ছোট, বড় নানা আকারের বোতলে সাজানো কালো তরল। দেখলেই যেন তৃষ্ণায় শুকিয়ে আসত গলা। গ্রীষ্মের দুপুরে তেমন একটি বোতল হাতে পাওয়া মানে যেন স্বর্গকে ছুঁয়ে ফেলা।
ক্যাম্পাকোলার নাম এখন হয়তো অনেকেই ভুলেছেন। তরুণ প্রজন্মের অনেকে এর নামই শোনেননি। কিন্তু সত্তর এবং আশির দশকে এই ঠান্ডা পানীয়টিই ‘গরম’ করে রেখেছিল দেশের বাজার। আট থেকে আশি, সকলেরই পছন্দ ছিল ক্যাম্পাকোলা।
আশির দশকের অন্যতম জনপ্রিয় এই দেশি পানীয়টি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। তার জায়গায় বাজার দখল করে বিদেশি পেপসি এবং কোকাকোলা। ক্যাম্পাকোলার নাম ক্রমশ মুছে যায় মানুষের মন থেকে।
কিন্তু সেই হারানো নস্ট্যালজিয়াকেই নতুন মোড়কে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে রিলায়্যান্স। নেপথ্যে মুকেশ অম্বানী। গত বছর তারা নয়াদিল্লির ‘পিওর ড্রিঙ্কস’ গ্রুপের কাছ থেকে ক্যাম্পাকোলার স্বত্ব কিনে নিয়েছে।
অম্বানীদের পরিকল্পনা, এই হারানো ঠান্ডা পানীয়ের ব্র্যান্ডটিকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনবেন তাঁরা। দেশীয় তরলের মাধ্যমেই টক্কর দেবেন আমেরিকার পেপসি এবং কোকাকোলার সঙ্গে।
সংবাদ সংস্থা ইকোনমিক টাইমস সূত্রে খবর, ক্যাম্পাকোলার ব্র্যান্ড কিনতে প্রায় ২২ কোটি টাকা খরচ করেছে রিলায়্যান্স। কোলা, লেবু এবং অরেঞ্জ, আপাতত তিনটি স্বাদে ক্যাম্পাকোলা ব্র্যান্ডের পানীয় তৈরি করছে তারা।
গুজরাতের স্থানীয় একটি পানীয়ের ব্র্যান্ড সোসিয়ো। দেশের অন্যান্য প্রান্তে এই ব্র্যান্ড তেমন জনপ্রিয় নয়। তবে গুজরাতে এটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছিল। ক্যাম্পাকোলার সঙ্গে সোসিয়োকেও কিনে নিয়েছে রিলায়্যান্স।
গত বছর অগস্ট মাসে, ক্যাম্পাকোলা ব্র্যান্ড কেনার সময় রিলায়্যান্স রিটেল ভেঞ্চারের ডিরেক্টর তথা মুকেশের কন্যা ইশা অম্বানী জানান, এই ব্র্যান্ডের ছাতার তলায় উচ্চমানের তরল পানীয় তৈরি করবেন তাঁরা। যা দামেও হবে সস্তা। ক্যাম্পাকোলার হাত ধরে ভারতীয়দের প্রতি দিনের চাহিদা পূরণ করতে পারে, এমন পানীয় বাজারে আনতে চলেছে রিলায়্যান্স।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসায় রিলায়্যান্স নতুন নয়। জিয়ো মার্ট নামে তাদের নিজস্ব একটি অনলাইন কেনাবেচার প্ল্যাটফর্মও রয়েছে, যেখানে সক্রিয় ক্রেতার সংখ্যা ৫০ লক্ষের বেশি। শুধু ২০২২ সালেই সারা দেশে আড়াই হাজার দোকান খুলেছে রিলায়্যান্স রিটেল। তাদের মোট দোকানের সংখ্যা এখন ১৫ হাজার।
তবে কোকাকোলা এবং পেপসিকে ফিকে করে ক্যাম্পাকোলার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার অম্বানীদের কাছে চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে বলেই মনে করছেন অনেকে। কারণ, নব্বইয়ের দশক থেকে ওই দুই ব্র্যান্ড ভারতে পানীয়ের বাজারে একপ্রকার স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছে। শুধু ভারতেই নয়, কোক আর পেপসির রমরমা বিশ্ব জুড়ে।
ভারতে ঠান্ডা পানীয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৪৯ সালে প্রথম ঠান্ডা পানীয় হিসাবে দেশে আত্মপ্রকাশ করেছিল পারলে কোলা। প্রায় একই সময়ে ভারতের বাজারে মিলত আমেরিকান কোকও।
১৯৭৭ সালে ভারত সরকার বিদেশি পানীয়ের বাণিজ্যে কিছু আইনি বিধিনিষেধ আরোপ করে। সেই সময় ভারত ছেড়ে চলে যায় কোক। বদলে মাথাচাড়া দেয় লিমকা, থাম্বস্ আপ, ক্যাম্পাকোলার মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলি। তারা দেশের বাজারে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু ১৯৯৩ সালে ভারতে বিদেশি সংস্থাগুলির বাণিজ্যে বিধিনিষেধ উঠে যায়। ফিরে আসে কোক। লিমকা, থাম্বস্ আপের মতো ছোট ব্র্যান্ডগুলিকে কিনে নেয় কোকাকোলা। ভারতের বাজারে তারাই ছেয়ে যায়।
১৯৯৯ সালে বাজারে নতুন সদস্য হিসাবে আগমন ঘটে পেপসির। তাদের বিজ্ঞাপনী আস্ফালনের মাঝে ক্রমে ঢাকা পড়ে যায় ক্যাম্পাকোলা এবং অন্য দেশীয় পানীয় সংস্থাগুলি।
মুকেশ অম্বানীর হাত ধরে আবার ক্যাম্পাকোলা এবং সোসিয়ো ব্র্যান্ডের উত্থান ঘটতে চলেছে। মনে রাখতে হবে, দু’টি ব্র্যান্ডই প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। এই ব্র্যান্ডের পানীয় জিয়ো মার্টের ৫০ লক্ষ ক্রেতার কাছে সহজেই পৌঁছে দিতে পারবে রিলায়্যান্স।
দেশে আরও ৫০ লক্ষ রিটেল স্টোর বা বিপণন কেন্দ্র রয়েছে রিলায়্যান্সের। ক্যাম্পাকোলাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এই সব দোকানও তারা ব্যবহার করতে পারবে সহজেই। এ ছাড়া, বিজ্ঞাপনে বাজিমাতের ক্ষমতাও রয়েছে দেশের অন্যতম ধনকুবের অম্বানীর।
টেলিকম সংস্থা রিলায়্যান্স জিয়োর হাত ধরে টেলিফোনের দুনিয়ায় আধিপত্য কায়েম করেছেন অম্বানী। ভোডাফোন, এয়ারটেলের একচ্ছত্র বাজারে ভাগ বসিয়েছে জিয়ো। এক সময় তা বাজারের অধিকাংশই দখল করে নিয়েছিল।
যে কৌশলে জিয়োকে অম্বানীরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন, তেমন ভাবেই ক্যাম্পাকোলাকেও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, আশাবাদী সংস্থা। সে ক্ষেত্রে, আগামী দিনে ক্যাম্পাকোলা হয়ে উঠতেই পারে রিলায়্যান্সের ‘জিয়ো ২.০’।
তবে বাজার বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন যে, জিয়োর ক্ষেত্রে যে পথ অম্বানী পেয়েছিলেন, সেই পথ এখন সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে পেপসি, কোকাকোলার মতো বড় সংস্থার কাছে। তাই খুব সহজে এই ‘যুদ্ধ’ জেতা যাবে বলে মনে করছেন না অনেকেই।