১) মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ইন্দোনেশিয়ার থেকেও পিছিয়ে ভারত। মাথাপিছু আয়ে একজন আমেরিকানের চার ভাগের এক ভাগ আয় করতে আরও ৭৫ বছর সময় লাগবে এক জন ভারতীয়ের। ভারতের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে এই তথ্য।
২) বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪: দ্য মিডল ইনকাম ট্র্যাপ’ রিপোর্ট বলছে, ভারতের মতো দেশগুলির অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর পথে মূল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘মাঝারি আয়ের ফাঁদ’।
৩) বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠি অনুযায়ী যে দেশের প্রত্যেক মানুষ বছরে ৮০০০ ডলার রোজগার করেন, সেই দেশ মাঝারি আয়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ে পড়ে। বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ মানুষই এই মাঝারি আয়ের তালিকাভুক্ত। বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে মাঝারি আয়ের দেশের সংখ্যা ছিল ১০৮। অর্থাৎ এই দেশগুলিতে যে ৬০০ কোটি মানুষ বাস করেন, তাঁদের সকলেরই মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি ১১৩৬ থেকে ১৩,৮৩৫ ডলার।
৪) আমেরিকার মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপির ১০ শতাংশ হল প্রায় ৮০০০ ডলার। বিশ্ব ব্যাঙ্ক বলছে, যে সব দেশের মানুষ বছরে ৮০০০ ডলার রোজগার করেন, সেই সব দেশ বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠিতে মাঝারি আয়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের আওতায় পড়ে।
৫) ‘দ্য মিডল ইনকাম ট্র্যাপ’ চিন, ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ ১০০ টিরও বেশি দেশ মাঝারি আয়ের দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলে বিশ্ব অর্থনীতিতে উপরের দিকে উঠতে গুরুতর বাধার সম্মুখীন হবে। কারণ বর্তমানে ওই সব দেশে তিন জনের মধ্যে দু’জনই হতদরিদ্রের তালিকাভুক্ত।
৬) বিশ্ব ব্যাঙ্কের সদ্য প্রকাশিত তালিকায় ২০২৪-২৫ সালে ভারত রয়েছে তৃতীয় পর্যায়ে, নিম্ন-মধ্য আয়সম্পন্ন দেশ হিসাবে। ২০০৬ সাল থেকে ভারতের এই অবস্থান বদলায়নি।
৭) বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠিতে ভারতের মতো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশও এই তৃতীয় ধাপেই রয়েছে। নিম্ন-মধ্য আয়সম্পন্ন শ্রীলঙ্কাও।
৮) আয়ের নিরিখে ভারত এখনও তৃতীয় স্থান থেকে নিজেদের তুলে আনতে ব্যর্থ। মোদী সরকারের জোরালো দাবি, আগামী ছ’বছরের মধ্যেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে ভারত। কিন্তু সেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শরিক হতে পারবেন মাত্র ১০ কোটি মানুষই। কারণ, ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১০ কোটি লোকের বার্ষিক আয় আমেরিকার নাগরিকের সমান।
৯) স্বাধীনতার পর ভারতের বার্ষিক জিডিপি দ্রুত বাড়লেও বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে আমেরিকার বার্ষিক জিডিপির এক-চতুর্থাংশ ছুঁতেই ক়য়েক দশক পেরিয়ে যাবে, এমনটাই আশঙ্কা বিশ্ব ব্যাঙ্কের। কারণ হিসাবে বিশ্ব ব্যাঙ্ক বলছে, ব্যক্তি ধরে আয় বাড়ালে হবে না। গোটা দেশের মানুষের আয় বাড়াতে হবে।
১০) নব্বইয়ের দশকে চিন ভারতের মতোই নিম্ন আয়ের দেশ ছিল। কিন্তু এখন ভারতকে টপকে বেশ কিছুটা এগিয়ে পড়শি দেশ। মধ্য আয়ের দেশ হতে চিনের লাগবে আর ১০ বছর। এমনকি ইন্দোনেশিয়াও ভারতের ৫ বছর আগে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে বলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের অনুমান।
১১) ১৯৯০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ৩৪টি মাঝারি আয়ের দেশ উচ্চ আয়ের শ্রেণিতে উন্নীত হতে পেরেছে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই তালিকায় তাৎপর্যপূর্ণ উত্থান ঘটেছে রাশিয়ার।
১২) রাশিয়া এত দিন উচ্চ-মধ্য আয়সম্পন্ন দেশ ছিল। এ বার উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে আমেরিকার পাশাপাশি নাম রয়েছে রাশিয়ার। এ ছাড়াও সৌদি আরব, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, স্পেন, ইটালি, পোল্যান্ড-সহ ইউরোপের আরও অনেক দেশ উচ্চ আয়ের দেশ বলে পরিচিত।
১৩) ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪: দ্য মিডল ইনকাম ট্র্যাপ’-এ দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণকে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১২০০ ডলার, ২০২৩ সালে যা বেড়ে ৩৩০০০ ডলারে পৌঁছে গিয়েছে।
১৪) প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের আয়ের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রস্তুত করে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। গত ১৮ বছর ধরে তালিকায় ভারতের কোনও নড়চড় হয়নি। একই অবস্থানে রয়ে গিয়েছে নয়াদিল্লি।
১৫) বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের প্রত্যেকের বার্ষিক গড় আয়ের ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাঙ্ক বিশ্বের সমস্ত দেশকে উচ্চ, উচ্চ-মধ্য, নিম্ন-মধ্য এবং নিম্ন আয়সম্পন্ন দেশ হিসাবে নির্ণয় করে। যে দেশের এক জন সাধারণ নাগরিক সারা বছরে গড়ে ৯৫,৫৫০ টাকা বা তার কম (১১৪৫ ডলারের কম) রোজগার করেন, সেই দেশকে নিম্ন আয়সম্পন্ন দেশের তালিকায় রাখা হয়।
১৬) মাঝারি দেশগুলির পক্ষে বিশ্ব অর্থনীতিতে উপরের দিকে উঠে আসা কঠিন হবে বলে মত বিশ্ব ব্যাঙ্কের। মাঝারি আয়ের দেশগুলি থেকে বিশ্ব অর্থনীতির ৪০ শতাংশের বেশি জিডিপি এলেও মাঝারি আয়ের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার কারণ জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা ও শ্রমে অদক্ষতা। পরিবেশ দূষণ ও কার্বন নিঃসরণকেও আর্থিক উন্নতিতে বড় বাধা বলে ধরা হয়ে থাকে।
১৭) কী উপায়ে ‘মাঝারি আয়ের ফাঁদ’-এর বিপদ কাটিয়ে উঠবে অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলি, তার বেশ কিছু দাওয়াই বাতলে দিয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। তারা জানিয়েছে, উচ্চ আয়সম্পন্ন দেশের তালিকায় নাম তুলতে গেলে আনতে হবে অর্থনৈতিক নীতিতে আমূল সংস্কার।
১৮) নিম্ন আয়সম্পন্ন দেশগুলিকে আপাতত শুধুমাত্র বিনিয়োগের দিকেই নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। যে সব দেশ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে তাদের শুধুমাত্র বিনিয়োগের ওপর ভরসা করে থাকতে বারণ করেছে তারা। বিনিয়োগ ও বিদেশি উন্নত প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই বিপদ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক।