বাহিনীতে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি! অনেক গভীরে ছড়িয়ে রয়েছে যার শিকড়। খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া তদন্তে নাকি উঠে এসেছে তেমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। তবে সেখানেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই সেনাকর্তাদের উপর খড়্গহস্ত হচ্ছেন না তো প্রেসিডেন্ট? এই নিয়ে তুঙ্গে জল্পনা।
সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল ডং জুনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে চিনের শি জিনপিং সরকার। একে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না বা সিপিসি) দুর্নীতি-বিরোধী অভিযানের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ডংকে কড়া সাজার মুখে পড়তে হবে।
চিনা ফৌজের পোশাকি নাম ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। একে নিয়ন্ত্রণ করে সিপিসির ‘সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন’ (সিএমসি)। ডংয়ের পাশাপাশি এই সংগঠনটির শীর্ষ সেনা অফিসার মিয়াও হুয়াকে বরখাস্ত করেছে বেজিং। তাঁর বিরুদ্ধেও ‘দলীয় শৃঙ্খলা এবং আইন ভাঙা’র অভিযোগ ওঠার কথা সরকারি ভাবে জানিয়েছে ড্রাগনল্যান্ড।
চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডংয়ের বিরুদ্ধে চলা তদন্তকে নিয়ে বিবৃতি দেন চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং। তিনি একে ‘ছায়ার পিছনে ধাওয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। বেজিং যে পিএলএকে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর, তা এক রকম বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২১ নভেম্বর শেষ বার অ্যাডমিরাল ডংকে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল। লাওসে ‘১১তম আসিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক’-এ বক্তব্য রাখেন তিনি। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিনের সঙ্গে তাঁর দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল করেন অ্যাডমিরাল ডং।
বিষয়টি নিয়ে বলতে গিয়ে নিজের হতাশা লুকিয়ে রাখেননি অস্ট্রিন। তাঁর দাবি, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চলা ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে ডংয়ের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। শুধু তা-ই নয়, বেজিং-ওয়াশিংটন সামরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ডং।
এ বছরের সেপ্টেম্বর প্রথম বার যুক্তরাষ্ট্র এবং পিএলএর মধ্যে কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক হয়। যাকে ‘ইতিবাচক’ বলে উল্লেখ করেন অস্ট্রিন। দীর্ঘ দিন ধরেই তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে মানতে নারাজ বেজিং। একে চিনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করেছে জিনপিং সরকার। অন্য দিকে, দ্বীপরাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার যাবতীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওয়াশিংটন।
এই পরিস্থিতিতে ডংয়ের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগকে সন্দেহের চোখে দেখছেন আমেরিকার সেনাকর্তারা। তাঁদের দাবি, ২০২২ সালে সিএমসির চেয়ারম্যান পদ পাওয়া ইস্তক তাইওয়ান আক্রমণের ছক কষছেন প্রেসিডেন্ট শি। আর তাই শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা অ্যাডমিরাল ডং তাঁর চক্ষুশূল হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনাকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধে নামার আগে সীমাহীন আনুগত্য পেতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং। আর তাই বেছে বেছে বিরোধী চিন্তাভাবনার সেনাকর্তা সরাচ্ছেন তিনি। সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে থাকায় অনায়াসেই এটা করতে পারছেন শি।’’
সূত্রের খবর, তদন্ত শুরু হতেই ডংকে সাসপেন্ড করে চিনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে ২৭ নভেম্বরের পর থেকে এক বারের জন্যেও ডংকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এই নিয়ে পর পর তিন জন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনল জিনপিং সরকার।
গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩-এর ডিসেম্বরে অ্যাডমিরাল ডংকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বভার দেন শি। জেনারেল লি স্যাংফুর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ‘ঘুষের বিনিময়ে নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে সুযোগ-সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ। ফলে মাত্র সাত মাসের মধ্যে পদ ছাড়তে হয় লি-কে।
লি-র আগে টানা পাঁচ বছর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন ওয়েই ফেংহে। দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তিনিও শি-র কোপে পড়েন। সূত্রের খবর, লি এবং ওয়েইয়ের কেলেঙ্কারির জেরে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পিএলএ। বাহিনীর বুনিয়াদি ধাঁচে আঘাত হেনেছে তাঁদের দুর্নীতি। ফলে এ বার দু’জনকেই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে জানা গিয়েছে।
মন্ত্রী হওয়ার আগে পিএলএ রকেট ফোর্সের নেতৃত্বে ছিলেন ওয়েই। অন্য দিকে, ক্ষেপণাস্ত্র-সহ উন্নত হাতিয়ার নির্মাণের বিষয়টি তদারক করতেন লি। ২০২৩ সালে লালফৌজের এই রকেট ফোর্সের বিরুদ্ধেই শুরু হয় তদন্ত। ওই বছরের জুলাই মাসে বাহিনীর পদস্থ কর্তা সান জিনমিং গোয়েন্দাদের রাডারে চলে আসেন।
সাধারণত সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের সদস্যপদ পেয়ে থাকেন চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী। কিন্তু, চলতি বছরের গোড়ায় ডংকে তা দেননি সিএমসির চেয়ারম্যান শি। ফলে তখন থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধছিল। ২০২৩-এর জুলাইতে রকেট ফোর্সের প্রাক্তন প্রধান এবং চিফ অফ স্টাফকে বহিষ্কার করে বেজিং।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সংস্থার শীর্ষপদে থাকা তিন জন পদস্থ কর্তাকে সরিয়ে দেন শি। ২০১২ সাল থেকে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনে এই দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছেন তিনি। এই কমিশনের পাঁচ সদস্যের একজন ছিল মিয়াও। এ বার তাঁকেও বরখাস্ত করলেন জিনপিং।
আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদ সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’-এর প্রতিবেদনে অবশ্য শি-র এ হেন পদক্ষেপের অন্য যুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি, তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর কিংবদন্তি মাও জে দংয়ের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী হতে চাইছেন জিনপিং। পিএলএকে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করার স্বপ্ন রয়েছে তাঁর।
সম্প্রতি পিএলএর উপর দুর্নীতি-বিরোধী অভিযানের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন চিনা প্রেসিডেন্ট। শি বলেছেন, ‘‘দলের প্রতি অনুগত এবং নির্ভরযোগ্যদের হাতেই বন্দুকের নল থাকা উচিত। বাহিনী দুর্নীতিবাজদের লুকোনোর জায়গা নয়।’’ লালফৌজকে আরও শক্তিশালী করতে ‘তীব্র সংশোধন’-এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকর্তারা অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের অনুমান, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক শত্রুদের নিকেশ করছেন শি। আর তাই সেনাকর্তাদের পাশাপাশি সিপিসির বিভিন্ন পদে থাকা জিনপিং নীতির সমালোচকদের ধীরে ধীরে পর্দার আড়ালে যেতে হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, পিএলএতে চলা শি-র এই দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান লালফৌজকে ভিতর থেকে দুর্বল করবে। সেনা অফিসারদের মধ্যে তৈরি হতে পারে সন্দেহের বাতাবরণ। যুদ্ধের সময়ে যার খেসারত দিতে হতে পারে ড্রাগনল্যান্ডকে।
চিনের পরমাণু অস্ত্রাগারের দায়িত্ব রয়েছে পিএলএ রকেট ফোর্সের কাছে। এই বাহিনীতেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একে বিপজ্জনক বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। সে ক্ষেত্রে ঘুষের বিনিময়ে আণবিক হাতিয়ার শত্রুর হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।