১৩ জুলাই, ১৯৭৪। নতুন অভিযানে নামছে ভারত। অধিনায়ক? অজিত ওয়াড়েকর। ১৯৭১-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ও ইংল্যান্ডে ঐতিহাসিক সিরিজ় জেতানো মহানায়ক। কিন্তু এই নতুন শিশুকে সামলানোর ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই। কেমন ফিল্ডিং সাজাবেন? কী হবে প্রথম একাদশ? কী বার্তা দেবেন সতীর্থদের? কিছুই জানা নেই।
পরিকল্পনাহীন। লক্ষ্যহীন। ধারণাহীন। রণনীতিহীন। হেডিংলেতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম এক দিনের ম্যাচ খেলতে নেমে পড়ল ভারত। যে ভাবে টেস্টে নতুন বলের পালিশ তোলার জন্য শুরুতে হাত ঘোরাতেন আবিদ আলি ও একনাথ সোলকার, ১৩ জুলাইও সে রকমই হল। স্বয়ং অধিনায়ক তিন নম্বরে নেমে ৮২ বলে ৬৭। এখনকার টি-টোয়েন্টি ও আইপিএলের রমরমার যুগে মনে হবে, কিছুই নয়। কিন্তু প্রথম এক দিনের ম্যাচ হিসেবে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে খারাপ কী? ব্রিজেশ পটেল সর্বোচ্চ স্কোরার, ৭৮ বলে ৮২। স্ট্রাইক রেট একশোর উপরে। ইংল্যান্ড চার উইকেটে জিতলেও ৫৫ ওভারের ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ভারতের ২৬৫ তোলা দেখেই বা কে বলবে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাদের হাতেখড়ি হচ্ছে!
গতকাল সেই এক দিনের ক্রিকেট যাত্রার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়ে গেল। মধ্যবর্তী সময়ে যা সব কোহিনুর জেতা হয়েছে, চুয়াত্তরের সেই দিনটায় দাঁড়িয়ে পূর্বাভাস করলে প্রয়াত অজিত ওয়াড়েকরই আষাঢ়ে বলে ছুড়ে ফেলে দিতেন। কে তাঁকে বিশ্বাস করাত যে, ভারত ২০২৪-এর জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে সব চেয়ে বেশি এক দিনের ম্যাচ খেলা দেশ হবে! ভারত এখনও পর্যন্ত খেলেছে ১০৫৫টি ওয়ান ডে। অস্ট্রেলিয়া, যেখানে ডন ব্র্যাডম্যানের হাত ধরে আন্তর্জাতিক এক দিনের ক্রিকেটের আত্মপ্রকাশ, তারা খেলেছে ১০০০ ওয়ান ডে। ইংল্যান্ড, যারা ১৯৬৬-তে জিলেট কাপ চালু করে সীমিত ওভারের ক্রিকেট বাজারে এনেছিল, তারা খেলেছে ৭৯৭ ওয়ান ডে। কে ভাবতে পেরেছিল, চারটি বিশ্বকাপের আয়োজন করে ফেলবে ভারত। বিশ্বকাপ যেখানে জন্ম নিয়েছিল, সেই ইংল্যান্ড ছাড়া এই কৃতিত্ব কোনও দেশের নেই। ১৯৮৩-র ২৫ জুন, কপিল দেবের হাতে লর্ডস ব্যালকনিতে বিশ্বকাপ ধরে থাকার ছবি যদি অবিশ্বাস্য হয়, তা হলে চার বছরের মধ্যে ইডেনে বিশ্বকাপ ফাইনাল হওয়ার দৃশ্যকে কী বলা হবে? অলৌকিক? তার আগে তিনটি বিশ্বকাপই হয়েছে ইংল্যান্ডে। কপিলের ভারত যখন বিশ্বকাপ জেতে, তাদের পুরস্কার অর্থ দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও ছিল না ভারতীয় বোর্ডের। লতা মঙ্গেশকর গান গেয়ে পয়সা তুলে দেন।
