কাট ওয়ান। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশ্যায়ার শহরের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেছিল বিলাসবহুল জাহাজ টাইটানিক। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল উত্তর অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে ২২৪০ জন যাত্রী নিয়ে ভেসেছিল জাহাজটি। তার পর ঠিক পাঁচ দিন। সমুদ্রের মাঝে হিমশৈলের সঙ্গে সংঘর্ষ। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে গভীর সমুদ্রে দু’টুকরো হয়ে তলিয়ে যায় টাইটানিক। মৃত্যু হয় ১৫০০ জনের।
কাট টু। ১৯৯৭ সাল। টাইটানিকের ঘটনার উপর ভিত্তি করে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় জেমস ক্যামেরন পরিচালিত ‘টাইটানিক’ ছবিটি। বড় পর্দায় রোজ়-জ্যাকের প্রেম দর্শকের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পাশাপাশি দর্শকের চোখ ভিজেছিল এক বৃদ্ধ দম্পতির সম্পর্কের রসায়ন দেখে।
হিমশৈলের সঙ্গে সংঘর্ষের পর টাইটানিকে তখন অশান্ত পরিস্থিতি। জাহাজের ভিতর জল প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সকলেই বুঝতে পারছেন মৃত্যু আসন্ন। প্রাণ বাঁচানোর অন্তিম চেষ্টা করছেন যাত্রীরা। এমন পরিস্থিতিতেও শান্ত হয়ে ছিলেন মাত্র দু’জন।
আশপাশের হট্টগোল থেকে দূরে নিজেদের কেবিনে একে অপরকে জড়িয়ে শুয়েছিলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। তাঁদের আলিঙ্গনই আউড়ে দিচ্ছিল জীবনসঙ্গীর সংজ্ঞা। সারা জীবন হাত ধরে থাকার, পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁরা। মৃত্যুকেও একসঙ্গে বরণ করার সিদ্ধান্ত নেন ওই দম্পতি।
তবুও উদ্ধারকাজ চলাকালীন প্রৌঢ় দম্পতিকে টাইটানিকের ডেকে নিয়ে আসা হয়। সমস্ত মহিলা এবং শিশুকে লাইফবোটে নিয়ে যাওয়ার পর নিজেদের কথা ভাববেন বলে জানান বৃদ্ধ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে থাকবেন বলে নিজের পরনের কোট খুলে তাঁর পরিচারিকাকে দিয়ে দেন বৃদ্ধা। ভালবাসা হয়তো এ রকমই হয়।
‘টাইটানিক’ ছবিতে দেখানো বৃদ্ধ দম্পতি পরিচালকের কল্পনাপ্রসূত নয়। ১৯১২ সালে বাস্তবেই এই দম্পতি পাড়ি দিয়েছিলেন টাইটানিকে। জাহাজডুবিতে প্রাণ হারান তাঁরা।
বৃদ্ধ দম্পতির পরিচয় ইসিডর স্ট্রস এবং ইডা স্ট্রস। টাইটানিকের দুর্ঘটনায় মৃত এই দম্পতির সঙ্গে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া টাইটানের যোগ।
রবিবার পাঁচ জন যাত্রী নিয়ে নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জন’স থেকে যাত্রা শুরু করে পর্যটকবাহী সাবমেরিন টাইটান। অতলান্তিক মহাসাগরের প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার গভীরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল ডুবোযানটি।
কিন্তু যাত্রা শুরু করার ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর টাইটানের ‘মাদারশিপ’ পোলার প্রিন্সের সঙ্গে তার সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি কানাডার উপকূলরক্ষী বাহিনী উদ্ধারকার্যে হাত লাগায়। রবিবার থেকেই নিখোঁজ রয়েছে টাইটান।
বিবিসি সূত্রে খবর, ওশানগেট নামক পর্যটক সংস্থার মালিকানাধীন এই টাইটান। ২০২১ সাল থেকে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখানোর অভিযান চালু করেছে এই সংস্থা।
মাথাপিছু প্রায় দু’কোটি টাকার বিনিময়ে গভীর সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে আনে ওশানগেট। এই সংস্থার সিইও পদে রয়েছেন স্টকটন রাশ। যাত্রীদের সঙ্গে ডুবোযানে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনিও।
স্টকটনের স্ত্রীর নাম ওয়েন্ডি রাশ। টাইটানিক দুর্ঘটনায় মৃত স্ট্রস দম্পতির প্রপৌত্রীর নাতনি হলেন ওয়েন্ডি।
ইংল্যান্ডের প্রথম সারির ব্যবসায়ী ছিলেন ইসিডর। বাবা লাজারুস স্ট্রস এবং ভাই নাথান স্ট্রসের সঙ্গে একটি দোকান চালাতেন ইসিডর। পরে মেসি নামের একটি ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’-এর মালিকানা লাভ করেন স্ট্রসেরা।
১৯৮৬ সালে দুই ভাই ইসিডর এবং নাথান দোকানের মালিকানা পান। ইসিডর সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের দোকানে চিনামাটির বাসনও বিক্রি করা হবে। ব্যবসা করেই সফল হয়ে উঠেছিলেন ইসিডর।
ইসিডরের সঙ্গে ইডার বিয়ের পর মিনি নামে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। ১৯০৫ সালে ডক্টর রিচার্ড ওয়েলকে বিয়ে করেন মিনি।
রিচার্ড এবং মিনির পুত্র রিচার্ড ওয়েল জুনিয়র বড় হয়ে নিউ ইয়র্কে মেসির প্রেসিডেন্ট হিসাবে যুক্ত হন। রিচার্ড ওয়েল জুনিয়রের পুত্র তৃতীয় রিচার্ড ওয়েল হলেন ওয়েন্ডির বাবা।
বিয়ের আগে ওয়েন্ডির নাম ছিল ওয়েন্ডি হলিংস ওয়েল। ওশানগেট প্রতিষ্ঠার আগে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন স্টকটন।
গত দু’বছরে ওশানগেট সংস্থার তরফে তিন বার টাইটানিক ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন ওয়েন্ডি। বর্তমানে ওশানগেট সংস্থার কমিউনিকেশন ডিরেক্টর পদে রয়েছেন তিনি।