এখানে থাকেন হাতে গোনা কয়েক ঘর মানুষ। শান্ত, মানবিক, দিলদরিয়া। যুদ্ধে শেষ এখানকার দু’প্রজন্মের পুরুষ, তাই ঘরে বাইরে মহিলারাই প্রধান। আতিথেয়তায় তাঁরা সকলকে আপন করে নেন।
Russia Ukraine War

Russia: শীতল তুন্দ্রা টের পায় না যুদ্ধের উত্তাপ

রাশিয়ার দুধসাদা হিমেল প্রান্তর। যানবাহন বলতে স্লেজগাড়ি। যেন সভ্য দুনিয়ার শেষতম বিন্দু।

Advertisement

দেবাঞ্জলি রায়

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২২ ০৭:৪৬
Share:

তুষারশুভ্র: বরফে ঢাকা প্রান্তরে মাত্র কয়েক ঘর মানুষ। এখানকার আকাশে দেখা যায় অরোরা বোরিয়ালিস বা মেরুজ্যোতির রঙিন ছটা।

এই পৃথিবীটার ছবি ড্রোন ক্যামেরায় তুললে উত্তরের একটি জায়গা দেখা যাবে কেবলই সাদা। বরফসাদা। শিমুল পলাশের রং তাকে রাঙায় না। বাকি পৃথিবী থেকে রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের এই জায়গাগুলোর দূরত্ব এতটাই যে, কোনও ধরনের উত্তাপ বা উন্মাদনাই যেন পৌঁছয় না সেখানে। আদিগন্ত সেই সফেদ প্রান্তেও মানুষের বাস। তাঁরা আমাদের মতোই সকালে ঘুম থেকে উঠে রোজনামচায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

Advertisement

সেটা একটা দ্বীপ। মুরমান্সক-এ বিমান থেকে নেমে ঘণ্টা তিনেক গাড়িতে লোভোজ়েরো। সেখান থেকে লোভোজ়েরো লেকের জমে যাওয়া জলের বরফের উপর দিয়ে এক ঘণ্টা স্লেজ গাড়িতে চেপে সেই দ্বীপে পৌঁছলে মনে হবে যেন সভ্যতার শেষ চিহ্নটিকে ছুঁয়ে ফেললাম। সমস্ত রকম শীতপোশাক চাপিয়ে, তার উপরে ভাড়া করা আরও শীতপোশাক পরে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা বাঙালির ওই দ্বীপের অভিজ্ঞতার কাছে বড় বড় যুদ্ধবাজরাও মাথা নিচু করবে। এই দ্বীপের অনেক বাসিন্দা জানেনই না ইউক্রেন সীমানায় যুদ্ধের কথা। তাঁরা শুধু আতিথেয়তার উষ্ণতা
দিতে জানেন।

স্লেজ গাড়িতে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে বলে রাখি, ওটা একেবারেই কাব্যিক নয়! কল্পনা করেছিলাম, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে স্বামী-স্ত্রী হাত ধরে বরফের সমুদ্রে ভেসে যাব স্লেজগাড়ি চেপে। আদতে ব্যাপারটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক! সামনে থেকে ক্রমাগত ছিটকে আসা বরফের কুচির ঝড়ে চোখমুখ বন্ধ করে রাখতে হয়। চার পাশের বরফিলি দুনিয়াটা ভাল করে দেখারই উপায় নেই। তার উপরে রাস্তা বলে বরফের উপর কিছু হয় না। গাড়ি যেখান দিয়ে যাবে সেটাই রাস্তা। সেটা গর্ত হতে পারে, কাঁটাঝোপ হতে পারে, বার্চ গাছের গুঁড়ির গা ঘেঁষে হতে পারে, সেটা চালকের মর্জি। আর তার যা গতি, কোমর ও গলার হাড়গোড় পা ধরে মিনতি করে, “আর না, এ বার থামো!” ও সব করে যখন সেই দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলাম— যেন ‘দ্য গোল্ডেন কম্পাস’ সিনেমার সেট। চারিদিকে বরফ। পায়ে চলার যে রাস্তা করে দেওয়া আছে, তার বাইরে পদক্ষেপ মাত্র হাঁটু পর্যন্ত পা ঢুকে যাচ্ছে বরফে।

Advertisement

যাঁর অতিথিশালায় আমরা ছিলাম, সেই নাতালিয়া ইভানোভা দরজা খুলে আমাদের স্বাগত জানালেন। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে উনি এবং ওঁর দু’জন মহিলা কর্মচারী আমাদের পা থেকে সেই বরফমাখা জুতো টেনে টেনে খুলে দিলেন, মোজা খুলে দিলেন, ভারী জ্যাকেটটা গা থেকে নামিয়ে দিলেন। যাতে ঠান্ডা হয়ে না যায়, তাই বার বার নিজেদের হাত দিয়ে আমাদের হাত পা ঘষে দিলেন, গরম কাপড়ের সেঁক দিলেন। ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাচ্ছিলাম ওঁদের এই ব্যস্ততায়। হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ফুটন্ত জলের হিটারের এক পাশে বসালেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে এল রান্না করা টাটকা খাবার। সুসজ্জিত কাঠের টেবিলের ওপর পোর্সেলিনের পাত্রে স্যামন মাছ দেওয়া ধোঁয়া-ওঠা রাশিয়ান সুপ। সঙ্গে মশলা মাখানো আলুসেদ্ধ আর নরম সুসিদ্ধ বল্গা হরিণের মাংস। কী তার গন্ধ আর স্বাদ! ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, সংগ্রামী, সব বিষয়ে মন্তব্য করা বাঙালির পরমাত্মা তখন পরিতৃপ্ত। অথচ তার আগের দিন থেকেই আমাদের কোনও ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড কাজ করছে না, অধিকাংশ জায়গায় টাকা তোলা যাচ্ছে না, রাশিয়ান টাকার দাম হু হু করে নামছে, ফেরার সব উড়ান বাতিল হয়ে গিয়েছে— কারণ, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করায় একের পর এক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফাঁস চেপে বসছে রাশিয়ার উপরে। সে কী দুশ্চিন্তা! সে সমস্ত কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সত্যি কত সুন্দর এই দেশ, তার থেকেও সুন্দর এখানকার মানুষজনের হৃদয়।

অতি গৃহকর্মনিপুণ ও অতিথিপরায়ণ মহিলা নাতালিয়া। বেতসপত্রের মতো গড়ন। সব সময়ে ঘুরে ঘুরে কার কী সুবিধে-অসুবিধে, তা নজর রাখছেন আর কোন সময়ে উত্তরের আকাশে ‘অরোরা বোরিয়ালিস’-এর নাচ দেখতে পাওয়া যাবে, বার বার সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। সত্যিই তা দেখতে পাওয়া গেল রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। অপূর্ব এক নৈসর্গিক আলো। কখনও সবুজ, কখনও কমলা। উত্তরের আকাশ তখন মায়ায় মায়া।

সেই অতিথিনিবাসে ছিলেন আরও এক দল রুশ তরুণ-তরুণী, একটি রাশিয়ান ডাক্তার পরিবার। সবাই মিলে সেই বরফের মধ্যে বেরিয়েছি মেরুজ্যোতি দেখতে। তাপমাত্রা যে মাইনাস ২৮ ডিগ্রি, সেই হুঁশটুকু কারও নেই। তখন কোন দেশ যুদ্ধ করছে, কোন দেশ কাকে হুমকি দিচ্ছে— সব মিথ্যে। শুধু আছে কতগুলো মাথা উঁচিয়ে থাকা মানুষ আর মাথার উপরে শামিয়ানার মতো আকাশ। ড্রোন ক্যামেরাটাকে আরও একটু ‘জ়ুম ইন’ করলে দেখা যাবে, ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ দেখে সেই মানুষগুলো আনন্দে আত্মহারা।

ফিরে এসে আবার সেই অপূর্ব রান্নার স্বাদ। ডিনারের সময়ে জানতে পারলাম নাতালিয়ার রান্নাঘরের সর্বময়ী কর্ত্রী— যিনি বাড়ির দিদার মতো, দু’বেলা যাঁর হাতের রান্না খেয়ে আমরা তারিফ করছি— তিনিও জানেন না যুদ্ধ লেগেছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে। আমাদের মুখ থেকে সে কথা শুনে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বললেন, “আমাদের প্রেসিডেন্টের হাতে দেশ সুরক্ষিত, উনি নিশ্চয়ই একটা সুরাহা করবেন!” কত নিশ্চিন্তি, কত গভীর বিশ্বাস! কিংবা ইউক্রেনের তপ্ত সীমান্ত থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বরফশীতল এই দ্বীপে যুদ্ধের উত্তাপও ঠান্ডা। দু-দু’টো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে এই দেশ, দেখেছে সোভিয়েট-চুরমার পর্বের অর্থনৈতিক উথালপাথাল। দু’টো প্রজন্মের পুরুষ শেষ হয়ে গিয়েছে যুদ্ধে। ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই মহিলাদের প্রাধান্য। বহুদর্শী সেই সব মানুষগুলি অবিচল, মানবিক, দিলদরিয়া।

আসুন পরের দিন সকালে ড্রোনটাকে এ বার গ্রামের উপর দিয়ে একটু ঘোরানো যাক। দ্বীপের চার পাশে সমস্ত জল বরফ, তার মধ্যে পর্যটকেরা গর্ত করে মাছ ধরছেন, আমরাও। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট গ্রামে হাতে গোনা তিনটি বাড়ি, বল্গা হরিণের ফার্ম, আর যে দিকেই তাকানো যায় বরফ। জিনিসপত্র আসে সেই লোভোজ়েরো থেকে। হাতে গোনা সাত-আট জন বাসিন্দা। কী ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ এই দ্বীপ! শুধু ক’জন পর্যটকের শব্দে এখন মুখরিত।

যুদ্ধের খবরে এদের সত্যিই কি কিছু এসে যায়?

বরফে ঢাকা পথে অভিযাত্রী

পরের দিন ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেনস’ডে’। প্রাতরাশের টেবিলে নাতালিয়া হাতে করে উপহার নিয়ে আসেন, আলিঙ্গন করেন। মন উষ্ণতায় ভরে যায়। মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না এই দ্বীপে, কিন্তু নিজস্ব ইন্টারনেট বসানো আছে অতিথিশালায়। নাতালিয়া আমার কেউ নন। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময়ে এঁদের কথা ভেবে, এদের দেশের যুদ্ধ-পরিস্থিতির কথা ভেবে, দেশনায়কের প্রতি এদের অন্ধ আস্থা দেখে, অথবা আর কোনও দিন দেখা না-ও হতে পারে— এই কথা চিন্তা করে মনটা ভারী বিষাদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিল। সব বিচ্ছেদই দুঃখের। ক্ষণিকের অতিথি হলেও নাতালিয়ার সঙ্গে আত্মার এক গভীর সংযোগ অনুভব করছিলাম। এতগুলো শীতের পোশাক পরতে অভ্যস্ত নই। আমাকে নিজের হাতে ভাল করে পোশাক পরিয়ে, সমস্ত চেন আর বোতাম বন্ধ করে দস্তানা পরিয়ে স্লেজ গাড়িতে তুলে দিলেন তিনি। বার বার অনুরোধ করলেন, এক বার যেন গ্রীষ্মকালে আসি এখানে। প্রচুর বেরি পাওয়া যায় ওই সময়ে। বেরির জ্যাম আর জুস বানিয়ে আমাদের খাওয়াবেন।

গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগে নাতালিয়া আমাকে গভীর আলিঙ্গন করে বললেন, “জ্ভে ভিউদেট্ খারাসো”, যার অর্থ— সব ভাল হবে। নাতালিয়ার স্পর্শে অনুভব করলাম, মনের কোথাও তিনিও মা, আমিও মা। আমিও মনে মনে বললাম, তোমাদেরও সব ভাল হোক। যত দূর দেখতে পাওয়া যায় নাতালিয়া হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালেন।

দূর থেকে তাঁর লাল চকচকে জ্যাকেটটা যখন অগোচরে চলে গেল, হঠাৎ মনে হল— যাঃ, দ্বীপের নামটা তো জানা হল না! হয়তো সেই জন্যই আবার আমাকে নাতালিয়ার কাছে ফিরে আসতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement