Leela Majumdar

খদ্দরের শাড়ি পরে লাঠি খেলতেন বলে নজরে পড়লেন সিআইডি-র

দেশ তখন পরাধীন। স্বদেশি আন্দোলন চলছে পুরোদমে। এই সাহসী মেয়েটিরই বানিয়ে বলা গল্পের মুগ্ধ শ্রোতা ছিল ভাইবোনেরা। গল্পগুলো পড়ে রীতিমতো উৎসাহ দিলেন বড়দা সুকুমার রায়। প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মী ছেলে’ বেরোল ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। সেই প্রথম গল্পপ্রকাশের শতবর্ষ পেরিয়েছে গত বছর। আর আজ সেই গল্পের লেখক লীলা মজুমদারের ১১৫তম জন্মদিন। 

Advertisement

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:২৮
Share:

গদ্যশিল্পী: লীলা মজুমদার। বাঁ দিকে উপরে, তাঁর বিখ্যাত ছোটদের বই ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’ ও নীচে ‘বদ্যিনাথের বড়ি’-র প্রচ্ছদ

ভয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা লীলা মজুমদারের টেবিলের সামনে এসে প্রেমেন মিত্তির বললেন, “আমায় বাঁচান! আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে!” রেডিয়ো আপিসের সেই ঘরে সবাই স্তম্ভিত। কে তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে? পুলিশ না কি? কেনই বা ধরবে? মিত্তিরমশাই আসল কথা ফাঁস করলেন লীলার কাছে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্র তাদের কলেজ-ফাংশনে সভাপতি করে নিয়ে যাবে বলে এসেছে। অথচ বাড়িতে অতি জরুরি কাজ। যাওয়া অসম্ভব। লীলা চেপে ধরলেন প্রেমেনদাকে, “আপনি নিশ্চয়ই আগে কথা দিয়েছিলেন, তাই না? সত্যি বলবেন।” আমতা আমতা করে ঘনাদা-স্রষ্টা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন। এখন তবে কী উপায়? নাছোড়বান্দা ছাত্রটির বক্তব্য বিখ্যাত কাউকে না নিয়ে গেলে বন্ধুরা তাকে পুঁতে ফেলবে। অতঃপর লীলা মজুমদার মাঠে নেমে কথার জাদুতে বশ করে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে পাঠিয়ে দিলেন ছেলেটির সঙ্গে। সবার সব দিক রক্ষা পেল সে যাত্রায়। আড্ডার আসরে এই প্রেমেন-রক্ষা-পালা রীতিমতো অভিনয় করে দেখাতেন লীলা মজুমদার! প্রেমেনদার ভয়ার্ত হাঁপানি, ছাত্রটির অসহায় মুখের করুণ চাহনি সবটাই জীবন্ত হয়ে উঠত। এমন অভিনয় শিখলেন কোথায়? উত্তরে তিনি বলতেন, “সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বড়দা সুকুমার রায় নাটক লিখে বাড়ির ছোটদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। তখন আমিও করেছি। রিহার্সাল দেখেছি। ওই যা আমার ট্রেনিং।”

Advertisement

তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়ির আড্ডায় নিয়মিত আসতেন অনেকেই। শান্তিদেব ঘোষ, অমিতা সেন, কণিকা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, অম্লান দত্তের মতো বিখ‍্যাত মানুষেরা ছিলেন সেই আড্ডার সদস‍্য। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুটিংয়ের কাজে বোলপুর গেলে তাঁর লীলাপিসির আড্ডায় একটি বার না গেলে চলত না। ‘গণদেবতা’র শুটিং চলছে সে বার। সৌমিত্র এসে জানালেন তাঁর সঙ্গে শুটিংয়ে শান্তিনিকেতন এসেছেন রবি ঘোষ এবং সন্তোষ দত্ত। তাঁরা লীলা মজুমদারের ভীষণ ভক্ত, তাই সাক্ষাৎপ্রার্থী। মানিকের ছবির বাঘা আর রাজামশাই আসবে শুনে লীলা ততোধিক খুশি, “শোন তোরা একটু রাত করে আসিস। খেয়ে যাবি এখানে। আমার এখানে খাবে তো ওরা?” শুনে সৌমিত্রর মন্তব্য, “আলবাত খাবে। আমি তো খাবই। হোটেলের রান্না খেয়ে খেয়ে মুখে অরুচি ধরে গেছে।” সেই নৈশভোজের সাক্ষী সাহিত্যিক অজেয় রায় লিখেছেন, “... সেদিন খাবার আগে আড্ডাটা দারুণ জমেছিল! রবি ঘোষের মুখে যেন খই ফুটছিল। সন্তোষ দত্ত কথা খুব কম বললেও মাঝে মাঝে তাঁর এক-একটি ছোট্ট সরস মন্তব্যে অন‍্যেরা হাসিতে ফেটে পড়ছিল।”

ছেলেবেলায় শিলং জীবনে ‘ছোড়দি’ লীলার বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্পের ভক্ত ছিলেন ছোট ভাইবোনেরা। গলা খেলিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, হাতমুখ নেড়ে অসাধারণ সেই উপস্থাপনা। ছোটদের কাছে শিলং পাহাড়ের চেনা ঝোপঝাড় খানাখন্দ হয়ে যেত অচেনা আর রহস্যময়। দূরের যে পাহাড়ে সবাই পিকনিক করতে যায়, সেখানে নাকি লুকোনো আছে গুপ্তধন। ছোড়দি আর তাঁর গোপন সহকারীরা খুঁজে চলেছে সেই রত্নভান্ডার। যে সমস্ত সূত্র হাতে এসে গেছে, তাতে সাত রাজার ধন তারা পাবেই পাবে। হয়তো কিছু রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে হোক, সেগুলো পেলে ভাইবোনদের অল্প একটু ভাগ দিয়ে বাকিটা বিলিয়ে দেওয়া হবে গরিব-দুঃখীদের। “ছোড়দি, তুমি কি করে জানতে পারো এইসব কথা?” এক সন্ন‍্যেসী-গুরু তাঁকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে গোপন মন্ত্র। চোখ বুজে মন্ত্রটা আওড়ালে ছবির মতো ভেসে ওঠে সব কিছু। “আমাদেরও শিখিয়ে দাও না একটু!” ভাইয়ের আবদার শুনে কিশোরী লীলা বলেন, “খুব কঠিন সাধনা করতে হয় রে! তুই পারবি না। তাছাড়া গুরুজির পার্মিশন চাই। উনি তো এখন হিমালয়ে। ফিরে এলে জিজ্ঞেস করব।” ছেলে-ভোলানো এই সব বানানো গল্প অচিরেই আশ্রয় পেয়ে গেছিল লীলার লেখার খাতায়। সেগুলো পড়ে খুব উৎসাহ দিতেন বড়দা সুকুমার রায়। বছর পনেরোর সেই কিশোরীর একটা গল্প তিনি ছাপিয়ে দিলেন ‘সন্দেশ’-এর পাতায়। চিরঘুমের ঘোর ঘনিয়ে আসার আগে পাগলা দাশুর স্রষ্টা নিজের ব‍্যাটনটি যেন দিয়ে গেলেন যোগ‍্য উত্তরসূরির হাতে। লীলা রায়ের নামে প্রকাশিত সেই গল্পের শিরোনাম ‘লক্ষ্মী ছেলে’। ১৯২২-এ। লীলা-সাহিত‍্যের প্রথম প্রকাশের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর।

Advertisement

দেশ তখন পরাধীন। স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তুঙ্গ মাত্রায়। কলেজছাত্রী লীলার পিছনে লেগে গেল সিআইডি। কারণ? লাঠিখেলা অনুশীলন করতেন তিনি। রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। খদ্দর শাড়ি পরা আর লাঠিখেলার যৌথতায় তাঁর যে পরিচয় উঠে আসছিল, পুলিশের নজর পড়বেই। “তার মানে দেশটাকে জন্ম থেকে ভালবাসতে শিখেছিলাম”— একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন লীলা। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকের সেই কথোপকথনে লীলা মজুমদারের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, “...রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিক সচেতনতা আমার আছে। ...যে দেশের অর্থনৈতিক বনিয়াদ নিতান্ত নড়বড়ে, সেই দেশের মন্ত্রীদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা, ঘন ঘন তাদের বিদেশ ভ্রমণ, কথায় কথায় নাচগানের অনুষ্ঠান কেন?” প্রায় একশো ছুঁই-ছুঁই পরমায়ু নিয়ে লীলা মজুমদার আজকের দিনে, ১১৫ বছর আগে, পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। তিন দশক আগের মন্ত্রী-সান্ত্রীদের রকমসকম দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তিনি।

১৯৩০ সালটি একটি কারণে স্মরণযোগ‍্য হয়ে থাকতে পারে, ওই বছর কলকাতা আর ঢাকা থেকে বাংলা সাহিত্যের দুই ভবিষ্যৎ নক্ষত্র শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের অনন‍্য সাফল‍্য দেখিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লীলা রায় আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বুদ্ধদেব বসু, দু’জনেই ইংরেজি স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। লীলা অবশ‍্য বরাবরের কৃতী ছাত্রী। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পেয়েছিলেন দ্বাদশ স্থান। ছাত্রজীবনে সমবয়সি লীলা ও বু.ব-র পরিচয় না থাকলেও অনেক পরে বুদ্ধদেব শিশুসাহিত‍্যিক লীলা মজুমদারকে বড়দের জন‍্য লেখার বিষয়ে উৎসাহিত করেন, তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেন ‘সোনালি রুপোলি’ গল্পটি। কবিতাভবন থেকে প্রকাশিত ‘বৈশাখী বার্ষিকী’র ১৯৩৯ সালের সংখ‍্যায় এটি প্রকাশ করেন বু.ব। ‘সানন্দা’ পত্রিকার ১৯৯৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সংখ‍্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে লীলা বলেছিলেন, “বড়দের জন‍্য আমার প্রায় সব কাহিনীর পটভূমি নিজের চোখে দেখা। ঘটনাগুলো হয়তো বানিয়েছি। চরিত্রেরা অনেকেই সত্যি মানুষের ছায়া।”

প্রাপ্তবয়স্কদের জন‍্য তাঁর প্রথম লেখা উপন‍্যাস ‘শ্রীমতী’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সত্তর বছর আগে। ১৯৫২ সালে, কিংবদন্তি ডি কে-র সিগনেট প্রেস থেকে। এই প্রকাশনার বিরলতম বিবৃতি-পুস্তিকা ‘টুকরো কথা’র চল্লিশতম সংখ‍্যায় মুদ্রিত উপন‍্যাসের পরিচিতি-কথনটি নরেশ গুহর লেখা— ‘একটি বিশিষ্ট মেয়ের চোখে আধুনিক সমাজের বিচিত্র মেয়েদের দেখা গেল। সেই দেখার মধ্যে উদার মনের পরিচয় আছে। লীলা মজুমদার বাংলা সাহিত্যে নূতন সূচনা করলেন।’ শ‍্যামলকৃষ্ণ বসুর অনবদ‍্য অলঙ্করণগুলি ‘শ্রীমতী’র বিজ্ঞাপনেও ব‍্যবহার করা হত। পরের বছর, ১৯৫৩ সালে, লীলা উপহার দিলেন ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’, সঙ্গে অহিভূষণ মল্লিক (পরবর্তী সময়ে অহিভূষণ মালিক নামে খ্যাত)-এর চিরস্মরণীয় অলঙ্করণ। প্রচ্ছদশিল্পী সত‍্যজিৎ রায়। দাম দু’টাকা। ‘টুকরো কথা’র ঊনত্রিশতম সংখ‍্যায় প্রচ্ছদের খোঁপাবতী পিসির মুখওয়ালা বাক্সটির ছবি মুদ্রিত হয়েছিল, সঙ্গে রাজশেখর বসুর প্রশংসাবাক‍্য, “পড়তে পড়তে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ বা সুকুমার রায়ের রচনা পড়ছি।”

বই করার প্রথম পরামর্শটা লীলার কাছে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। তিনি ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত গল্পগুলো পড়ে বলেছিলেন বই না করলে লেখাগুলো হারিয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। লীলা তখন দার্জিলিঙের মহারানি স্কুলের শিক্ষিকা। গুরুদেবের আন্তরিক ডাকে সাড়া দিয়ে চলে এলেন শান্তিনিকেতনের শিশু বিভাগে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন না লীলা ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর। জানার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পদোন্নতি হল। “তুমি এখন থেকে কলেজে পড়াবে।”—এই ছিল কবির নির্দেশ। আবার কিছু দিন পর নীহাররঞ্জন রায় ডাকলেন কলকাতার আশুতোষ কলেজে পড়াতে। মনের কোণে দ্বিধা থাকলেও লীলা কলকাতায় চলে এলেন কিছু ব‍্যক্তিগত কারণে, “...ক'দিন পরই পেলাম রবীন্দ্রনাথের চিঠি। কবি লিখেছিলেন, আমি ফিরে গিয়ে আবার কাজে যোগ দিতে পারি। আমার আসন আমার জন্যই পাতা আছে।” রবীন্দ্র স্মৃতিতর্পণে বলেছিলেন লীলা। ১৯৪০ সালে শিশুসাহিত‍্যিক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য তাঁর রামধনু প্রকাশন মন্দির থেকে বার করলেন লীলার প্রথম বই ‘বদ‍্যিনাথের বড়ি’; সেখানে ছবি ও মলাট এঁকেছিলেন শৈল চক্রবর্তী। প্রকাশক মশাইয়ের খুব ইচ্ছে ছিল বইটির ভূমিকা লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ। লীলা সেই বার্তা কবিকে জানালেও রবীন্দ্রনাথ পেরে উঠলেন না। কবি তখন ভীষণ অসুস্থ, শয্যাশায়ী। পরের বছর, বাইশে শ্রাবণ, কবির প্রয়াণের দিন তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন লীলা।

সততা আর বাঙালিয়ানার অনুপানে পুরোদস্তুর আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার একটা পাঠ উনিশ শতক শিখিয়েছিল আমাদের। যাঁরা এই কর্মব্রতে অগ্রণী তাঁদের মধ্যে ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রামের রায়চৌধুরী পরিবার অন‍্যতম। সেই ঐতিহ্য সারা জীবন ব্রতপালনের মতো সাহিত্যচর্চায় ধরে রেখেছিলেন লীলা। তাঁর কলকাতার বাড়ির পাশে একটা মাঠ ছিল। সেখানে বিভিন্ন স্কুলের ছেলেরা খেলতে আসত। লেখার ঘর থেকে তিনি শুনতে পেতেন তাদের না বাংলা, না ইংরেজি, না হিন্দি ভাষায় কথোপকথন। কষ্ট পেতেন। তিন দশক আগের সেই যন্ত্রণা পরের শতকে কী পরিণতি পেতে পারে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। একটি ছোটগল্পে রেখে গেছেন সেই পরিণতির হিসেব, “যেদিন কাদা চিংড়ির ছ্যাঁচড়া মুখে রুচবে না, আর বাংলা ভাষা কানে মিষ্টি ঠেকবে না, সেদিন কিন্তু ঘোর দুর্দিন। উন্নতি হইতে সাবধান‌। শেষটা না পা পিছলে আলুর দম হয়।”

কৃতজ্ঞতা: সুজিৎ দে সিকদার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement