ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নায়িকার মতোই তাঁর নামও ছিল জুবেইদা বেগম। তবে ‘আলম আরা’-র নায়িকা তথা নবাবকন্যা জুবেইদা বেগম ধনরাজগিরের মতো রূপকথার জীবন ছিল না তাঁর। যদিও এই জুবেইদা বেগমের জীবনও কম নাটকীয় ছিল না। হিন্দি ছবির চিত্রনাট্যের মতোই নানা ঘাত-প্রতিঘাত, রোম্যান্স এবং ট্র্যাজেডিতে ভরা ছিল তা। তাঁর অকালমৃত্যু নিয়েও জল্পনার শেষ হয়নি।
হিন্দি সিনেমার সঙ্গে জুবেইদার কি একেবারেই কোনও সম্পর্ক ছিল না? এ নিয়ে অবশ্য জোর তর্ক রয়েছে। চল্লিশের দশকে তিনি অভিনয় করেছেন। এমনকি নেপথ্য গায়িকা ছিলেন বলে দাবি অনেকের। তবে জুবেইদার অভিনীত কোনও হিন্দি ছবি বা তাতে তাঁর গান গাওয়ার বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনেকের দাবি, তিনি হয়তো সিনেমার কোরাসের অঙ্গ ছিলেন। অথবা ‘আইটেম গানে’ দেখা দিয়েছিলেন।
জুবেইদা বেগমের অভিনয়জীবন নিয়ে তর্ক থাকলেও তাঁর জীবন নিয়ে অবশ্য একটি সিনেমা তৈরি হয়েছে। ২০০১ সালে শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় 'জুবেইদা' ছবিতে নামভূমিকায় দেখা গিয়েছিল করিশ্মা কপূরকে। সঙ্গে ছিলেন রেখা এবং মনোজ বাজপেয়ী।
কে এই জুবেইদা বেগম? মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে তিনি এককালে জোধপুরের মহারানি হয়ে উঠেছিলেন। ১৯২৬ সালে তৎকালীন বম্বেতে জন্ম জুবেইদার। ব্যবসাদার বাবা শ্রী কাসেমভাই মেহতা ছিলেন কট্টরপন্থী। তবে ওই মুসলিম পরিবারের সমস্ত রক্ষণশীলতা কাটিয়ে গান গেয়ে রোজগার করতেন মা ফৈজা বাঈ।।
ছোটবেলায় মায়ের কাছেই নাচগানের তালিম নিয়েছিলেন জুবেইদা। তবে তা পছন্দ ছিল না কাসেমভাইয়ের। কম বয়সেই মেয়ের বিয়ে দেন তিনি। এ সবই দেশভাগের আগেকার কথা। জুবেইদার প্রথম স্বামীর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে তাঁর সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি।
দেশভাগের পর তাঁদের একমাত্র সন্তান খালেদ মহম্মদকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলেন জুবেইদা। সে সময়ই গানে ডুবে থাকতে শুরু করেন। মায়ের পাশে বসে গান গেয়ে রোজগারও শুরু হয়েছিল তাঁর।
দেশভাগের বছরেই এক গানের জলসায় জুবেইদার জীবনে ঝড় উঠেছিল। সে বছর তাঁর জীবনে এসেছিলেন জোধপুরের মহারাজা হনবন্ত সিংহ রাঠৌর।
অনেকের দাবি, জোধপুরের মহারাজার বোনের বিয়েতে জুবেইদা এবং তাঁর মাকে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য ডাকা হয়েছিল। সেই জলসায় জুবেইদাকে প্রথম দেখেই তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন বছর চব্বিশের হনবন্ত।
২২ বছরের জুবেইদার সঙ্গে প্রেমপর্ব শুরুর আগে থেকেই মহারানি কৃষ্ণা কুমারীর সঙ্গে সংসার করছিলেন হনবন্ত। ১৯৪৩ সালে ১৬ বছরের কৃষ্ণাকে বিয়ে করেন বছর কুড়ির হনবন্ত। সে সময় অবশ্য জোধপুরের গদিতে বসেননি তিনি। তাঁদের দুই মেয়ে ও এক সদ্যোজাত পুত্রও ছিল।
কৃষ্ণার সঙ্গে বিবাহিত জীবনের মাঝেই প্রেমে পড়েছিলেন হনবন্ত। ১৯ বছরের স্কটিশ নার্স সারা ম্যাকব্রাইডের সঙ্গে লন্ডনে নাকি সংসারও পেতেছিলেন। তবে সে সম্পর্ক দেড় বছরের বেশি টেকেনি। সারার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দেশে ফিরে আসেন হনবন্ত। ’৪৭-এ জোধপুরের গদিতে বসেন তিনি। সে বছরই জুবেইদার সঙ্গে প্রথম দেখা।
জুবেইদার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের ঘন ঘন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেন হনবন্ত। মুম্বইয়ে গেলে নাকি তাঁর সঙ্গেই সময় কাটাতেন।
বিবাহিত মহারাজার সঙ্গে এক মুসলিম গায়িকার সম্পর্ক নিয়ে সে সময় বিশেষ হইচই হয়নি। তবে জুবেইদাকে ‘উপপত্নী’ তকমা দিতে রাজি ছিলেন না হনবন্ত। তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তাতে অবশ্য বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘গানেওয়ালি’-কে মহারানির গদিতে মেনে নিতে পারেনি সমাজ।
পারিবারিক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও হিন্দু রীতিনীতি মেনে ১৯৫০ সালের ১৭ ডিসেম্বর জুবেইদাকে বিয়ে করেন হনবন্ত। তবে তার আগে ধর্মান্তরণ হয়েছিল জুবেদার। তাঁর নতুন নাম হয় বিদ্যা রানি। এর পর হনবন্তের সঙ্গে জোধপুর রওনা হয় জুবেইদা।
বিয়ের পর জোধপুরের উমেদ ভবনে ঠাঁই হয়নি জুবেইদার। সেখানকার মেহরানগড়ের দুর্গে শুরু হয় দু’জনের সংসার। পরের বছর তাঁদের ছেলে রাও রাজা হুকুম সিংহ ওরফে টুটু বানার জন্ম হয়েছিল।
এক কালে 'ব্রিটিশ বিরোধী' বলে পরিচিত হনবন্ত পোলো খেলা বা বিমানচালনায়ও দক্ষ ছিলেন। উৎসাহী ছিলেন রাজনীতিতেও। ১৯৫২ সালে 'কংগ্রেসের গড়' বলে পরিচিত রাজস্থানের মাটিতে অখিল ভারতীয় রামরাজ্য পরিষদ নামে এক রাজনৈতিক দলও গড়েন তিনি। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন বিধানসভার ভোটেও প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে জানুয়ারিতে ঘটে অঘটন।
২৬ জানুয়ারির ভোরে জুবেইদাকে পাশে বসিয়ে ব্যক্তিগত বিমান চালু করেছিলেন হনবন্ত। সেটিই ছিল তাঁদের জীবনের শেষ দিন। ওই মৃত্যু ঘিরে আজও রহস্য রয়েছে। দক্ষ বিমানচালক হনবন্ত কী ভাবে দুর্ঘটনায় পড়লেন, তা নিয়ে নানা দাবিও রয়েছে। অনেকের দাবি, রাজস্থানের গোড়বাড় এলাকায় অত্যন্ত নিচুতে উড়ছিল বিমানটি। এক সময় টেলিফোনের তার জড়িয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তা।
জুবেইদার প্রথম পক্ষের ছেলের মৃত্যুও ছিল রহস্যময়। ১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল জোধপুরের রাস্তায় গলাকাটা অবস্থায় টুটুর দেহ মিলেছিল। সে খুন আজও রহস্য হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। জনশ্রুতি, জুবেইদা এবং টুটুর অতৃপ্ত আত্মা নাকি জোধপুরের নানা মহলে ঘুরে বেড়ায়। জোধপুর হেরিটেজ স্কুলে ঘুঙুরের আওয়াজও শুনেছেন বলে দাবি অনেকের।
জুবেইদার জীবনকাহিনি নিয়ে কলম ধরেছিলেন পুত্র খালেদ। সাংবাদিক, সিনেমা সমালোচক, চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালক খালেদের চিত্রনাট্যেই তাঁর ‘জুবেইদা’-কে গড়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল।