কারও পার্কিনসন্স হতে পারে, আগে থেকেই আঁচ করতে পারতেন তিনি। গন্ধ শুঁকে। প্রথমে বিশ্বাস করেননি চিকিৎসকেরা। পরে জয় মিল্নের এই বিশেষ ক্ষমতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে রীতিমতো হতবাক হয়ে যান চিকিৎসকেরা। বিজ্ঞানীরা তাঁর এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আবিষ্কার করেন পারকিনসন্স নির্ণয় করার পরীক্ষা।
৭৩ বছরের জয় স্কটল্যান্ডের পার্থের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন নার্স। বরাবরই তাঁর ঘ্রাণশক্তি খুব তীক্ষ্ণ। তা যে এতটা ভয়ঙ্কর, ভাবতেও পারেননি জয় নিজে। এমনকি বিজ্ঞানীরাও। গন্ধ শুঁকে তিনি বলতে পারেন আসন্ন আশঙ্কার কথা। বলতে পারেন, কার পারকিনসন্স রয়েছে বা কার হতে পারে।
জয়ের বয়স তখন ১৬ বছর। স্বামী লেসের বয়স ১৭ বছর। হাই স্কুলে পড়ার সময় দু’জনের দেখা হয়। তার পর ভাল লাগা। প্রথম বার লেসের গায়ের গন্ধই আকৃষ্ট করেছিল জয়কে। শুরু হয়ে ছিল সম্পর্ক। কলেজ পাশ করে নার্স হন জয়। চিকিৎসক হন লেস। বিয়ে করেন দু’জন। তিন ছেলের জন্ম দেন জয়। সুখের সংসার ছিল তাঁদের।
লেসের বয়স তখন ৩৩ বছর। তারও ১২ বছর পর পারকিনসন্স ধরা পড়ে তাঁর। মস্তিষ্কের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ওই ৩৩ বছর বয়সে কোনও লক্ষণই ছিল না লেসের। সেই সময় থেকেই জয় কেমন যেন গন্ধ পেতেন তাঁর গায়ে।
‘যে মহিলা পারকিনসন্স শুঁকতে পারেন’— এই নামেই পরিচিত জয়। বিজ্ঞানীরাও খুঁজতে শুরু করেন, ঠিক কী গন্ধ পান তিনি পারকিনসন্স রোগীদের মধ্যে। সে ভাবে কি আদৌ স্নায়ুর এই রোগ ধরা সম্ভব? শুরু হয় গবেষণা।
অনেক বছর পর ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা জয়ের এই গুণকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করেন পারকিনসন্স নির্ণয়ের পরীক্ষা। ঘাড় থেকে রস (সোয়াব) সংগ্রহ করা হয়। সেই নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায়, ওই ব্যক্তি পারকিনসন্স আক্রান্ত কি না। তবে এই নিয়ে এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এখনও পারকিনসন্স নির্ণয়ের সঠিক কোনও পদ্ধতি নেই। রোগীদের উপসর্গ দেখেই চিকিৎসকেরা এই রোগ নির্ণয় করেন।
জয়ের দাবি, ক্যানসার বা ডায়াবিটিসের মতো পারকিনসন্সও যদি আগে নির্ণয় করা যায়, তা হলে আরও ভাল চিকিৎসা করা সম্ভব। রোগীরা আরও একটু ভাল ভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। ব্যায়াম এবং খাদ্যাভাসে পরিবর্তনই পারকিনসন্স রোগীকে কিছুটা ভাল রাখতে পারে।
গন্ধ শুঁকে পারকিনসন্স হয়েছে কি না, বুঝতে পারেন জয়। গন্ধ আর পারকিনসন্স, এই দুইয়ের মধ্যে কী সম্পর্ক, এই নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলে গবেষণা। ত্বক থেকে এক প্রকার তেল নিঃসৃত হয়, যাকে বলে সিবাম। চিকিৎসকেরা মনে করেন, পারকিনসন্স হলে এই সিবামে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে তার গন্ধ পাল্টে যায়।
জয় সত্যিই সেই গন্ধ চিনতে পারেন কি না, বোঝার জন্য একটি পরীক্ষা করেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টিলো কুনাথ। জয়কে পারকিনসন্স রোগীদের পরা বেশ কয়েকটি টিশার্ট দেওয়া হয়। পারকিনসন্স নেই, এমন লোকজনেরও টিশার্ট দেওয়া হয়।
জয় গন্ধ শুঁকে শুঁকে বলে দেন, কোন টিশার্টের মালিকের পারকিনসন্স রয়েছে। আরও একটি টিশার্ট শুঁকে বলেন, সেই ব্যক্তিরও রয়েছে পারকিনসন্স। দেখা যায়, ওই ব্যক্তির পারকিনসন্স নেই। কিন্তু ওই পরীক্ষার আট মাস পর তাঁর রোগ ধরা পড়ে।
সেবামে কোন রাসায়নিকের কারণে পারকিনসন্স রোগ নির্ণয় করতে পারছেন জয়, তা খুঁজতে শুরু করেন গবেষকেরা। ৭৯ জন পারকিনসন্স রোগী এবং ৭১ জন সাধারণ মানুষের ঘাড়ের সোয়াব সংগ্রহ করে পরীক্ষা শুরু হয়।
২০১৯ সালে সেই রাসায়নিকের খোঁজ পান ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। চেষ্টা করেন, গবেষণাগারেও যাতে সেই পরীক্ষা করা যায়।
অধ্যাপক কুনাথের সঙ্গে এই গবেষণায় ছিলেন অধ্যাপিকা পারডিট্টা বারান। তিনি জানান, এখনও পর্যন্ত এই রোগের কোনও চিকিৎসা নেই। তবে আগেভাগে ধরা পড়লে রোগী এবং চিকিৎসকেরা আরও আগে সতর্ক হতে পারবেন।
পারডিট্টা জানান, তাঁরা গবেষণাগারে যে পরীক্ষা করে সফল হয়েছেন, তা হাসপাতালেও যাতে করা যায়, সেই চেষ্টাই চলছে। এখন গ্রেটার ম্যানচেস্টারে প্রায় ১৮ হাজার রোগীর স্নায়ুরোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের পারকিনসন্স রয়েছে। রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু হতে দু’বছর লাগবে।
পরীক্ষা করে আগেভাগে যদি ওই স্নায়ুরোগীদের রোগ নির্ণয় করা যায়, তা হলে অনেক আগেই শুরু করা যাবে চিকিৎসা। জয় অনেক সময়ই দোকান বা শপিং মলে গিয়ে আশপাশের মানুষের মধ্যে সেই গন্ধটা পান, যা পারকিনসন্স রোগীর থাকে। তাঁরা এখন সুস্থ। কিন্তু জয় বুঝতে পারেন, ভবিষ্যতে থাবা বসাবে ভয়ঙ্কর সেই রোগ।
কিন্তু জয়কে গবেষকেরা বারণ করে দিয়েছেন। কারও মধ্যে পারকিনসন্সের ‘গন্ধ’ পেলেও তাঁকে বলা যাবে না। ভবিষ্যতে হয়তো এ ভাবে হাটে-বাজারে গিয়ে কেউ জানতে পারবেন, তাঁর পারকিনসন্স হতে পারে ভবিষ্যতে। কিন্তু এখন নয়।
পারকিনসন্সের পাশাপাশি জয় ক্যানসার, টিবির মতো রোগও শুঁকে নির্ণয় করতে পারেন কি না, তা-ও গবেষণা করে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁর এই অদ্ভুত ঘ্রাণশক্তিকে আরও বেশি করে কাজে লাগাতে চাইছেন তাঁরা।