বিজ্ঞান কোথায় নেই! জীব নিজের বংশধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রজনন করে। কিন্তু অন্তত মানুষের ক্ষেত্রে প্রজনন কেবল জৈবিক অনুশীলন নয়, মনের গভীরে থাকা বিভিন্ন প্রবৃত্তির প্রকাশও বটে। তাই শারীরিক মিলন নিয়ে গবেষকদেরও উৎসাহের অন্ত নেই। এমনই এক গবেষণায় ৩ দশকেরও বেশি সময় আগে অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটান এক ইউরোপীয় যুগল। এমআরআই স্ক্যানারের ভিতর মিলিত হন তাঁরা।
১৯৯১ সালে বিজ্ঞানচর্চার জন্য ইডা সাবেলিস নামের এক মহিলা গবেষক এবং তার প্রেমিক জুপ এমআরআই স্ক্যানারের ভিতর সঙ্গমে লিপ্ত হন। দম্পতির মিলনের সময় এমআরআই করেছিলেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী মেনকো ভিক্টর ভ্যান অ্যান্ডেল। সহবাসের সময় মানবদেহের ভিতরে ঠিক কী ঘটে তা ভাল ভাবে বুঝতেই এ হেন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন বিজ্ঞানীরা।
ঝুঁকিপূর্ণ এই গবেষণাটিতে এমন কিছু ছবি পাওয়া যায়, যা আগে দেখা যায়নি। এই এমআরআই-এর ছবি এবং ফলাফল যৌনমিলন সংক্রান্ত গবেষণায় একটি নতুন দিক খুলে দেয়। এই গবেষণায় প্রাপ্ত ছবি ও তথ্যের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী কালে বৃহত্তর বেশ কিছু গবেষণাও হয়।
ঠিক কী দেখা গিয়েছিল সেই গবেষণায়? এমআরআই স্ক্যানারের মধ্যে দম্পতির যৌনমিলনের সময় দেখা যায়, মিলনের সময় পুরুষাঙ্গ বুমেরাং-এর মতো বেঁকে যায়। অর্থাৎ ঋজু পুরুষাঙ্গও অনমনীয় নয়। বরং মিলনকালে নারীদেহে প্রবেশের পর তা বিশেষ ভাবে বেঁকে যায় কোনও রকম যন্ত্রণা ছাড়াই।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী উল্লম্ব ভাবে মিলিত হওয়ার কথা ছিল ইডা ও জুপের। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু বোঝা যায়নি। এর পর ইডাই পরামর্শ দেন বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তোলার। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী এমআরআই যন্ত্রের ভিতর বিভিন্ন ভঙ্গিতে মিলিত হন তাঁরা। পাশাপাশি ভাবে মিলিত হওয়ার সময় ধরা পড়ে পুরুষাঙ্গের বক্রতার বিষয়টি।
কেবল পুরুষাঙ্গই নয়, যোনিপথ এবং জরায়ু নিয়েও একাধিক তথ্য উন্মোচিত হয় এই গবেষণায়। গবেষণাটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলটি হল, যোনিপথ সরলরৈখিক নয়। তারও একটি স্বতন্ত্র বক্রতা রয়েছে। আর পুরুষাঙ্গ যোনিপথের স্বাভাবিক বক্রতা অনুযায়ী নিজেকে বাঁকিয়ে নিতে পারে।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ১৪৯২ সালের আঁকা ছবি দেখে শারীরবিদ্যায় একটি ধারণা তৈরি হয় যে, যোনিপথ বেলনাকৃতির। পাশাপাশি এই ধারণাও তৈরি হয় যে, এক জন পুরুষের লিঙ্গ সরলরৈখিক ভাবে এক জন মহিলার যোনিতে প্রবেশ করে। আবার সরাসরি বেরিয়ে আসে। এই গবেষণায় পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন সেই ধারণা ভেঙে যায়।
ইডা ও জুপের স্ক্যানের পর আরও কয়েক জন দম্পতি আনুষ্ঠানিক ভাবে এই গবেষণায় অংশ নেন। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই গবেষণাগুলির সম্মিলিত ফলাফল ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ পায়। প্রকাশের পরই এই গবেষণাপত্র সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত গবেষণামূলক প্রতিবেদনের একটি হয়ে ওঠে।
ইডা এক জন ঘোষিত নারীবাদী। একটি সাক্ষাৎকারে ইডা জানান, তিনি এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন যাতে নারীদেহ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা স্পষ্টতর হয়। তাঁর দাবি, এই গবেষণায় সেই পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।
শুধু নারীবাদীই নন, ইডা এক জন শিক্ষাবিদও বটে। আমস্টারডামের ভ্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের শিক্ষিকা ইডা। তিনি নিজেও এই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখিকা। ইডা জানিয়েছেন, গোটা বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ভাবে কিছুটা সঙ্কোচ থাকলেও গবেষণা শুরু হওয়ার পর নিজেদের চাপমুক্ত করতে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলেন তিনি এবং জুপ।
ইডার দাবি, তাঁরাই একমাত্র যুগল যাঁরা কোনও রকম যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধ ছাড়াই পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। তাঁদের পর আর কেউই তা করতে পারেননি। এর থেকেই বোঝা যায় বিষয়টি আদৌ খুব একটা সহজ ছিল না।
ইডার সঙ্গে সহমত গবেষণার শীর্ষবিজ্ঞানী মেনকো ভিক্টর ভ্যান অ্যান্ডেলও। গোটা পরীক্ষার জন্য সময় লেগেছিল ৪৫ মিনিট। এমআরআই যন্ত্রের ভিতর তীব্র শব্দ হত সে সময়। শুয়ে থাকার জায়গাও বেশ কম ছিল। সেখানে ইডা ও জুপের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তিনিও।
কিন্তু স্ক্যান করার পরই শেষ হয়নি কাজ। প্রথিতযশা কোনও বিজ্ঞানপত্রিকায় এই ধরনের গবেষণা প্রকাশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি, কেবল একটি মাত্র সঙ্গমের ছবির উপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক দাবি করা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। গবেষকের দাবি, বিজ্ঞানপত্রিকা নেচার কোনও কারণ না দেখিয়েই তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে অস্বীকার করে।
বাধ্য হয়ে ইডা এবং মেনকো স্বেচ্ছাসেবীদের খোঁজ শুরু করেন। ৮ দম্পতি এবং ৩ নারী গবেষণায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁদের এমআরআই করার আগেই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় বিষয়টি। রোগীদের চিকিৎসা বিলম্বিত করে এই ধরনের গবেষণায় কেন এমআরআই যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয় নেদারল্যান্ডসের সংবাদমাধ্যমে।
শেষ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন হাসপাতাল এই গবেষণার কাজে তাদের এমআরআই যন্ত্র ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয়। এর পর মোট ১৩ বার শারীরিক মিলনের ছবি তোলা হয় এমআরআই যন্ত্রের ভিতর।
এমআরআই করা সম্ভব হলেও গবেষণাপত্র প্রকাশে রাজি হয়নি বড় কোনও বিজ্ঞানপত্রিকা। তবু হাল ছাড়েননি গবেষকরা। অবশেষে ৮ বছর পর ম্যাগনেটিক রেজ়োন্যান্স ইমেজিং অফ মেল অ্যান্ড ফিমেল জেনিটালস ডিউরিং কয়টিয়াস অ্যান্ড ফিমেল সেক্সুয়াল অ্যারোসাল নামে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল-এ প্রকাশ পায় গবেষণাপত্রটি।
গবেষণার পর কেটে গিয়েছে ৩০ বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু সেই গবেষণা এবং তার থেকে প্রাপ্ত ছবিগুলি নিয়ে আজও জনসাধারণের উৎসাহের অন্ত নেই। সম্প্রতি সেই ছবিগুলি ফের ভাইরাল হয় টিকটকে। সমাজমাধ্যমে ছবিগুলি নতুন করে ঝড় তোলে৷ ৩ দশক আগে তরুণ গবেষকদের এমন দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রশংসা করেছেন অনেকেই।