১৯৯৬ সাল। উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ে একের পর এক মানুষের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল একদল নেকড়ে। তটস্থ হয়ে গিয়েছিল সে রাজ্য। ছড়িয়েছিল আতঙ্ক। তার পর প্রায় ২৮ বছর কেটে গিয়েছে। গত মাস থেকে আবার নেকড়ে-আতঙ্কে কাঁপছে উত্তরপ্রদেশের বহরাইচ জেলা।
গত দু’মাসে বহরাইচ জেলার একাধিক গ্রামে নেকড়ের হামলায় এক মহিলা এবং নয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মূলত মাহসি ব্লকের সিসিয়া পঞ্চায়েত এবং আশপাশের অঞ্চলগুলিতেই ঘটছে নেকড়ের হানার ঘটনা।
বহরাইচ জেলার নেপাল সীমান্তবর্তী কাটার্নিয়াঘাট ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাফার জ়োনে নেকড়ের উপস্থিতি রয়েছে। প্রাথমিক অনুমান, ওই নেকড়েগুলি সেখান থেকেই লোকালয়ে এসে ডেরা বেঁধেছে।
চারটি নেকড়েকে খাঁচাবন্দি করার পরেও হামলা থামেনি। দিন দুয়েক আগে ফের হানা দেয় মানুষখেকোর দল। পুলিশ সূত্রের খবর, ঘরের ভিতর ঢুকে ১২ বছরের এক ঘুমন্ত বালককে ঘাড় কামড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে একটি নেকড়ে। চিৎকারে পরিবারের অন্য সদস্যেরা জেগে উঠলে শিকার ছেড়ে পালায় সে।
সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিতে বহরাইচের রামুয়াপুর এলাকা জলপ্লাবিত হয়ে কয়েকটি নেকড়েশিশুর মৃত্যু হয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। ঘটনাচক্রে, তার পরেই শুরু হয় হামলার ঘটনা।
বহরাইচের মানুষখেকো নেকড়েদের গুলি করে মারার জন্য ইতিমধ্যেই নির্দেশিকা জারি করেছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। নেকড়েদের এমন আচরণের কারণ অনুসন্ধান করতে পৌঁছেছেন দেহরাদূনের ‘ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া’ (ডব্লিউআইআই)-র বিশেষজ্ঞেরা।
কিন্তু কেন ২৮ বছর পর আবার নেকড়ের আতঙ্কে ভুগছে উত্তরপ্রদেশ? কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা?
লাজুক স্বভাবের মাংসাশী প্রাণীর শরীর হলুদ-বাদামি লোমে আচ্ছাদিত। পা শক্ত এবং লম্বা। চোয়ালের কাছে সাদা দাগ থাকে। ভারতে বর্তমানে প্রায় দু’হাজার নেকড়ে রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই তৃণভূমিতে থাকে।
ফরেস্ট কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জয় পাঠকের মতে, মানুষের দ্বারা কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হামলা চালানো ওই নেকড়ের পাল।
সে ক্ষেত্রে ‘প্রতিশোধের তত্ত্ব’ও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি। সঞ্জয় বলেন, ‘‘নেকড়েদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা আছে। যদি কোনও মানুষ তাদের ডেরা বা তাদের সন্তানদের ক্ষতি করে, তবে তারা মানুষের উপর প্রতিশোধ নেয়।’’
ভারতীয় তৃণভূমির শিকারি নেকড়েরা মূলত ভেড়া, ছাগল, হরিণ, চিঙ্কারা খেয়ে বেঁচে থাকে। এমনকি সরীসৃপ এবং ইঁদুরও তারা খায়। কিন্তু তৃণভূমির পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকায় নেকড়েদের অধিকাংশই এখন ঘন, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে বসবাস করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা জনবসতির কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে মাঝেমধ্যে তারা গবাদি পশুর উপরেও হামলা চালায়। যদি গবাদি পশুও না মেলে, তখন মরিয়া হয়ে খাবারের খোঁজ চালায় তারা।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘ন্যাশনাল চিতা অ্যাকশন প্ল্যান’ (জাতীয় চিতা পুনঃস্থাপন কর্মসূচি)-এর প্রাক্তন প্রধান তথা বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ যাদবেন্দ্রনাথ ঝালা বহরাইচের ঘটনার জন্য নেকড়ের দল দায়ী কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘নেকড়েরা সাধারণ ভাবে লাজুক প্রাণী। মানুষকে আক্রমণের নজির খুবই কম। বিরলই বলা চলে। নেকড়ে প্রায় কখনওই মানুষকে আক্রমণ করে না। আশির দশকে একটি এবং ১৯৯৬ সালের দিকে একটি এমন ঘটনার নজির রয়েছে। উভয় ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশ-বিহারের গ্রামীণ অঞ্চলে। যেখানে এখনও অনেকের বাড়িতেই দরজা নেই।’’
ঝালা আরও বলেছেন, ‘‘যখন এই নেকড়েরা খাবার খুঁজে পায় না, তখন গ্রামের অল্পবয়সি, শিশুদের আক্রমণ করে। প্রথম শিকার সফল হলে, স্বাভাবিক ভাবেই আবার হামলা চালায়।’’
দেহরাদূনের ‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (ডব্লিউআইআই)’-এর কর্তা তথা বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানী বিলাল হাবিবের দাবি, নেকড়ের হামলা ঠেকানোর একমাত্র উপায় হল তাদের ধরে ফেলা।
হাবিব বলেছেন, ‘‘নেকড়েগুলি ক্ষুধার্ত। ৩-৫ দিনের বেশি অভুক্ত থাকলে তারা আবার হামলা চালাবে। যে হেতু শিশুদের সহজে শিকার করা যায়, তাই তাদের উপর আক্রমণ করার আশঙ্কাও বেশি।’’
ঝালার মতো হাবিব এ-ও বলেছেন, ‘‘মানুষকে আক্রমণ করা নেকড়েদের স্বভাব নয়। কিন্তু আশপাশের পরিস্থিতির কারণে তারা হামলা চালাতেও পারে।’’
ইতিমধ্যেই আতঙ্কের বশে নেকড়ে ভেবে একটি শেয়াল এবং কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন গ্রামবাসীরা। চারটি নেকড়েকে ধরে ফেললেও এখনও অধরা দু’টি। মনে করা হচ্ছে ওই নেকড়ে দু’টিই দলের নেতৃত্বে ছিল।
তবে হাবিব যেখানে নেকড়ের দলটিকে ধরে ফেলার যুক্তি দিয়েছেন, সেখানে বেঙ্গালুরুর পরিবেশবিদ আবি ভানাকের যুক্তি, ‘‘প্রয়োজনে নেকড়ের দলটিকে মেরে ফেলতে হতে পারে। এই নেকড়েগুলি মানুষের শিকার করতে শিখেছে এবং এই স্বভাব অন্য নেকড়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে।’’
যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, বহারাইচে যে প্রাণী হামলা চালাচ্ছে, তা কোনও নেকড়ে না। নেকড়ের সংকর প্রজাতি। তবে সেই প্রাণী ধরা পড়া না পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
তবে যত দিন বাকি নেকড়েরা ধরা না পড়ছে, তত দিন শিশুদের নিয়ে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। এমনকি ঘুমোনোর সময় বাচ্চাদের দড়ি দিয়ে বাবা-মার শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখার পরামর্শও দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড় জেলায় ‘মানুষখেকো’ সন্দেহে কয়েকটি নেকড়েকে গুলি করে মারা হয়েছিল। কিন্তু তারা আদৌ মানুষখেকো ছিল কি না। এই নিয়ে পরবর্তী কালে বিতর্ক দানা বাঁধে।