গাছের উপর কুড়ুলের কোপ পড়লেই ছোটে ‘রক্তের’ ফোয়ারা। গাছের ভিতর থেকে এমন ভাবে ‘রক্ত’ বেরিয়ে আসে যে, দেখে মনে হয় যেন রক্তমাংসের কোনও জীবকে কেটে ফেলা হচ্ছে। এই ‘রক্ত’ দিয়ে নাকি কঠিন রোগ নিরাময় করা যায়। এই ‘ব্লিডিং ট্রি’র অস্তিত্ব কি সত্যিই রয়েছে না কি রক্ত ঝরে পড়ার কাহিনি সম্পূর্ণ মনগড়া?
কল্পনা নয়, বাস্তবে এমন একটি গাছ রয়েছে যা কাটা হলে তার ভিতর থেকে রক্তবর্ণের এক ধরনের তরল গড়িয়ে পড়তে থাকে। এই গাছটির নাম ড্রাগন ব্লাড।
গাছটির এই নামকরণ এই তরল নির্গত হওয়ার কারণেই। তরলটি হাতে নিয়ে দেখলেও মনে হয় যেন রক্ত লেগে রয়েছে।
ড্রাগন ব্লাড গাছটি সাধারণত উচ্চ তাপমাত্রাতেও জন্মাতে পারে। সাধারণত আরব সাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জে চিরহরিৎ এই বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়।
ইয়েমেনের সকোট্রা দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর পরিমাণে ড্রাগন ব্লাড গাছটি দেখা যায়। এই গাছটি প্রায় ৬৫০ বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারে। ইয়েমেনের জাতীয় গাছ এটি।
ড্রাগন ব্লাড গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম ড্রাকাইনা সিনাবারি। ১০ থেকে ১২ মিটার উচ্চতা হয় এই গাছের। বেরির মতো সুস্বাদু ফলও হয় এই গাছে।
ড্রাগন ব্লাড গাছটি এমন ভাবে বেড়ে ওঠে যে তলার শাখা-প্রশাখাগুলি আকারে ছোট হয় এবং উপরিভাগের শাখাগুলি চওড়া হয়। দূর থেকে এক নজরে দেখলে মনে হবে কেউ যেন মাথার উপর ছাতা খুলে রেখেছেন।
প্রতি তিন থেকে চার বছর অন্তর ড্রাগন ব্লাড গাছ থেকে সমস্ত পাতা ঝরে যায়। এই গাছে বেরি জাতীয় ফল উৎপন্ন হয় যার মধ্যে এক থেকে তিনটি বীজ থাকে।
ড্রাগন ব্লাড গাছের ফল পরিণত হতে শুরু করলে সবুজ থেকে কালো রং ধারণ করে। কমলা বর্ণ ধরলে বোঝা যায় ফল পেকে গিয়েছে। ফল পরিণত হতে মোট পাঁচ মাস সময় লাগে।
ড্রাগন ব্লাড গাছের শাখা-প্রশাখা কাটলে লাল রঙের এক ধরনের রেসিন নির্গত হয়। এই রেসিন ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করেন দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা।
সকোট্রা দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের বিশ্বাস, ড্রাগন ব্লাড গাছ থেকে যে রেসিন নির্গত হয় তা খেলে জ্বর থেকে শুরু করে আলসার জাতীয় রোগ খুব সহজেই সেরে যায়।
অতিরিক্ত তাপমাত্রায় বেড়ে ওঠা ড্রাগন ব্লাড গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বাতাস, মেঘ এমনকি কুয়াশা থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে সঞ্চয় করে রাখা।
তবে দিনের পর দিন ড্রাগন ব্লাড গাছের পরিমাণ কমছে। এই গাছ থেকে নির্গত রেড রেসিন কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয়েরা। রেড রেসিনের কারণেই প্রচুর পরিমাণ গাছ কাটা হচ্ছে বলে জানা যায়।
প্রাচীন কাল থেকে রোগ নিরাময়কারী ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয় ড্রাগন ব্লাড গাছের রেসিন। রং করার জন্যও স্থানীয়েরা এই রেসিন ব্যবহার করেন।
দাঁত মাজার পেস্ট, লিপস্টিকের মতো প্রসাধনী তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় ড্রাগন ব্লাড গাছের রেসিন। আঠারো শতকে ইটালির বেহালাবাদকেরা তাঁদের বাদ্যযন্ত্রকে বার্নিশ করার কাজে ড্রাগন ব্লাড গাছের রেসিন ব্যবহার করতেন। এখনও কিছু ক্ষেত্রে বেহালা বার্নিশ করার জন্য ব্যবহৃত হয় এই রেসিন।
ড্রাগন ব্লাড গাছের রেসিন ছাড়াও এই গাছের পাতা দড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া কৃত্রিম ভাবে মৌচাক তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় এই গাছ।