু ‘ডাইনোসর আর রবীন্দ্রনাথ’ বললে? মেলানো মুশকিল বটে। কিন্তু সত্যি মিলেছিল এই দুই।

Advertisement

পৃথা কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০০:০০
Share:

বাঙালির ডাইনোসর চর্চা বললে বেশির ভাগ মানুষেরই মনে পড়বে সত্যজিৎ রায়ের ‘টেরোডাকটিলের ডিম’, প্রফেসর শঙ্কুর ‘কঙ্গো অভিযান’ আর নব্বইয়ের দশকে সপরিবারে, কচিকাঁচা-সহ বড় পর্দায় ‘জুরাসিক পার্ক’, ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ দেখতে যাওয়ার স্মৃতি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘ডাইনোসর’ আর ছোটবেলায় ‘আনন্দমেলা’, ‘শুকতারা’-র মতো পত্রিকায় ডাইনোসর নিয়ে রঙিন ফিচারগুলোর কথাও মনে আসে। ব্রন্টোসরাস কী খায় আর স্টেগোসরাস কেমন করে হাঁটে, মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। ছোট্ট ছোট্ট ডাইনোসর পুতুল বাজারে পাওয়া যেত তখন। পুজো প্যান্ডেলেও ডাইনোসর থিমের চল হয়েছিল। কলকাতায় ভারতীয় জাদুঘরে ডাইনোসরের মডেলটির কথাও মনে পড়া স্বাভাবিক, এটি তৈরিতে মুখ্য ভুমিকা ছিল জিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র বাঙালি শিল্পী সুরজিৎ দাসের। বাইপাসের ধারে সায়েন্স সিটিতে অতিকায় ডাইনোসরের যান্ত্রিক মডেল তো আছেই! ডাইনোসর মূর্তি তো আছেই।

Advertisement

কিন্তু ‘ডাইনোসর আর রবীন্দ্রনাথ’ বললে? মেলানো মুশকিল বটে। কিন্তু সত্যি মিলেছিল এই দুই। মিলিয়েছিলেন কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানী। আর এই গবেষণার সূচনা হয়েছিল যাঁর হাত ধরে, তিনি রবীন্দ্র-স্নেহধন্য বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ব্রিটিশ আমলের শেষ থেকেই ভারতের মধ্য-দক্ষিণ ভূখণ্ডের প্রাচীনতার দিকে নজর পড়েছিল বিজ্ঞানীদের। এখানে আদিম জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা গিয়েছিল। তবে পরাধীন দেশে এ ধরনের কাজে দেশীয় বিজ্ঞানীরা খুব একটা প্রচার বা সাহায্য পাননি।

পরিস্থিতিটা বদলাল স্বাধীনতার পর। ১৯৫৮ সালে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের বিশিষ্ট জীবাশ্ম-বিশেষজ্ঞ পামেলা রবিনসনের সঙ্গে দেখা হয় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের। পামেলা রবিনসনের পরিকল্পনা ছিল, এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন অঞ্চল চিন-এ গিয়ে পুরাযুগের জীবাশ্মের খোঁজ করবেন। কিন্তু প্রশান্তচন্দ্র তাঁকে রাজি করান ভারতে এসে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট-এ ‘অতিথি বিজ্ঞানী’ হিসেবে কাজ করার জন্য। পামেলা এলেন, গড়ে উঠল আইএসআই-এর শাখা জিয়োলজিকাল সার্ভে ইউনিট। তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করলেন গণিতজ্ঞ টি এস কুট্টি, প্রাণীবিজ্ঞানী এস এল জৈন এবং বাঙালি ভূবিজ্ঞানী তপন রায়চৌধুরী। ষাটের দশকের শুরুতেই এল বিরাট সাফল্য। জব্বলপুরে প্রাণহিতা-গোদাবরী নদীর অববাহিকায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল এক তৃণভোজী ডাইনোসরের বৃহৎ জীবাশ্ম। খুঁড়তে গিয়ে প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল তার বিশাল পায়ের হাড়ের, যা দেখে কর্মরত শ্রমিকরা বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘‘বড়া পা, বড়া পা!’’

