পাঁচ বছর পর ইওরোপ সফর করলেন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। প্রথমে ফ্রান্স, তার পর সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরি সফরও করেন তিনি। যা নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে। এশিয়ার অনেক দেশের মতো ভারতের কাছেও বিষয়টি উদ্বেগের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্যারিসে পা রেখেই ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন জিনপিং। কেন এই সফর তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়েছে। যদিও সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই দুই বিশ্ব নেতার মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
তবে অনেকের মতে, জিনপিং-মাকরঁ বৈঠকের অন্যতম বিষয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ফ্রান্স প্রথম থেকেই রাশিয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। চিনও যেন রাশিয়াকে সমর্থন না করে, সেই আবেদনও করা হয়েছে জিনপিংয়ের কাছে।
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে আমেরিকার মতো ইউরোপের অনেক দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেই তালিকায় ফ্রান্সও রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জেও ইউক্রেনের সমর্থনে আওয়াজ তুলেছে তারা। একই সঙ্গে, রাশিয়ার প্রতি চিনের সমর্থন নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছে ইউরোপের দেশগুলি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পরে ২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভ্লামিদির পুতিনের দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চিন।
সূত্রের খবর, রাশিয়া যাতে ইউক্রেনের সঙ্গে বিরোধ মেটানোর পথে হাঁটে, তা বোঝানোর জন্য চিনকে ‘চাপ’ দেওয়া হয়েছে দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকে।
সেই ‘চাপ’ কতটা কাজ দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকেরই। গত বছর চিন সফরে গিয়ে মাকরঁ, জিনপিংকে অনুরোধ করেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে কথা বলার জন্য। ঠিক হয়, জ়েলেনস্কির সঙ্গে দেখা করবেন জিনপিং। কিন্তু তার পরও ছবি বদলায়নি।
এই আবহে জিনপিংয়ের ফ্রান্স সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। কূটনৈতিক মহলের একাংশের মতে, জিনপিংয়ের এই সফর ইউরোপীয় ঐক্যকে খর্ব করার চেষ্টা। তবে বেজিংয়ের দাবি, প্যারিসের সঙ্গে চিনের ১৮টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
জিনপিংয়ের সফরকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের উন্নতির ফল বলেই দাবি করছে বেজিং। কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এই সফরের পরেও ইইউ-চিন সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে সংশয় রয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, চিনের বাজারে ফ্রান্সের ব্যবসা বৃদ্ধি করার বিষয়েও কথা হয়েছে মাকরঁর সঙ্গে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং চিনা বাজারে ব্যবসা— মূলত এই দুই ছিল আলোচ্য বিষয়। তবে ফ্রান্সের দাবি চিন কতটা মানবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জিনপিংয়ের ফ্রান্স সফর কি চিন্তা বৃদ্ধি করল ভারতের? চিনের সঙ্গে ভারতের মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলছেই। সীমান্তে চিনা আগ্রাসন রুখতে তৎপর ভারত। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের পর থেকেই দু’দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে।
তবে গত এক দশকে ভারত-চিন সীমান্তে যে পরিমাণ উত্তেজনা দেখা গিয়েছে, তা অতীতে লক্ষ করা যায়নি। অনেকেই মনে করেন, সীমান্ত নিয়ে বিরোধ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব— এ সবই উত্তেজনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা নিয়েছে।
বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ভারত এবং চিনের মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতাও রয়েছে। ভারত মহাসাগর এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের সঙ্গে নয়াদিল্লি শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। চিনের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে অনেক ক্ষেত্রে। কারণ চিনও ভারত মহাসাগরের ওপর নির্ভরশীল।
আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া-সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ক্রমশ উন্নতি ঘটেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী হলেও চিনের সঙ্গে আমেরিকার মতো দেশগুলির সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে।
শুধু আমেরিকা নয়, ফ্রান্সের সঙ্গেও ভারতের মধুর সম্পর্ক। পরমাণু শক্তি পরীক্ষা হোক বা চিন প্রশ্ন— বহু দশক ধরেই ফ্রান্সকে পাশে পেয়েছে ভারত। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের সমর্থনে ফ্রান্সই প্রথম ভেটো দিয়েছিল।
তা ছাড়া ১৯৭৪ ও ১৯৯৮— এই দু’বছরে ভারতের পরমাণু শক্তি পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ পশ্চিমি দেশগুলি যখন নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাতে যোগ দেয়নি ফ্রান্স।
শুধু তা-ই নয়, ২০২০ সালে চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদের সময় ফ্রান্সই প্রথম ভারতকে সামরিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। অন্য দিকে, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান বজায় রেখে দুই দেশই কখনও পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি।
চিনের সঙ্গে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে কি ভারতের চিন্তা বাড়বে? চিন প্রসঙ্গে অতীতে ফ্রান্স সরকারের সমর্থন পেয়েছে ভারত। চিন যদি ফ্রান্সের দাবি মেনে নেয়, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্যারিসের সমর্থন নিয়ে চিন্তিত নয়াদিল্লি। তবে অনেকের মতে, বাস্তবে চিন কোনও ভাবেই ফ্রান্সের প্রস্তাব মানবে না। ফলে জিনপিংয়ের ফ্রান্স সফর নিয়ে ভারতের চিন্তার কারণ নেই।