Germany

Wilhelm Gustloff: সমুদ্রের বরফজলে জমে মারা যান হাজার হাজার মানুষ, এই জাহাজডুবি টাইটানিকের চেয়েও ভয়ঙ্কর

‘অপারেশন হ্যানিবল’ চলাকালীন রাশিয়ান এস-১৩ সাবমেরিনের টর্পেডো আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় ‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২২ ১২:০১
Share:
০১ ২৫

সাল ১৯৪৫। এই সময়েই বাল্টিক সাগরের মাঝে যাত্রিবোঝাই জাহাজ তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের মুখে পড়ে। টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটি মাঝসমুদ্রে ডুবে যায়। সমুদ্রের বরফজলে জমে মারা গিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। ‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’ জাহাজডুবির ঘটনা আজও বিভীষিকাময়।

০২ ২৫

‘টাইটানিক’। সেই সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ। এই জাহাজ দেখার জন্য বন্দরে ভিড় করেছেন মানুষ। ১৯১২ সালে বিশ্ববাসীকে অবাক করে প্রথম যাত্রা শুরু করে ‘টাইটানিক’। কিন্তু এটাই যে তার শেষ যাত্রা হবে তা কে জানত। হিমবাহের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে যায় জাহাজটি। এই দুর্ঘটনায় মারা যান দেড় হাজার জন। তবে জাহাজডুবির এই ঘটনার তিন দশক পর বাল্টিক সাগরের বুকে আরও এক জাহাজডুবি ঘটে যা ‘টাইটানিক’-এর থেকেও ভয়ঙ্কর।

Advertisement
০৩ ২৫

‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’। ২০৮.৫ মিটার লম্বা ও ২৩.৫৯ মিটার চওড়া এই বিশাল জাহাজটি বিলোম অ্যান্ড ভস শিপইয়ার্ডের তরফে তৈরি করা হয়েছিল। এই জাহাজটি মূলত নাৎসিদের একটি বিশেষ দলের বিনোদনের কথা ভেবে বানানো হয়েছিল।

০৪ ২৫

এই জাহাজটির নামকরণ হিটলারের নামে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও তা পরে সুইস শাখার নাৎসি দলনেতা ভিলহেল্মের নামে রাখা হয়। প্রায় ২৩ কোটি কেজি ওজনের এই জাহাজটি ১৯৩৮ সালে যাত্রা শুরু করে। ৪০০ জন ক্রু সদস্য-সহ এই জাহাজটির মোট ১,৯০০ যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল।

০৫ ২৫

প্রথমে ক্রুজ জাহাজ হিসাবে এই জাহাজটি ব্যবহার করা হত। নাৎসি দলের সদস্যদের মধ্যে কেউ কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে এই ক্রুজটি সেজে উঠত। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩৮ সালের ১০ এপ্রিল এই জাহাজটি ভোটকেন্দ্র হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। অস্ট্রিয়ার সংযোজন নিয়ে ইংল্যান্ডের জার্মান এবং অস্ট্রীয় নাগরিকেরা এই জাহাজেই ভোট দিতে এসেছিলেন।

০৬ ২৫

পরে জার্মান সেনাবাহিনীর পরিবহণকারী জাহাজ হিসাবে ব্যবহৃত হত ‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নরওয়ে এবং বাল্টিক সাগরে এই জাহাজটিকে হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছিল।

০৭ ২৫

১৯৪০ সালের নভেম্বর মাস থেকে এই জাহাজটি পোল্যান্ডে ঠাঁই নিয়েছিল। দ্বিতীয় ডুবোজাহাজ প্রশিক্ষণ ডিভিশনের সেনাছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল এই জাহাজ। পরিস্থিতি অনুযায়ী, বার বার নিজের ভূমিকা বদলেছিল এই সুবিশাল জাহাজ। ১৯৪৫ সালে এক ভয়ানক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় ‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’।

০৮ ২৫

বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তখন নিজের নাম লিখতে শুরু করেছে ‘অপারেশন হ্যানিবল’। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ভয়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে অনেকে তখন একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বন্দরে জাহাজের সারি। যাত্রীদের ভিড় উপচে পড়ছে। সেই সময় আবার নিজের ভূমিকা বদলে যাত্রিবাহী জাহাজে পরিণত হয় ভিলহেল্ম।

০৯ ২৫

ঘোষণা করা হয়, যাত্রীদের নিয়ে রওনা হবে বলে ২৫ জানুয়ারি এই জাহাজটি বন্দরে এসেছে। প্রচারের চার দিনের মধ্যেই দেখা যায়, ৭,৯৫৬ জন যাত্রী নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। যে জাহাজটি ২,০০০ যাত্রী বহনে সক্ষম, তাতে ওঠার টিকিট কেটেছিলেন তার প্রায় চার গুণ মানুষ!

১০ ২৫

৩০ জানুয়ারি দুপুরবেলা আনুমানিক ১০ হাজার যাত্রী নিয়ে জার্মানির ক্রিয়েগসমেরিন বেসের অন্তর্গত কিয়েলের উদ্দেশে রওনা হয়। জাহাজের প্রতিরক্ষার জন্য দু’টি টর্পেডো বোট এবং আরও একটি ছোট জাহাজ যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেই ছোট জাহাজে সেনাবাহিনীর লোকজন থাকবে বলে ঠিক করা হয়।

১১ ২৫

কিন্তু সেই ছোট জাহাজটিতে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। এ ছাড়াও একটি টর্পেডো বোটকে কোনও কারণে ফিরে যেতে হয়। অবশেষে একটি টর্পেডো বোট নিয়েই রওনা হয় ‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’। দুপুর পেরিয়ে যত অন্ধকার বাড়তে থাকে, জাহাজের ক্যাপ্টেনের চিন্তাও বাড়তে থাকে পাছে শত্রু আক্রমণ করে।

১২ ২৫

ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক পিটারসন নির্দেশ দেন, মাঝসমুদ্রে জাহাজ নিয়ে যেতে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকলেও সোভিয়েত আক্রমণের হাত থেকে বাঁচা যাবে। জাহাজে যে সেনা কম্যান্ডার ছিলেন, তিনি ক্যাপ্টেনের এই নির্দেশে রাজি হননি।

১৩ ২৫

তাঁর মত ছিল, জাহাজের সমস্ত আলো নিভিয়ে সৈকত বরাবর যাওয়া উচিত যাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকেও বাঁচা যায় এবং শত্রুপক্ষও জাহাজের উপস্থিতি টের না পায়।

১৪ ২৫

দু’জনের বাকবিতণ্ডা চলাকালীন পিটারসনকে জানানো হয়, জার্মানির একটি বিস্ফোরক অনুসন্ধানকারী জাহাজ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। জাহাজের আলো না জ্বালালে দুই জাহাজের সংঘর্ষে ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে। বিপদ থেকে বাঁচতে আলো জ্বালানোর নির্দেশ দেন পিটারসন।

১৫ ২৫

এই নির্দেশে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন পিটারসন। দূর থেকে যাকে জার্মানের বিস্ফোরক অনুসন্ধানকারী জাহাজ ভেবে আলো জ্বালানো হয়েছিল, তা আসলে ছিল রাশিয়ান এস-১৩ সাবমেরিন। আলো জ্বালিয়ে শত্রুপক্ষের হাতে নিজে থেকেই ধরা দেয় ‘ভিলহেল্ম গাস্টলফ’।

১৬ ২৫

সাবমেরিন থেকে পর পর তিনটি টর্পেডো জাহাজের দিকে ছোড়া হয়। তিনটির মধ্যে একটি জাহাজের নীচের দিকে কেবিনে, একটি সুইমিং পুল এলাকায় এবং শেষ টর্পেডোটি জাহাজের ইঞ্জিনে এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের আলো নিজে থেকেই নিভে যায়।

১৭ ২৫

যাত্রীদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়। প্রাণ বাঁচানোর জন্য সবাই ছোটাছুটি আরম্ভ করেন। অনেকে সেই ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু যাত্রীরা তাঁদের উপর দিয়েই দৌড়ে যান। পদপিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান অনেকে।

১৮ ২৫

সংঘর্ষের ফলে জাহাজটি এক দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই সে দিকে বাঁধা একটিও লাইফবোট জলে নামানোর মতো অবস্থায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত ন’খানা লাইফবোট জলে নামানো হলে তাতে ওঠার জন্য যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে দেন।

১৯ ২৫

অনেকে আবার জলে ঝাঁপ দেন সাঁতার কেটে নিজের প্রাণ বাঁচাবেন বলে। তখন জানুয়ারি মাসের কনকনে ঠান্ডা। বাল্টিক সাগরের জলের তাপমাত্রা -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। বরফজলে ঝাঁপ দিতেই ঠান্ডায় জমে মারা যান অনেকে।

২০ ২৫

লাইফবোটে উঠবেন বলে অনেকে আবার লাইফবোটগুলিকে ঘেরাও করে ফেলেন। লাইফবোটের উপর থাকা যাত্রীদের জলে ফেলে তাঁরা নিজেরা নৌকায় উঠবেন বলে একে অপরকে ধাক্কা দিতে শুরু করেন। প্রাণ বাঁচাতে দাঁড় দিয়ে মেরে তাঁদের সরিয়ে দেন লাইফবোটের যাত্রীরা। এর ফলে অনেকেই ডুবে মারা যান।

২১ ২৫

এই ঘটনার প্রায় ৪৫ মিনিট পর যাত্রীদের উদ্ধার করতে কয়েকটি জাহাজ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয়। কিন্তু পৌঁছনোর পর যে বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ে তা দেখে সকলে আঁতকে ওঠেন। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ-সহ সমুদ্রে ভেসে রয়েছে সারি সারি মৃতদেহ।

২২ ২৫

১০ হাজার যাত্রীর মধ্যে মাত্র ১,২০০ জনকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করার সময় তাঁদের নজরে পড়ে একটি ছোট বাচ্চা লাইফবোটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে সেই উদ্ধারকারী দলের এক আধিকারিক তাকে দত্তক নেন।

২৩ ২৫

জাহাজের মোট মহিলা যাত্রীর মধ্যে মাত্র তিন জন বেঁচে ছিলেন। যাঁরা বেঁচেছিলেন তাঁদের মধ্যে এক জন জানান, জাহাজে এক উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক সপরিবারে যাত্রা করছিলেন। ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিয়ে জমে মারা যাওয়া অনেক বেশি কষ্টকর, তাই নিজের দুই সন্তান-সহ স্ত্রীকে গুলি করে মেরে আত্মঘাতী হন।

২৪ ২৫

পরে তদন্ত করে জানা যায়, সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন মারিনেস্কো মত্ত অবস্থায় কাজ করতেন। এই জন্য তাঁর সম্মানহানিও হয়েছিল। তাই নিজের হারানো সম্মান ফিরে পেতে তিনি জাহাজ আক্রমণের নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন, শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেছেন বলে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে।

২৫ ২৫

কোনও পুরস্কার তিনি পাননি। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্ত যে কতটা মর্মান্তিক, তার ভয়াবহতা এখনও ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় হিসাবে রয়ে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement