ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে লোরেন এলাকায় একটি পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে গবেষণা চালাচ্ছিলেন লোরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক। মূলত মিথেন গ্যাসের সন্ধান করছিলেন ওই গবেষকেরা।
ওই পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে মিথেন থাকলেও তা কত পরিমাণে রয়েছে, তা জানতেও উৎসুক ছিলেন গবেষকরা। তবে গবেষকরা ওই কয়লাখনিতে তেমন ভাবে মিথেন খুঁজে পাননি। তার পরিবর্তে তাঁদের হাতে যা এসেছে, তা আরও মূল্যবান। আরও গুরুত্বপূর্ণ।
সে দেশের উত্তর-পূর্বের ওই পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে সাদা হাইড্রোজ়েনের খোঁজ পেয়েছেন ওই গবেষকরা। যা এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাদা হাইড্রোজেনের ভান্ডার হতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
লোরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অনুমান সঠিক হলে, ওই অঞ্চলে মোট ৪৬০ লক্ষ টন সাদা হাইড্রোজ়েন মজুত রয়েছে, যা ইউরোপে পরিবেশে দূষণ সৃষ্টি করতে পারে এমন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে।
কিন্তু সাদা হাইড্রোজ়েন কী? সাদা হাইড্রোজ়েন হল প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েন যা সোনালি হাইড্রোজ়েন নামেও পরিচিত। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এই আণবিক হাইড্রোজ়েন পৃথিবীর বুকে পাওয়া যায়। মূলত ভূগর্ভস্থ জলাধারে এই প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েনের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।
গবেষণাগার বা শিল্পে উৎপাদিত হাইড্রোজ়েনের থেকে প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েন অনেক আলাদা। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস থেকে জলের তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সবুজ হাইড্রোজ়েন তৈরি হয়।
অন্য দিকে ধূসর, বাদামি এবং কালো হাইড্রোজ়েন তৈরি হয় জীবাশ্ম উৎস থেকে। এই সব হাইড্রোজ়েন উৎপন্ন করার সময় কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। এ ছাড়া আরও অনেক ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস এই হাইড্রোজ়েনগুলি উৎপাদনের সময় নির্গমন হয়।
তবে প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েন পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এই হাইড্রোজ়েন দূষণের সৃষ্টি করে না। আর সেই কারণেই এই হাইড্রোজ়েনকে ‘সাদা’ বলা হয়।
পাশাপাশি কারখানায় তৈরি হাইড্রোজ়েন তৈরিতে যে খরচ হয়, প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েনের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। খুব কম খরচেই এই হাইড্রোজ়েন সংগ্রহ করে ব্যবহার করা যায়।
ভবিষ্যতে সাদা হাইড্রোজ়েনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অফুরান শক্তির উৎস হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেই কারণেই এই হাইড্রোজ়েন এত মূল্যবান।
কিন্তু সাদা হাইড্রোজ়েন প্রকৃতিতে এতই কম পরিমাণে পাওয়া যায় যে, তা ব্যবহারের সুযোগ খুবই কম।
লোরেনের পরিত্যক্ত কয়লাখনি ছাড়াও ফ্রান্সে আরও বেশ কিছু জায়গায় সাদা হাইড্রোজ়েনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। ভূবিজ্ঞানী অ্যালাইন প্রিঞ্জোফার এবং এরিক ডারভিল মালি আমেরিকা এবং মালিতে অনেকগুলি ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েনের খোঁজ পেয়েছেন। তবে সেই হাইড্রোজ়েন সে ভাবে ব্যবহার করা যায়নি।
লোরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অনুমান, লোরেনের ওই পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে যে প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েনের ভান্ডার রয়েছে, তা পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বড়। এই হাইড্রোজ়েন ব্যবহার করা যেতে পারেও মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
আর তা হলে ফ্রান্স-সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশের শক্তির চাহিদা সহজেই পূরণ হতে পারে। দর বাড়তে পারে ফ্রান্সের। তবে বিশ্ব দরবারের অন্যতম প্রধান শক্তির উৎস হয়ে ওঠার জন্য আরও অনেক কসরত করতে হবে ফ্রান্সকে।
অনুমান নিশ্চিত করতে ফ্রান্সের গবেষকদের আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। প্রাকৃতিক হাইড্রোজ়েন পুরো এলাকায় সমান ভাবে রয়েছে কি না, তা খুঁজে বার করতে হবে।
ওই পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে তিন হাজার মিটার গভীরে পৌঁছে আরও গবেষণা চালাতে হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা নিশ্চিত হতে চাইছেন যে, ওই গভীরতাতেও সাদা হাইড্রোজ়েন উপস্থিত রয়েছে।
এই গবেষণা চালানোর জন্য ওই গবেষকরা বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছেন। আগামী বছরের শুরুর দিকে আরও অনুসন্ধান করার কথা রয়েছে।