দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে সন্দেশখালির গ্রামবাসীদের। তাই রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। নেপথ্যে রয়েছেন এলাকার মহিলারা। টানা তিন দিন ধরে পথে নেমেছেন এলাকাবাসী, দাবি একটাই শাহজাহান শেখ, শিবু ও উত্তম সর্দারের গ্রেফতারি। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখে নাজেহাল সাধারণ জনজীবন।
চলতি সপ্তাহের বুধবার রাতে শিবুর একটি পোলট্রি ফার্মে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার সকালে আবার সেই উত্তেজনা ছড়াল সন্দেশখালিতে। কাটারি, দা, বাঁশ, লাঠি হাতে শুক্রবারও পথে নেমেছেন মহিলারা।
শাহজাহান, শিবুদের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের অভিযোগ, গ্রামে অত্যাচার চালান তাঁরা। জোর খাটিয়ে গ্রামবাসীদের দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে। জমির জবরদখল থেকে শুরু করে একাধিক অত্যাচারের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে।
বৃহস্পতিবার সন্দেশখালিতে শাহজাহানদের গ্রেফতারির দাবিতে যাঁরা পথে নেমেছিলেন, তাঁরা নিজেদের তৃণমূল সমর্থক বলেই দাবি করেছিলেন।
তাঁদের অভিযোগ, দলের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান শাহজাহান, শিবু, উত্তম এবং তাঁদের সহযোগীরা।
শুক্রবার সেই বিক্ষোভই আবার দেখা গেল জেলিয়াখালিতে। তৃণমূল নেতার পোলট্রি ফার্ম জ্বালিয়ে দিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার অভিযোগ, ওই ফার্ম তাঁদের জমি দখল করে তৈরি করা হয়েছিল।
শুক্রবার সকাল থেকে এলাকায় ছিল ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা। অন্যান্য দিনের তুলনায় সন্দেশখালির চেহারা কিছুটা অন্য রকম। খুব বেশি দোকানপাটও খোলেনি। অশান্তি এড়াতেই খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোচ্ছেন না মানুষ।
বিক্ষোভে শামিল মহিলারা জানান, তাঁদের স্বামীদের জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কাজ করার পর মেলে না প্রাপ্য পারিশ্রমিক। টাকা চাইতে গেলে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ শিবুদের বিরুদ্ধে। দেখা যায়, আগুন যাতে না নিভে যায়, তা নিশ্চিত করতে ফার্মের আগুনে খড়ের বান্ডিল ছুড়ে মারছেন উন্মত্ত জনতা।
গ্রামবাসীদের দাবি, দীর্ঘ দিনের চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সন্দেশখালির এই বিক্ষোভ। যে কোনও প্রকারেই হোক শিবু, শাহজাহান, উত্তমদের গ্রেফতার করতে হবে বলে জানান তাঁরা।
তৃণমূল নেতা শাহজাহানকে দীর্ঘ দিন ধরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৫ জানুয়ারি রেশন ‘দুর্নীতি’ মামলায় তল্লাশি চালাতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল ইডি। সে দিন শাহজাহানের অনুগামীদের হাতে ইডি আধিকারিকেরা মার খেয়েছিলেন।
পরে অবশ্য আর এক দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে তালা ভেঙে তল্লাশি চালিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু বাড়ি থেকে পাওয়া যায়নি।
ইতিমধ্যে ইডি শাহজাহানকে দু’বার তলব করেছে। তিনি দু’বারই হাজিরা এড়িয়েছেন। যদিও আদালতে আগাম জামিনের আবেদন জানিয়েছেন একাধিক বার।
সেই থেকে শাহজাহান ‘নিখোঁজ’। গ্রামবাসীদের দাবি, শাহজাহান এলাকাতেই আছেন। পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে চলেছে।
বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর সন্দেশখালিতে দু’পক্ষের পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দু’টি এফআইআরও দায়ের করা হয়েছে।
গ্রামবাসীরা যাঁকে গ্রেফতার করতে বলছেন, সেই শিবু সন্দেশখালি থানায় বৃহস্পতিবার ১১৭ জন বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন বলে খবর। পাল্টা তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের তরফেও একটি এফআইআর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবারের ঘটনার প্রেক্ষিতে এবং শাহজাহানের গ্রেফতারি চেয়ে শুক্রবার সন্দেশখালি থানায় ডেপুটেশন জমা দেওয়ার কথা সিপিএমের।
রুখে দাঁড়িয়েছেন অত্যাচারিত গ্রামবাসী। শাহজাহানের গ্রেফতারির দাবিতে থানাও ঘেরাও করা হয়েছিল। রাস্তার উপর বাঁশ, লাঠি, হাতা, খুন্তি হাতে বসে পড়েছিলেন মহিলারা।
বিক্ষুব্ধদের দাবি, শাহজাহান এলাকাতেই আছেন। পুলিশই তাঁকে নিরাপত্তা দিচ্ছে!
মাসখানেক আগে শাহজাহানের সমর্থনেই ইডির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রূপ দেখা গিয়েছিল এই সন্দেশখালিতে। শাহজাহানের অনুগামীরা ইডি আধিকারিকদের উপর হামলে পড়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল কয়েক জনকে। এক মাসের ব্যবধানে সন্দেশখালির ভিন্ন রূপ দেখছে বাংলা।
দিকে দিকে বিক্ষোভ এবং জনরোষে এলাকা জুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে সন্দেশখালির মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জীবনে।
অশান্ত পরিস্থিতি এবং এলাকায় যানবাহনের অভাবের কারণে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছনোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে। অনেকে সঠিক সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে পারছে না। তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, ‘পরীক্ষা দিতে যেতে পারব তো’?
গত ২ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক শুরু হয়েছে। সেই অর্থে মাধ্যমিক পরীক্ষা, পড়ুয়াদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সন্দেশখালি।
আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যেই মাধ্যমিক দিতে যেতে হচ্ছে সন্দেশখালির পরীক্ষার্থীদের। আবার যদি পরিস্থিতি বিগড়ে যায়! সেই ভয়ে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়িও ফিরতে হচ্ছে তাড়াতাড়ি।
ভয়ের আবহে তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছে না বলেও সন্দেশখালির মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের দাবি। তাদের এখন একটাই দাবি, শান্তি ফিরুক এলাকায়।
সন্দেশখালির এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর কথায়, ‘‘সন্দেশখালিতে খুব মারপিট হচ্ছে। ঠিক মতো পড়াশোনা করতে পারছি না। পরীক্ষাও ভাল হচ্ছে না। আমরা চাইছি এ সব বন্ধ হয়ে যাক।’’