বয়সে বড়জোর তিরিশের কোঠায়। প্রত্যেকেই নারী। কেউ বিদেশ থেকে ফিরেছেন, কেউ আবার দেশেই বড় চাকরি ছেড়ে নাড়ির টানে ফিরে এসেছেন গ্রামে। সমাজের কাজে ব্রতী হবেন বলে বেছে নিয়েছেন গ্রাম পঞ্চায়েতকে। আমূল বদল ঘটিয়েছেন শাসনের ধারণায়। কারা এঁরা? এঁরা হলেন দেশের মহিলা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। যাঁরা এক নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পঞ্চায়েত শাসনকে।
ছবি রাজাওয়াত। ৩৬-এর এই তরুণী রাজস্থানের সোডা গ্রামের প্রধান। দেশের মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামী তিনিই।
দেশের অন্যতম বড় টেলি যোগাযোগ সংস্থায় ভাল চাকরি করতেন এক সময়। ছবি সেই চাকরি ছেড়ে গ্রামের কাজ করতে আসেন।
২০১০ সালে সোডার পঞ্চায়েতের মাথায় বসেন ছবি। তার পর থেকে তাঁকে আর আটকে রাখা যায়নি।
প্রযুক্তিতে সিদ্ধহস্ত ছবি গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ, স্বচ্ছ পানীয় জল, পাকা শৌচাগার, বাঁধানো রাস্তা, ব্যাঙ্ক-সহ বহু পরিষেবা নিয়ে এসেছেন।
নিরন্তর কাজই তাঁকে দিয়েছে পরিচিতি। রাজস্থানের গ্রামগুলি বদলে যাওয়া চেহারার কৃতিত্ব এসে জুটেছে তাঁর ঝুলিতেই। তবে ছবি নিজেকে শুধু গ্রামের চৌহদ্দিতে বেঁধে রাখেননি। ২০১১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত দারিদ্র সংক্রান্ত আলোচনা সভায় বক্তৃতাও করেছেন ছবি।
শাহনাজ খান। দেশের কনিষ্ঠতম পঞ্চায়েত প্রধানদের মধ্যে অন্যতম। ২৪ বছর বয়সে হরিয়ানার গরহাজান গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন শাহনাজ।
শাহনাজ তখন চিকিৎসার ছাত্রী। এমবিবিএস শেষ করেছেন সবে। শুরু করেছেন পরবর্তী পর্যায়ের পড়াশোনা।
তাঁর আগে মহিলা গ্রামপ্রধান তো দূর, এত শিক্ষিত কেউ পঞ্চায়েত প্রধান হননি হরিয়ানার ওই এলাকায়। ২০১৮ সালে তাঁকে বেছে নেন গ্রামবাসীরা।
পঞ্চায়েতের দায়িত্ব নিয়েই তিনি প্রথম গুরুত্ব দেন গ্রামের পরিচ্ছন্নতায়। শিশু এবং মহিলারা যাতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকেন সেটি আগে নিশ্চিত করেন শাহনাজ। আরও একটি বিষয়ে নজর দেন তিনি। গ্রামে মেয়েদের যাতে স্কুলে পাঠানো হয়।
সুষমা ভাদু। বয়স ৩২। ইনিও হরিয়ানারই একটি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। নিস্তরঙ্গ গ্রাম্যজীবনে বিপ্লব এনেছিলেন সুষমা।
হরিয়ানার ধানি মিয়া খান গ্রামের নিয়ম, মেয়েরা বিয়ের পর মাথা থেকে কাপড় নামাতে পারবেন না। লম্বা টানা ঘোমটা ঝোলে নাকের গোড়া পর্যন্ত। তিন সন্তানের জননী সুষমা পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়িতে ঘোষণা করেন তিনি ঘোমটা দিতে পারবেন না। কারণ ঘোমটা টেনে পঞ্চায়েত প্রধানের কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে তাঁর।
তার ঠিক পরের সপ্তাহেই তিনি পঞ্চায়েতের বৈঠক ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোমটা টানা নিষিদ্ধ করেন। ২০১২ সালের ২২ জুলাই পঞ্চায়েতের সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন পঞ্চায়েতের সমস্ত মহিলা সদস্যরা। ছিলেন গ্রামের ছাত্রী এবং আশপাশের ২৫টি গ্রামের অঙ্গনওয়ারি কর্মীরা। সবার সামনেই সুষমা জানিয়ে দেন, এই গ্রামে আর মেয়েদের ঘোমটা টানা বাধ্যতামূলক নয়।
অথচ সুষমা উচ্চশিক্ষিত নন। ক্লাস সেভেনেই স্কুলছুট তিনি। কিন্তু মেয়েদের পর্দামুক্ত করার এই সিদ্ধান্তে তাঁর গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এ ছাড়াও গ্রামের সার্বিক পরিচ্ছন্নতা, পুরুষ-নারীর সংখ্যার অনুপাত, স্কুলছুট না হওয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্যও পুরস্কার পায় তাঁর পঞ্চায়েত।
আরতি দেবী। এককালে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার ছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের মাথায় বসেন। এখন তিনি ওড়িশার ধুনকাপাড়ার পঞ্চায়েত প্রধান।
পঞ্চায়েতের দায়িত্ব নিয়েই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন আরতি। তাঁর হাত ধরেই প্রচার পায় ওড়িশার এই এলাকার কারুশিল্প। এমনকি, সরকারের সমস্ত প্রকল্পের সুবিধা যাতে গ্রামের মানুষের হাতে পৌঁছয়, তা-ও নিশ্চিত করেন আরতি।
আরতির কাজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি পায়। তাঁর কথা শোনার জন্য আমেরিকার দূতাবাস তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়।
আটরাম পদ্মা বাই। তেলঙ্গানার যে গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান পদ্মা, সেই গ্রামের মানুষের জীবনধারণের একমাত্র উপায় চাষবাস।
২০১৩ সালে পঞ্চায়েতের দায়িত্ব নেন পদ্মা। তিনি দেখেন, গ্রামের কিছু মানুষ এতটাই দরিদ্র যে তাঁদের কুড়ুল, কাটারি-সহ চাষবাসের জরুরি সামগ্রী কেনার টাকাও নেই।
পদ্মা ৩০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে একটি ব্যবস্থা চালু করেন। প্রথমেই চাষবাষের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে ফেলেন তিনি। তার পর প্রতি দিন নামমাত্র ভাড়ায় সেই সরঞ্জাম তাঁদের ব্যবহার করতে দেন, যাঁদের সে সব কেনার ক্ষমতা নেই। এতে গ্রামের মানুষের হাতে কাজ আসতে শুরু করে।
পদ্মা তাঁর পঞ্চায়েতের অধীনে থাকা তিন গ্রামে ঢালাই করা রাস্তা বানিয়েছেন। সরকারের থেকে পুকুর কাটার অনুমতি নিয়ে সেখানে বৃষ্টির জল জমিয়ে পাম্পের মাধ্যমে গ্রামের স্কুলে স্বচ্ছ পানীয় জলের ব্যবস্থাও করেছেন।
ভক্তি শর্মা। মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের প্রান্তে বারখেড়ি আবদুল্লা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান এই ২৮-এর তরুণী। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার পর আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন ভক্তি। হঠাৎই তাঁর মন বদলায়।
কাকার পরিবারের সঙ্গে টেক্সাসে ছিলেন ভক্তি। মোটা বেতনের চাকরির প্রস্তাবও ছিল। সে সব ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। সমাজের জন্য কিছু করতে চাইছিলেন ভক্তি। ঠিক করেন নিজের গ্রাম থেকেই সেই কাজ শুরু করবেন।
বারখেন্ডি গ্রামের এই কন্যা পঞ্চায়েতের নির্বাচনে নিজের গ্রামে ভোটে দাঁড়ান এবং জিতেও যান। পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে ভক্তি একটিই কাজে মন দেন। গ্রামগুলির জন্য সরকারের যা যা প্রকল্প এবং সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করা। এ ভাবেই তার গ্রাম মডেল গ্রাম পঞ্চায়েত হয়ে উঠবে বলে আশা পরিশ্রমী প্রশাসক ভক্তির।
রাধা দেবী। রাজস্থানের ভারসিয়া গ্রামের প্রধান। ক্লাস ফাইভে স্কুলছুট হন নিজে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রথমেই মন দেন গ্রামের শিক্ষায়।
রাজস্থানের গ্রামগুলিতে হাজারো ছাত্র-ছাত্রী স্কুলছুট হয় প্রতি বছর। নানা প্রকল্প সত্ত্বেও স্কুলে ভর্তি হয় না শিশুরা। রাধা নিশ্চিত করেন, তাঁর অধীনে থাকা স্কুলগুলিতে যেন কেউ স্কুলছুট না হয়। এর পাশাপাশি স্কুলে ভর্তির সংখ্যাও বৃদ্ধি করেন তিনি।
রাধার প্রশাসনে রাজস্থানের এই গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ে। যার পুরো কৃতিত্ব পঞ্চায়েত প্রধান রাধাকেই দিয়েছে প্রশাসন।