মঙ্গলবার সকালে শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরে এসে পৌঁছেছে চিনের ‘গুপ্তচর’ জাহাজ ইয়ান ওয়্যাং-৫। এই জাহাজ নিয়ে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ভারত এবং আমেরিকা। জাহাজ না পাঠাতে কলম্বোর তরফেও বেজিংকে অনুরোধ করা হয়। তবু ভ্রুক্ষেপ না করে শ্রীলঙ্কার বন্দরে নোঙর ফেলেছে এই জাহাজ।
ইয়ান ওয়্যাং-৫ জাহাজের শ্রীলঙ্কা পৌঁছনো নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহলে বেশ চর্চা চালু আছে। কী আছে এই জাহাজে, যার কারণে এই জাহাজ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত-আমেরিকা?
হামবানটোটা বন্দর শ্রীলঙ্কায় থাকলেও এর নিয়ন্ত্রণ বেজিংয়ের হাতে রয়েছে বলেও বিভিন্ন জায়গায় দাবি করা হয়েছে। ওই বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে বেজিং। আর এর কারণ শ্রীলঙ্কার তরফে চিনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ। পাশাপাশি এই জাহাজ এমন এক সময়ে শ্রীলঙ্কায় নোঙর ফেলেছে যখন সেই দেশ চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
কী আছে এই রহস্যময় জাহাজে?
ইয়ান ওয়্যাং-৫ জাহাজের ওজন ২৩ হাজার টন। যে কোনও উপগ্রহের উপরেও নজরদারি চালাতে পারে এই চিনা ‘গুপ্তচর’ জাহাজ। পাশাপাশি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হদিস দিতেও সক্ষম এই জাহাজ।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সেন্সর-সহ বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তিযুক্ত এই নজরদারি জাহাজ ভারতের নিরাপত্তায় বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ওড়িশা উপকূলের কাছে ভারতের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার যাবতীয় তথ্য এই জাহাজ হস্তগত করে চিনে নিয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে ভারত।
গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, শ্রীলঙ্কার এই জাহাজের মাধ্যমে তামিলনাড়ু লাগোয়া বিভিন্ন এলাকায় চিন গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করতে পারে।
এই জাহাজটির ৭৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র বিষয়ক গবেষণার তথ্য সহজেই সংগ্রহ করতে পারে এই জাহাজ। এর অর্থ, তামিলনাডুর কালপাক্কাম, কুডানকুলাম-সহ ওই এলাকায় থাকা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারে এই জাহাজ।
কেরল, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ছ’টি বন্দরের উপরেও চিন এই জাহাজের সাহায্যে নজরদারি চালাতে পারবে।
যদিও চিনের দাবি, গবেষণা ও সমীক্ষার কাজে ব্যবহার করার জন্য ইয়ান ওয়্যাং-৫ জাহাজ ব্যবহার করা হয়। এবং এই উদ্দেশ্যেই শ্রীলঙ্কার হামবানটোটো বন্দরে নোঙর করেছে এই জাহাজ।
ইয়ান ওয়্যাং-৫ হল ইয়ান ওয়্যাং সিরিজের তৃতীয় প্রজন্মের নজরদারি জাহাজ। ২০০৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম এই জাহাজ সমুদ্রে নামে। জিয়াংনান শিপইয়ার্ড এই জাহাজটির নির্মাণকারী সংস্থা।
চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির কৌশলী দল এই জাহাজের দায়িত্বে রয়েছে। ইয়ান ওয়্যাং সিরিজের জাহাজগুলির দৈর্ঘ্য ১৫০ থেকে ১৯০ মিটারের মধ্যে। এই জাহাজগুলির গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪০ কিমি।
১৯৬৮ সালে মাও সে তুং ব্যক্তিগত ভাবে ইয়ান ওয়্যাং জাহাজ তৈরির অনুমোদন দিয়েছিলেন। প্রথম দু’টি জাহাজ, ইয়ান ওয়্যাং-১ এবং ইয়ান ওয়্যাং-২ সাংহাইয়ের জিয়াংনান শিপইয়ার্ডে তৈরি করা হয়েছিল। ইয়ান ওয়্যাং-১ জাহাজ সমুদ্রে নামে ১৯৭৭এ-র ৩১ অগস্ট। ইয়ান ওয়্যাং-২ সমুদ্রে নামে এর পরের বছর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর।
চিনের ভূখণ্ডের বাইরে পরীক্ষা করা হচ্ছে এমন ক্ষেপণাস্ত্রের উপর নজরদারি চালানোই এই জাহাজের মূল কাজ।
এর পর ১৯৯৫ সালের ২০ অক্টোবর ইয়ান ওয়্যাং-৩ এবং ১৯৯৯ সালের ১৮ জুলাই ইয়ান ওয়্যাং-৪ জাহাজ দু’টি প্রকাশ্যে আসে।
২০০৭ সালের প্রথমে সাংহাইতে আরও দু’টি ইয়ান ওয়্যাং শ্রেণির জাহাজ চালু করা হয়েছিল।
ইয়ান ওয়্যাং-৫ জাহাজ নিয়ে ভারত এবং আমেরিকার উদ্বেগ প্রকাশের পর চিনা জাহাজের নোঙর স্থগিত করায় গত ৮ অগস্ট ক্ষোভপ্রকাশ করে বেজিং বলেছিল, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কয়েকটি দেশ কলম্বোর উপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। তবে ভারতের নাম উল্লেখ করেনি চিন।
প্রথমে শ্রীলঙ্কার তরফে এই জাহাজ প্রবেশে ছাড়পত্র দেওয়া না হলেও ১২ অগস্ট তাদের জাহাজের নোঙরের ছাড়পত্রের জন্য নতুন করে আবেদন করে চিনা দূতাবাস। জাহাজের প্রবেশের জন্য নতুন সময় দেওয়া হয় ১৬ থেকে ২২ অগস্টের মধ্যে। পর্যালোচনার পরই শ্রীলঙ্কার তরফে এক বিবৃতিতে চিনা জাহাজের নোঙরের ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
এর পর মঙ্গলবার এই চিনা নজরদারি জাহাজ হামবানটোটা বন্দরে নোঙর ফেলেছে। প্রায় দু’হাজার নাবিক নিয়ে এই জাহাজ শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করেছে বলে জানা গিয়েছে।
বিবিধ আপত্তি সত্ত্বেও ইয়ান ওয়্যাং-৫ শ্রীলঙ্কার উপকূলে প্রবেশ করার পরে ভারতের তরফে জানানো হয়েছে, গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে তারা।