কপিল যখন দলবল নিয়ে ইংল্যান্ডের হোটেলে চেক-ইন করছেন, লবিতে দাঁড়িয়ে এক আগন্তুক লিফলেট বিলি করছিলেন। কী ছিল তাতে? না, ট্যুর প্যাকেজ। দ্রুত আপনাদের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়ে যাবে, আমাদের ভ্রমণ প্যাকেজে বেড়িয়ে আসুন। কপিল অবাক হয়ে যান দেখে যে, সেই আগন্তুক আসলে ভারতীয়। তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেন যে, “লজ্জা করে না ভারতীয় হয়ে ভাবছেন, আমরা তাড়াতাড়ি হেরে বিদায় নেব!” আর আগন্তুক কী বলছি, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত। ঐতিহাসিক ফাইনালের সর্বোচ্চ স্কোরার। অ্যান্ডি রবার্টসকে হাঁটু মুড়ে স্কোয়্যার ড্রাইভে মারা চার ভারতীয় ক্রিকেটের জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। এমন এক শট, যা গোটা দেশবাসীকে শাসন করার মেরুদণ্ড দিয়ে গিয়েছিল। তা সেই সময় সদ্যবিবাহিত ভারতীয় ওপেনার আমেরিকায় মধুচন্দ্রিমার টিকিট কেটে রেখেছিলেন। ধরে নিয়েছিলেন, গ্রুপ পর্বের পরেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে আর উনিও বেরিয়ে পড়বেন। কে আর তখন ভেবেছিল, কপিল দেবের ব্যাট জাদুদণ্ড হয়ে দেখা দেবে টানব্রিজ ওয়েলসে। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ১৭৫ অপরাজিতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ইনিংস অর্ধশতকের ভারতীয় এক দিনের ক্রিকেট ইতিহাসে আর আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে বলে মনে হয় না। নিশ্চয়ই দুর্ধর্ষ সব মাইলফলক রয়েছে। ওয়ান ডে ক্রিকেটে সচিন তেন্ডুলকরের হাতে প্রথম দ্বিশতরান। রোহিত শর্মার একাধিক ডাবল সেঞ্চুরি। বাবাকে হারানোর শোক চলার মধ্যে ব্রিস্টলে নেমে সচিনের শতরান এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকে খোঁজা। টনটনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৮৩। রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে তিনশো রানের উপরে জুটি। শারজায় সচিনের মরুঝড়-ইনিংস। ২ এপ্রিল, ২০১১-র রাতে ওয়াংখেড়েতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কাপ জেতানো ছক্কা। সচিন তেন্ডুলকরকে কাঁধে করে নিয়ে কোহলিদের ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ। ‘চেজ় মাস্টার’ বিরাট কোহলির দুর্ধর্ষ সব শতরান। মনে গেঁথে থাকা আরও সব মুহূর্ত রয়েছে। কোনওটা উৎসবের, কোনওটা স্বপ্নভঙ্গের। লর্ডসে ন্যাটওয়েস্ট জিতে সৌরভের জামা খুলে ওড়ানো। শারজায় চেতন শর্মাকে মারা মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কা। বিশ্বকাপে কিরণ মোরেকে নকল করে মিয়াঁদাদের লাফ। কত ঐতিহাসিক জয় রয়েছে। তিরাশির পর পঁচাশিতে অস্ট্রেলিয়ায় গাওস্করের অধিনায়কত্বে বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়। চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স রবি শাস্ত্রীর আউডি জয় এবং সতীর্থদের বনেটে বসে মেলবোর্ন প্রদক্ষিণ। শারজায় ১২৫ রানে অলআউট হয়ে গিয়েও পাকিস্তানকে ৮৭ রানে শেষ করে দিয়ে ম্যাচ জেতা। কিন্তু কপিলের ১৭৫, তাঁর ভিভকে আউট করা ক্যাচ আর তিরাশি বিশ্বকাপ জয় আজও সর্বসেরা কোহিনুর। এখনকার পৃথিবীতে এক দিনের ক্রিকেটের সেই রমরমা নেই। এসে গিয়েছে টি-টোয়েন্টি নামক নতুন শাসক। কিন্তু ক্রিকেটকে যে চিরতরে পাল্টে দিয়ে গিয়েছিল মাঠে ও মাঠের বাইরে ভারতের ওয়ান ডে আগ্রাসন, তা কী করে কেউ অস্বীকার করবে!
সম্প্রতি বার্বেডোজ়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে রোহিত শর্মাদের জয়ের প্রধান স্থপতি ধরা হচ্ছে সূর্যকুমার যাদবকে। খুব সত্যি কথা। মাঝরাতে সূর্যোদয় ঘটিয়েছেন তিনি। বাউন্ডারি লাইনে অমন দুর্ধর্ষ ক্যাচ ধরে। কেউ কেউ কপিল দেবের সেই ভিভ রিচার্ডসকে ফেরানোর ক্যাচের সঙ্গে তুলনা করছেন। সত্যিই কি কোনও তুলনা হতে পারে? রিচি বেনো পর্যন্ত ধারাভাষ্যে বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন, “রিচার্ডসের এই শটটা ঠিকমতো ব্যাটে-বলে হয়নি। তবু বাউন্ডারির দিকে এগোচ্ছে...” সেখান থেকে ঢোঁক গিলে বলতে হয়, কপিল কী দুর্ধর্ষ, অবিশ্বাস্য, অলৌকিক ক্যাচ নিচ্ছেন!
পঞ্চাশ বছরের এই যাত্রাপথে নানা স্টেশনে দাঁড়াতে গিয়ে মনে হচ্ছে, কপিলের ওই ক্যাচ যদি না ঘটত? যদি তিনি জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ওই ইনিংস না খেলতেন? শুধু তো একটা ক্যাচ বা একটা ইনিংস নয়। ভারতীয় ক্রিকেটের স্রোত পাল্টে দিয়ে যাওয়া দু’টি মুহূর্ত। এক দিনের ক্রিকেট ভারতে ছিল নির্জন, অনাবিষ্কৃত এক দ্বীপ। যেখানে কোনও ভারতীয় তরী নিয়ে যেতে চায়নি। না ক্রিকেটারেরা, না প্রশাসকেরা। ১৯৭৪-এ প্রথম এক দিনের ম্যাচ খেললেও ১৯৮১-র নভেম্বর পর্যন্ত দেশের মাঠে ওয়ান ডে হয়নি। প্রশাসকেরা ভয় পেয়েছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটের ভরন্ত বাজারে আঁচড় লাগতে পারে সীমিত ওভারের ক্রিকেট চালু করলে। এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে, তিরাশি বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে ভারতের এক দিনের ম্যাচের অভিজ্ঞতা ছিল চল্লিশের মতো। বাকি সব দেশে তখন পুরোদমে চালু হয়ে গিয়েছে নতুন এই ক্রিকেট। ইংল্যান্ড, নিউ জ়িল্যান্ড, এমনকি পাকিস্তানেও। কিন্তু ভারত চালু করে অনেক দেরিতে।
একাশিতে দেশের মাঠে প্রথম এক দিনের ম্যাচ। তিরাশিতে বিশ্বকাপ জয়। জাদু নয়তো কী?কপিল হলেন সেই কলম্বাস, যিনি অজানা এই এক দিনের ক্রিকেটের দেশ আবিষ্কারের সাহস দেখিয়েছিলেন। বিশ্বকাপের ঠিক আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে হারিয়েছিল কপিলের ভারত।
বার্বিসে হওয়া সেই ম্যাচ বিশ্বকাপ জেতার বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছিল। ভারতের এক দিনের ক্রিকেটের ইতিহাস এই ম্যাচকে বাদ দিয়ে কখনও লেখা যাবে না। কপিল দেব সেই ম্যাচে ৩৮ বলে ৭২ করেছিলেন। এখনকার দিনে আইপিএলে করলেও বলা হবে, দুর্ধর্ষ ইনিংস। মদন লাল এখানেই ভিভ রিচার্ডসকে আউট করেন এবং বিশ্বকাপ ফাইনালে কপিলকে বলেন, “আমি ওকে আগে আউট করেছি, আবার করতে পারব।” সুনীল গাওস্করের ৬০ ওভারে ৩৬ নট আউট চাঁদের কলঙ্কের মতো সারাজীবন তাঁর গায়ে লেগে রয়েছে। কিন্তু অনেকেই মনে রাখেনি, দু’টো খুব গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস ভারতের এক দিনের ক্রিকেট যাত্রায় খেলেছেন গাওস্কর। বার্বিসের সেই ম্যাচে ১১৭ বলে ৯০ ছিল গাওস্করের। ১৯৮১-তে দেশের মাঠে প্রথম ওয়ান ডে অভিযানে কটকে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ২-১ সিরিজ় জেতে ভারত। সেখানেও গাওস্কর ম্যাচের সেরা হন। ক্রিকেট ইতিহাস যে মাঝেমধ্যে কত দুর্বোধ্য হতে পারে!
এক সময় ভারতীয় ক্রিকেট মানে ছিল মহারাজাদের ক্রিকেট। তার পরে এল ব্রাহ্মণ-রাজ। পালবনকার বালুর কাহিনি কে ভুলতে পারবে? সেই সময় সারা ভারত কেন, গোটা ক্রিকেট দুনিয়ায় এমন বাঁ-হাতি স্পিনার ছিল কি না সন্দেহ। ইংল্যান্ডে বেসরকারি সফরে গিয়ে ১৪ ম্যাচে ১১৪ উইকেট নিয়েছিলেন। অম্বেডকর যাঁর ভক্ত ছিলেন। অথচ, তাঁকে কখনও অধিনায়ক হতে দেওয়া হয়নি। বারবার দল থেকে বাদও দেওয়া হয়েছে। অপরাধ? বালু দলিত ছিলেন। একই ড্রেসিংরুমে ঢোকার ছাড়পত্র পেলেও ছিলেন অচ্ছুত। চায়ের কাপ পর্যন্ত আলাদা করা থাকত। ছোঁয়াছুঁয়ি করতে পারবেন না। এখনকার দিনে যুজ়বেন্দ্র চহাল বা রিঙ্কু সিংহকে যে সেই অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয় না, তার কারণ কপিল দেবের লর্ডস অভ্যুত্থান। কপিল না ছিলেন রাজ-পরিবারের, না ব্রাহ্মণ, না মুম্বই-দিল্লির মতো বড় শহরের, না উচ্চশিক্ষিত। কপিলের ভারত জেতা মানে ছিল মহাত্মা গান্ধীর ভারতের জয়। লর্ডসে যখন ফাইনাল হচ্ছে, ভারতের আট-ন’জন সাংবাদিক উপস্থিত। তাদের ফাইনাল কভার করার জন্য ‘অ্যাক্রেডিটেশন’ বা প্রবেশাধিকার কার্ড দিতে চায়নি কর্তৃপক্ষ। শোনা যায়, প্রচুর লড়াইয়ের পরে তা পাওয়ার পরে ফাইনালের দিন গেট দিয়ে ঢোকার সময় লর্ডসের দ্বাররক্ষীরা মন্তব্য করেছিলেন, “এ বার দেখছি গান্ধী আসছেন লর্ডসে।”
এর পরে ভারতের কোন প্রান্ত থেকে না ভারতীয় ক্রিকেটার এসেছে? নজফগড়ের বীরেন্দ্র সহবাগ। রাঁচীর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, যে শহরকে সকলে জানত পাগলাগারদের জন্য। ধোনির বাবা স্টেডিয়ামে জলের পাম্প চালাতেন, কোনও রোলস রয়েসের মালিক নন। কপিলের পরে দ্বিতীয় ভারত অধিনায়ক হিসেবে যে দিন তাঁর ছেলের হাতে বিশ্বকাপ উঠল, সে দিন আরও বেশি করেই যেন অদৃশ্য বাস্তিল কারাগার ভেঙে দেওয়া হল। হুড়মুড়িয়ে সারা ভারত থেকে যেন ক্রিকেট-প্রতিভারা রাস্তায় নেমে এল। এখন আইপিএলের যুগে এমন এমন জায়গা থেকে ক্রিকেটার উঠে আসছে, এক দিন যা কেউ ভাবতেও পারেনি।
মাঠের বাইরে প্রশাসকদের মনেও বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল তিরাশি। ভারতে তখন প্রশাসক হিসেবে দুই তরুণের উত্থান হচ্ছে। কলকাতার ব্যবসায়ী জগমোহন ডালমিয়া ও পঞ্জাবের ব্যুরোক্র্যাট আই এস বিন্দ্রা। আর বোর্ডের নেতৃত্বে রাজনীতিবিদ এন কে পি সালভে। তিন জনে মিলে ঠিক করলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে হানা দেবেন। বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকার একা ইংল্যান্ডের হাতে থাকবে কেন? রাজবংশের সম্পত্তি নাকি? ডালমিয়া ঐতিহাসিক খসড়া বানালেন। তাতে উত্তেজক প্রস্তাব, সাতাশি বিশ্বকাপ করা হোক উপমহাদেশে। ঝড় উঠল আইসিসি-র সভায়। ইংল্যান্ড মানতে রাজিই নয়। পাকিস্তান প্রবল ভাবে পাশে দাঁড়াল। শারজার আব্দুল রহমান বুখাতিরকে সঙ্গে নেওয়া হল আর্থিক বল বাড়ানোর জন্য। শ্বেতাঙ্গরা প্রশ্ন তোলে, উপমহাদেশে তাড়াতাড়ি দিনের আলো চলে যায়। ৬০ ওভারের ম্যাচ কী করে হবে? ডালমিয়া-বিন্দ্রা জুটি ক্রিকেট আইনের বই খুলে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, এর মধ্যে কোথায় লেখা আছে যে, এক দিনের ম্যাচ দিনে ১২০ ওভারেরই হতে হবে? ৫০-৫০ কেন হবে না? অস্ট্রেলীয় বোর্ডকে টানার চেষ্টা করলেন তাঁরা এই বলে যে, ১৯৮৭-র পরে ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ তোমাদের দেশে হবে। তার পরেও অবশ্য তাদের টালবাহানা চলেছিল। সেই সময় আইসিসি-র ভোটার সংখ্যা ছিল ৩৭। টেস্ট খেলিয়ে আটটি দেশের দুটি করে ভোট। অ্যাসোসিয়েট দেশগুলির একটি করে। ডালমিয়ারা অ্যাসোসিয়েট দেশগুলিকে নিশানা করলেন। তাদের বোঝালেন, তোমাদের ২০,০০০ পাউন্ড করে দেওয়া হবে লভ্যাংশ থেকে। তার আগে পর্যন্ত তারা চার-পাঁচ হাজার পাউন্ডের বেশি পায়নি। টেস্ট খেলিয়ে দেশগুলিকে তেমনই বলা হল, ৭৫,০০০ পাউন্ড করে দেওয়া হবে। এমন সব লোভনীয় প্রস্তাব কে ফেলতে পারবে? আইসিসি বৈঠকে পাশ হয়ে গেল উপমহাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তাব।
এক বছরের মধ্যে মাঠে, মাঠের বাইরে ‘ক্যু’ ঘটিয়ে ফেলল ভারত। এর পরে ক্রিকেটের চালচিত্রই পাল্টে যাবে। রানির একচেটিয়া অধিকার হয়ে থাকবে না বিশ্বকাপ। ঘুরবে সারা বিশ্বে। দুশো বছরের পরাধীনতা কাটিয়ে স্বাধীন হওয়ার মতোই ক্রিকেটকে ইংরেজদের একচেটিয়া শাসনমুক্ত করবে তারা। এবং, সেই অভিযানে তাদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠে আসবে এক দিনের ক্রিকেট। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতোই যার ছোঁয়ায় পাল্টে যেতে থাকবে ক্রিকেট বাজার ও ক্রিকেট শাসনের ইতিহাস। এর পরে জগমোহন ডালমিয়া প্রথম এশীয় হিসেবে আইসিসি প্রধানের আসনে বসবেন। শোনা যায়, লন্ডনে আইসিসি দফতরে প্রথম দিন গিয়ে ডালমিয়া দেখেন, চেয়ারম্যানের জন্য ছোট্ট একটা ঘর। সিইও ডেভিড রিচার্ডস বেশ সাজিয়েগুছিয়ে বিশাল ঘরে বসে আছেন। ডালমিয়া সেই ঘরে ঢুকে বললেন, “কাল থেকে তুমি ওই ছোট ঘরটায় বসবে। আমি এখানে বসব। তোমাকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই যে, আইসিসি চেয়ারম্যানের কাজটা অনেক বেশি বিস্তৃত।” ডালমিয়া-বিন্দ্রারা এর পরে ১৯৯৬ বিশ্বকাপও নিয়ে আসবেন উপমহাদেশে। দশ ঘণ্টার উপরে রক্তক্ষয়ী বৈঠক চলে, তবু রণে ভঙ্গ দেননি তাঁরা। ফের সেই ভারত-পাকিস্তান জোটের জয়জয়কার। সমস্ত কাঁটাতারের ব্যবধান উড়ে যাচ্ছে ক্রিকেটের সামনে। তার মধ্যেই ডালমিয়া দেশে বিদ্রোহ ঘটিয়ে দূরদর্শনের হাত থেকে টিভি-স্বত্বের মুক্তিলাভ ঘটিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে, দূরদর্শনকে বিনা পয়সায় টিভি-স্বত্ব দিতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সর্বোচ্চ দর দেওয়া সংস্থাকেই স্বত্ব দেওয়া যাবে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে টিভি-স্বত্ব বিক্রি করা হল ওয়ার্ল্ড টেল-কে। প্রথম বিদেশি সংস্থার আবির্ভাব। এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল সেই টিভি-স্বত্ব। ১৯৯২-তে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপের জন্য সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ৭৫ লক্ষ মার্কিন ডলার। কোকা-কোলা বিশ্বকাপের সরকারি ঠান্ডা পানীয় হওয়ার জন্য দিল ৩৮ লক্ষ মার্কিন ডলার। ’৯২ বিশ্বকাপে টাইটেল স্পনসর যা দিয়েছিল, তার চেয়েও বেশি। আইটিসি সংস্থা টাইটেল স্পনসরশিপ কিনল ১ কোটি ২০ লক্ষ মার্কিন ডলারে। ক্রিকেটের বাজারকেই খুলে দিয়ে চলে গেল ’৯৬ বিশ্বকাপ।
ঘর থেকে দূরে থাকার অবসাদে এক সময় পরাধীন ভারতে ক্রিকেট চালু করেছিলেন ব্রিটিশরা। স্বাধীন ভারত ব্রিটিশদের দেখিয়ে দিল, কী ভাবে ক্রিকেটের বাজার তৈরি করতে হয়।
সৌজন্যে ওয়ান ডে মাতরম!