Advertisement

সালটা ছিল ১৯৬১, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের বছর। তাই এই আবিষ্কারকে স্মরণীয় করে রাখতে নাম দেওয়া হল ‘বরাপাসরাস টেগোরাই’। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন এই ‘বরাপাসরাস’ প্রাপ্তির সাফল্যে। আইএসআই-এর হাতে এল সেই স্তূপীকৃত জীবাশ্ম। আজ এই প্রতিষ্ঠানের জিয়োলজি মিউজিয়মে দাঁড়িয়ে আছে ১৮ মিটার লম্বা এই ডাইনোসরের কঙ্কাল, মূল জীবাশ্মের টুকরো জুড়ে জুড়ে তৈরি করা। আন্তর্জাতিক মানের এই কাজের কৃতিত্বও এক বাঙালির। তখন আমাদের দেশে এত বড় জীবাশ্মের মাউন্টিং করে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো উপযুক্ত প্রযুক্তি ছিল না, আর করতে গেলেও প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থ। এই অসাধ্যসাধনের দায়িত্ব পড়ল যাঁর হাতে, সেই প্রণবকুমার মজুমদার ছিলেন আইএসআই-এর বিভাগীয় ভাস্কর। সম্পূর্ণ দেশি পদ্ধতিতে এই কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তিনি।

বিশাল ওজনের সেই টুকরোগুলো সাজানো হয়েছিল আলাদা আলাদা লোহার ফ্রেমে। লম্বা গলা আর মাথার ভার বহনের জন্য নীচের দিকটা যথেষ্ট মজবুত করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্তরে অন্যতম সেরা জীবাশ্ম শিল্পের স্বীকৃতি পেল বাঙালি ভাস্করের এই কাজ। কিন্তু এই কাজের দিশা অনুসরণ করে ভবিষ্যতে কলকাতার বুকে ডাইনোসর নিয়ে আরও কাজ হওয়ার যে আশা জেগেছিল বিজ্ঞানী মহলে, তাতে হঠাৎ করে যেন ভাটা পড়ে গেল। অনুদানের অভাব, উৎসাহের অভাব তো ছিলই। আরও বড় কোনও কারণ কি ছিল এর পিছনে?

১৯৭৫ সালে ‘বরাপাসরাস টেগোরাই’ নিয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পিছনে যে দু’জনের মুখ্য অবদান, তাঁরা ছিলেন বাঙালি— তপন রায়চৌধুরী এবং শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলতে গেলে বাঙালির ডাইনোসর চর্চার আরও চমকপ্রদ আবিষ্কারের সব গল্প উঠে আসে। ট্রায়াসিক যুগের ‘রিঙ্কোসর’ যে ভারতেও ঘুরে বেড়াত, সে কথা জানা গিয়েছিল তাঁরই আবিষ্কারের সূত্রে। অন্ধ্রপ্রদেশের এক জায়গায় পাশাপাশি শুয়ে থাকা দু’টি ‘ফাইটোসর’-এর জীবাশ্মও খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল তাঁর আবিষ্কার।

১৯৮৯ সালে ভূবিজ্ঞানী ধীরাজ কুমার রুদ্রের সঙ্গে আরও একটি বড় গবেষণা কাজের শরিক হয়েছিলেন শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। জব্বলপুরের ‘ল্যামেন্টা বেডস’ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। এখানেই তাঁরা প্রমাণ পান, ওই অঞ্চলের প্রাচীন ভূমিতে উল্কাপাত এবং অগ্ন্যুৎপাত ছিল ডাইনোসরদের অবলুপ্তির অন্যতম কারণ।

শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় উচ্চতর গবেষণার সূত্রে পাড়ি দেন বিদেশে। সেখানেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করে ছিল নতুন আবিষ্কারের কৃতিত্ব। এ বার সঙ্গী ছিল তাঁর ছোট্ট ছেলে। তারই নামে এক নতুন প্রজাতির ডাইনোসরের নাম দেওয়া হল ‘শুভসরাস ইনএক্সপেক্টেটাস’, অর্থাৎ অপ্রত্যাশিত। সত্যি অপ্রত্যাশিত এই আবিষ্কারের গল্প। নব্বই-এর দশকের শুরুর দিকে, টেক্সাস অঞ্চলে জীবাশ্ম খোঁজা চলছে তখন। বছর দশেকের ছেলে শুভ নাকি কাজের সময় শঙ্করবাবুকে বিরক্ত করছিল, বাধ্য হয়ে তখন তিনি ছেলের হাতে তুলে দেন একটি প্লাস্টারের ব্লক। তার মধ্যে ছিল কিছু বাতিল ফসিলের টুকরো। খেলার ছলে সেটি ভেঙে ফেলে শুভ, বেরিয়ে আসে এক নতুন জীবাশ্মের মাথার খুলি। পুরাজীবতত্ত্ব চর্চায় এক অভিনব দিক খুলে দিল এই আবিষ্কার। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হল ‘Shuvosaurus, a new theropod: an unusual theropod dinosaur from the Triassic of Texas’। বলা হল, এটি সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম অস্ট্রিচ-গোত্রীয় ডাইনোসর প্রজাতি। এই প্রজাতির দাঁত নেই, পাখির সঙ্গে মিল আছে। মুখের সামনের দিকের হাড়ের গড়ন খানিকটা ঠোঁটের মতো, পায়ে ধারালো নখ, আর তিনটি আঙুল। থেরোপড গোত্রীয় এই শুভসরাস ট্রায়াসিক যুগের প্রাণী।

পরবর্তী কালে কয়েকজন গবেষক বলেন, ‘শুভসরাস’ আলাদা কোনও প্রজাতির ডাইনোসর নয়, বরং আগেই আবিষ্কৃত একটি প্রজাতির দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ২০০৬ সাল নাগাদ আর এক দল বিজ্ঞানী ভিন্ন মত দিলেন— এর হাবভাব কুমির জাতীয় সরীসৃপের সঙ্গে মেলে, আবার পাখির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ে এতে। এই নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কিন্তু এই বিতর্কের মধ্যেই তো রোমাঞ্চ। আর সে কারণেই ‘শুভসরাস’ একটা আলাদা গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে। এই জাতীয় বা কাছাকাছি প্রজাতির জন্য একটি গোষ্ঠীনামও তৈরি হয়েছে— ‘শুভসরাইড’। প্রত্নজীববিজ্ঞানে নামকরণের এত সব জটিল বিষয় আমরা বুঝি না বুঝি, ডাইনোসরদের একটি গোষ্ঠীনামের সঙ্গে যে বাঙালির নাম জড়িয়ে আছে, এতেই আমাদের গর্ব হওয়ার কথা।

শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, পাখিদের পূর্বসূরি ‘প্রোএভিস’ প্রজাতির জীবাশ্ম আবিষ্কার। ১৯৮৩ সালে আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের লাবক শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে ডোকাম অঞ্চলে তিনি এক জীবাশ্মের খোঁজ পান। তাঁর মতে সেটি ‘আর্কিয়োপটেরিক্স’-এর থেকেও সাড়ে সাত কোটি বছর পুরনো, এবং সেটির ওড়ার ক্ষমতা ছিল। এ নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। তাঁর এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করেই শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘দ্য রাইজ় অব বার্ডস’ বইটি, বাংলা অনুবাদে যা ‘আকাশলীনা: ডাইনোসর থেকে পাখি’। সাধারণ পাঠকের পক্ষে একটু কঠিন লেখা, কিন্তু ডাইনোসর আর পাখির মধ্যবর্তী প্রোএভিস-কে যে এমন কাব্যিক বাংলা নামে ডাকা যায়, বাঙালি ছাড়া আর কে-ই বা ভাবতে পারত!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement