সস্ত্রীক শিল্পী।
আজ থেকে বছর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন আগেও বালি ছিল গ্রামবাংলার জীবন্ত ছবি। কিন্তু এখন বালি কসমোপলিটান। আজকের মতো রাস্তার নামও ছিল না। রাস্তার নাম বলতে ছিল বাঁড়ুজ্যেপাড়া, ডিংশাইপাড়া, ধোপাপাড়া, গোঁসাইপাড়া, সাঁপুইপাড়া, গাঙ্গুলিপাড়া বা নতুন রাস্তা। সেই গাঙ্গুলিপাড়া নামের রাস্তাটা এঁকেবেঁকে এগিয়ে ডান দিকে ঈশ্বর মুখুজ্যের চওড়া লাল রকে প্রবীণ সুরকার রবীন চাটুজ্যে আর নবীন সুরকার অনল চাটুজ্যের সান্ধ্য আড্ডা ছুঁয়ে নতুন রাস্তার
সঙ্গে মিশেছে। এখানেই থাকেন পুরাতনী, আগমনি, টপ্পা, শ্যামাসঙ্গীত আর বোল বানাও ঠুমরির শিল্পী চণ্ডীদাস মাল। তাঁর বয়স এখন নব্বইয়ের কোঠায়।
বালির আর এক নব্বই পেরনো ব্যক্তিত্ব, ফুটবলার বদ্রু (সমর) ব্যানার্জি তাঁর নিউ আলিপুরের বাড়িতে বসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন “চণ্ডী আর আমি সমবয়সি। আমরা রিভার থমসন স্কুলে, পরে যার নাম হয়েছে শান্তিরাম বিদ্যালয়, পড়তাম। আজও মনে আছে সেটা ১৯৫৬ সাল, আমি তখন ‘বালি প্রতিভা’ ছেড়ে বছর তিনেক হল মোহনবাগানে খেলছি, ওই বছর মেলবোর্ন অলিম্পিকে যাওয়ার আগে বালি মিউনিসিপ্যালিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান বিমল মান্না এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন, সেখানে বালির তিন খ্যাতনামা তরুণ শিল্পী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, চণ্ডীদাস মাল ও সনৎ সিংহ গান গেয়েছিল। সেই সময়কার অধিকাংশ গানের কথাই আজ আর মনে নেই, তবে মনে আছে, আমার আদি বাড়ি থেকে একটু দূরে ডিংশাই পাড়ায় তারাপদ সাঁতরা মশাইয়ের বাড়িতে মাঝে মাঝে গানের আসর বসত। চণ্ডীর সঙ্গে বহু বার গিয়েছি। ও কেমন আছে?’’
সাঙ্গীতিক: চণ্ডীদাস মালের আগমনি গানের (প্রাচীন সংগ্রহ) সিডি।
বাংলা পুরাতনী, টপ্পা, ধ্রুপদের এই শেষ যুগপুরুষ প্রতিভার তুলনায় বরাবরই যেন কিছুটা উপেক্ষিত। তিনি কেমন আছেন জানতেই চণ্ডীদাসবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখলাম, সারা ঘরে নানা পদক, মানপত্র, স্মারক আর ছবির মাঝে নিজের খাটে বসে আছেন, পাশে নমিতা দেবী, বিখ্যাত শিল্পী শর্বরী রায়চৌধুরীর ছোট বোন। বয়সের ভারে আর আগের মতো সঙ্গীতচর্চা করতে পারেন না চণ্ডীদাসবাবু, তবু তাঁর গান শুনলে বোঝা যায়, সাধনালব্ধ সুর তাঁকে ছেড়ে চলে যায়নি। স্মৃতি দুর্বল, তাই নমিতা দেবী কথার খেই ধরিয়ে দিতে লাগলেন আর চণ্ডীদাসবাবু বললেন প্রাক্-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বালির গল্প। তাঁর পরিবারের গল্প।
“আমার সুবিধে ছিল যে, আমি ভাগ্যক্রমে এক পরিপূর্ণ সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি...’’ বললেন শিল্পী। আরামবাগের দৌলতপুরের বিখ্যাত তবলিয়া আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশারদ শশিভূষণ পাত্র ছিলেন তাঁর দাদামশাই। বাবা নারায়ণচন্দ্র মাল হুগলি ব্যাঙ্কের ৪০ টাকা মাসমাইনের চাকরির পাশাপাশি অনাথনাথ বসুর কাছে টপ্পা শিখতেন। তাঁর মা নিজেও গান গাইতেন। সেই শিশু বয়সেই শুনে শুনে গান তুলে নিতেন তিনি। এই অবধি বলে হঠাৎ কী মনে পড়ায় আপন মনে হেসে উঠে বললেন, “সে এক মজার ঘটনা! তখন আমার বয়স বড়জোর তিন সাড়ে তিন, বাবা-মা’র সঙ্গে মিনার্ভা থিয়েটারে ‘বলিদান’ নাটক দেখছি, নাটকে সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্পী আঙুরবালা গাইছেন ‘ছিঃ ছিঃ তুমি হেরে গেলে শ্যাম/ ডুবে গেল তোমার নাম...’ তাই শুনে আমিও মায়ের কোলে বসে অন্য দর্শকদের চেঁচামেচি সত্ত্বেও গলা মেলাতে লাগলাম!’’
বাবার কাছে তখন থেকেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম শুরু। কিছু দিন বাদে বাবা তাঁকে নিয়ে যান বালি বাদামতলার সনৎ সিংহের দাদা কিশোরীমোহন সিংহের কাছে। তাঁর কাছেই চণ্ডীদাসের খেয়াল আর টপ্পা তালিমের হাতেখড়ি। কিশোরীমোহন ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের গুরু রামচন্দ্র পালের কাছে। তবে তাঁর কাছে বেশি দিন তালিম নেওয়ার সুযোগ পাননি। কারণ কিছু দিনের মধ্যেই রামচন্দ্র পাল ফিল্ম জগতের ডাকে সাড়া দিয়ে বম্বে চলে গেলেন। তার পর বহু গুরুর কাছে বহু কিছু শিখেছেন এই শিল্পী। এগারো বছর বয়স থেকে কালীপদ পাঠকের কাছে টপ্পা, আগমনি আর শ্যামাসঙ্গীত শিখেছেন ওঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। দুর্গাদাস সেনের কাছে পুরাতনী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে ভজন, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে খেয়াল, শচীনদাস মতিলালের কাছে ঠুমরি, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন চণ্ডীদাস মাল। রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানের অথরিটি, বিষ্ণুপুর ঘরানার শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও তালিম নিয়েছেন কিছু দিন। তবলাতেও হাত পাকিয়েছিলেন কণ্ঠে মহারাজের ছাত্র বিমল বসুর কাছে। সেই প্রসঙ্গেই স্মৃতি রোমন্থন করলেন শিল্পী, ‘‘ঠাকুর-মা-স্বামীজির গান শিখেছি স্বামী চণ্ডিকানন্দ মহারাজের কাছে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, তখন বেলুড় মঠে গান শেখার সুবিধে ছিল না। আমি মহারাজের সঙ্গে সঙ্গে মঠের লনে ঘুরতাম আর উনি আমায় সেই সব অপূর্ব সুন্দর গান গলায় তুলে নিতে পরম স্নেহে তালিম দিতেন। কখনও কখনও উনি আমাদের বাড়িতে এসেও শিখিয়েছেন।”
একটা কৌতূহল অনেক দিন থেকেই ছিল, সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘‘টপ্পা তো মূলত ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের গান, বাংলায় এত জনপ্রিয় হল কী করে?’’ বললেন, “শুনেছি মুঘল বাদশা মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার দুই সভাশিল্পী সদারঙ্গ আর গুলাম নবি খেয়ালের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জাবি টপ্পাও গাইতেন। এ ছাড়াও সে সময়ে আদমশাহি, ইমদম ও সারেসার টপ্পার কথাও জানা যায়। উনিশ শতকে রামনিধি গুপ্ত বাংলায় অসাধারণ সব টপ্পা রচনা করলেন, নিধুবাবুর টপ্পা নামে সে সব গান খ্যাত। ওঁর ‘ও মিয়াঁ জানেওয়ালে’ থেকে রবি ঠাকুর গান বাঁধলেন ‘এ যাতনা যতনে’। নিধুবাবুর টপ্পার আদলে রচিত হল ‘এ পরবাসে রবে কে’, ‘কে বসিলে আজি’, ‘বন্ধু রহো রহো’, ‘কী আশা হায় না মিটিল’। টপ্পায় নানা রাগের ব্যবহার হলেও দেশ, খাম্বাজ, সুরট-মল্লার, হাম্বিরই বেশি যায়।’’
চণ্ডীদাসবাবুর ছোট ভাই দেবদাসবাবু জানালেন, “বাবার মুখে শুনেছি, ১৯৩৭ সাল, দাদার তখন বছর সাতেক বয়স, অল বেঙ্গল মিউজ়িক কম্পিটিশনের জুনিয়র বিভাগে দাদার খেয়ালের তানকারি, রাগরূপ পরিবেশনা, স্বরের স্বচ্ছন্দ যাতায়াত শুনে এক বিখ্যাত শিল্পীর চোখে জল এসে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আহা, এক বার চোখে যদি দেখা যেত শিশুটির মুখখানি। ওগো কে আছ, ওই ছেলেটিকে এক বার আমার কোলে দাও দেখি!’ তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দে। দাদা বালির জোড়া অশ্বত্থতলা স্কুলে বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দু’টি ভজন গেয়েছিল, ‘সীতারাম তু জপনা’ আর ‘কৃষ্ণ কানহাইয়া ব্রজকে বসাইয়া’। রিভার থমসন স্কুলের বিদায়ী অনুষ্ঠানে প্রতাপাদিত্য নাটকের বৈতালিকে গেয়েছিল ‘তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম’। খুব প্রশংসা পেয়েছিল। এক বার কালীপুজোয় তারাপদ সাঁতরা মশাইয়ের বাড়িতে শ্যামাসঙ্গীতের আসর বসেছে, শ্রদ্ধেয় কালীপদ পাঠক গাইলেন ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’ আর তার পরই দাদা গাইলে ‘ডুবিস নে মন ঘড়ি ঘড়ি’। আমার ছোট বোন তারাপদ সাঁতরা মশাইয়ের বাড়িতে ‘সাধক তুকারাম’ নাটকে ছদ্মবেশী শ্রীকৃষ্ণের ভুমিকায় অভিনয় করেছিল আর দাদা ‘চিনিবে না চিনিবে না/ যে না আপনি আপনে চেনে’ গানটা গেয়েছিল।’’
ভাই দেবদাসবাবুর কথা থেকে আরও জানা গেল, এক সময় বালিতে নাটক ও যাত্রার খুব চল ছিল। বালি নর্থ ক্লাব বছরে একটা করে পালা করতই। কাকা সুশীল মাল অভিনয় করতেন, চণ্ডীদাসবাবু গান গেয়েছিলেন ‘রৈবতক’, ‘উত্তরা’, ‘ভীষ্ম’ পালায়। মিনার্ভা থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্তর ‘শ্রীকৃষ্ণ সারথি’, ‘দেবত্র’, ‘মহানায়ক শশাঙ্ক’ নাটকেও গান গেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বহু নামী প্রতিষ্ঠানে। রবীন্দ্র ভারতী, সুরঙ্গমা, অল বেঙ্গল মিউজ়িক কলেজ, সঙ্গীত নাটক আকাদেমির বাৎসরিক ওয়ার্কশপ পরিচালনা ছাড়াও বাড়িতে নিয়মিত গান শেখাতেন ছাত্রছাত্রীদের। ১৯৪৪ থেকে আকাশবাণী ও পরে দূরদর্শনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। চণ্ডীদাস মালের কণ্ঠে ৭৫টি ঠাকুরের গান বেলুড় মঠের আর্কাইভে এবং ১০০টি টপ্পা, ঠুমরি, পুরাতনী, শ্যামাসঙ্গীত, দাশরথি রায় আর মহেন্দ্রলাল তর্কালঙ্কারের আগমনি সংরক্ষিত সঙ্গীত নাটক অকাদেমির আর্কাইভে।
চণ্ডীদাসবাবুর কৃতী ছাত্রছাত্রীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্ত্রী নমিতা দেবী জানালেন, “কত নাম করব ভাই? অজয় চক্রবর্তী, ড. উৎপলা গোস্বামী, তিমিরবরণ ঘোষ, চন্দ্রাবলী রুদ্র, লোপামুদ্রা, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, আরও অনেকে আছেন... সবার নাম সব সময় মনেও থাকে না। বহু বিশিষ্ট মানুষ তাঁর গানের গুণমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন, তাঁদের কাছে ভালবাসাও পেয়ে এসেছেন অফুরান।’’
এই শিল্পী দীর্ঘ সাধনায় হয়ে উঠেছিলেন পুরাতনী সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান। নব্বইয়ের কোঠায় এসে শরীর অশক্ত হয়ে পড়লেও সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা আজও অটুট এই অমায়িক মানুষটির।
ছবি: লেখক।