চাঁদের মাটিতে ভেঙে পড়েছে রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা-২৫। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক পরে যে চন্দ্র অভিযানের জন্য উদ্যোগী হয়েছিল রাশিয়া, তা ব্যর্থ হয়েছে।
রবিবার রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমসের তরফে জানানো হয়েছে, লুনা-২৫ চাঁদের মাটিতে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়েছে। কী কারণে অভিযান ব্যর্থ হল, তা-ও প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছে তারা।
লুনা-২৫ যে ভেঙে পড়তে পারে, তা আগেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। শনিবার এই মহাকাশযানে ‘যান্ত্রিক গোলযোগ’-এর কথা জানিয়েছিল রুশ সংস্থা। কিন্তু গোলযোগটা কী ধরনের, তা খোলসা করা হয়নি।
গত ১১ অগস্ট রাশিয়ার লুনা-২৫ উৎক্ষেপণ করা হয়। বলা হয়েছিল, চাঁদে পৌঁছতে তার সময় লাগবে ১০ দিন। খুব বেশি হলে ১২ দিনের মাথায় চাঁদে নামতে পারে রাশিয়ার লুনা, তেমন দাবিও করা হয়েছিল। হিসাব মতো সোমবার, ২১ অগস্ট চাঁদে অবতরণের কথা ছিল লুনার।
চাঁদের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল লুনা-২৫। প্রথম থেকেই ঝড়ের গতিতে এগোচ্ছিল রাশিয়ার মহাকাশযানটি। একটি ধাপ পেরোলেই চাঁদে নামার অভিযান সফল হত। কিন্তু সেখানেই বিপত্তি ঘনিয়ে এল।
রসকসমসের পরিকল্পনা অনুযায়ী, শনিবার চাঁদে নামার আগে শেষতম কক্ষপথে পৌঁছনোর কথা ছিল লুনা-২৫-এর। কিন্তু সেই কক্ষপথ বদলের প্রক্রিয়া চলাকালীন ‘জরুরি পরিস্থিতি’র মুখোমুখি হয় ল্যান্ডারটি।
এই জরুরি পরিস্থিতির কারণে নির্দিষ্ট পরিমাপ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে শেষের কক্ষপথটিতে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। রসকসমস কেবল এইটুকুই জানিয়েছিল। ফলে মূল সমস্যাটি স্পষ্ট হয়নি।
নানা জল্পনার পর রবিবার রুশ সংস্থা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে, তাদের লুনা-২৫ চাঁদের মাটিতে ভেঙে পড়েছে। চাঁদের বুকে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ল্যান্ডারটি।
রসকসমসের তরফে কারণ হিসাবে জানানো হয়েছে, যে কক্ষপথে ল্যান্ডারটিকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, তা পরিমাপে কিছুটা বিচ্যুতি ঘটেছিল। ফলে নির্ধারিত কক্ষপথের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে যায় ল্যান্ডারটি।
চাঁদের মাটিতে নামার সময় একে একে কক্ষপথ পরিবর্তন করানো হয় মহাকাশযানের। সেই সঙ্গে তার গতিতেও ধাপে ধাপে রাশ টানা হয়। মনে করা হচ্ছে, লুনা-২৫-এর গতিতে পরিকল্পিত রাশ টানা যায়নি।
মনে করা হচ্ছে, অধিক গতির কারণেই সরাসরি চাঁদে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে রুশ মহাকাশযান। লুনা-২৫কে একটা সময়ের পর আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি রসকসমসের বিজ্ঞানীরা।
রসকসমস জানিয়েছে, শনিবার মস্কোর স্থানীয় সময় দুপুর ২টো ৫৭ মিনিট নাগাদ লুনা-২৫-এর সঙ্গে বিজ্ঞানীদের যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রবিবার পর্যন্ত যোগাযোগ আবার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি।
কেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল? প্রাথমিক ভাবে তা তদন্ত করে দেখেছে রসকসমস। সেখানেই দেখা গিয়েছে, নির্ধারিত কক্ষপথের চেয়ে বেশি এগিয়ে গিয়েছিল ল্যান্ডারটি। এর পর তা চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়েছে।
রসকসমসের তরফে একটি বিশেষ অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তারা আরও বিস্তারিত ভাবে এই অঘটনের কারণ বিশ্লেষণ করবে। লুনা-২৫-এর ধাক্কায় চাঁদের মাটিতে কী ক্ষতি হয়েছে, তা-ও দেখা হবে।
অন্য দিকে, চাঁদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর তৈরি চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। রাশিয়ার মতোই তারও গন্তব্য চাঁদের দক্ষিণ মেরু।
চাঁদের দক্ষিণ মেরু এখনও অনাবিষ্কৃত। সেখানে রাশিয়াই প্রথম পা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কারণ, ভারতের চেয়ে আগে তাদের চাঁদে নামার কথা ছিল। রুশ অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় এখন ভারতের সামনে সম্ভাবনার দীগন্ত খুলে গিয়েছে।
ভারতের অভিযান যদি সফল হয়, তবে দু’টি ইতিহাস তৈরি হবে। এক, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পর চতুর্থ দেশ হিসাবে চাঁদে সফল ভাবে মহাকাশযান অবতরণে নাম উঠে আসবে ভারতের।
দুই, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম পা রাখবে ভারত। অর্থাৎ, পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপগ্রহের এই অংশটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব পাবে ইসরো। এর আগে অন্য কোনও দেশ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মহাকাশযান অবতরণ করাতে পারেনি।
চাঁদের দক্ষিণ মেরু দুর্গম। এই অংশে সূর্যের আলো পড়ে না। অংশটি চিরআঁধারে নিমজ্জিত এবং সম্পূর্ণ রূপে বরফে মোড়া। গভীর খাদ, খাড়া পাহাড়, ঢিবি চাঁদের দক্ষিণ মেরুকে প্রতিকূল করে তুলেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই অংশে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য উপযোগী সম্পদ পাওয়া যেতে পারে।
রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতর নিয়ে এই অংশেই আগামী বুধবার নামার কথা চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের। ইসরো জানিয়েছে, সেই অবতরণ হবে পাখির পালকের মতো (সফ্ট ল্যান্ডিং)। চার বছর আগে এই পর্যায়ে এসেই ব্যর্থ হয়েছিল ভারতের চন্দ্র অভিযান।
এ বার তেমন পরিস্থিতি তৈরি হবে না, আশাবাদী ইসরো। চন্দ্রযান-২ থেকে শিক্ষা নিয়ে আগেভাগেই প্রস্তুত করা হয়েছে বিক্রমকে। ইসরোর এক বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, সমস্ত সেন্সর-সহ তার দু’টি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও ২৩ অগস্ট বিক্রম চাঁদের মাটিতে নামতে পারবে। তবে শর্ত একটাই, এর প্রোপালশন সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করা চাই।
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার চন্দ্র অভিযানের ফারাক অনেক। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক খরচে লুনা-২৫কে চাঁদে পাঠাচ্ছিল রাশিয়া। ইসরো তুলনামূলক সস্তায় অভিযান পরিকল্পনা করেছে।
চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের ওজন ১,৭৫২ কেজি। সেখানে রুশ ল্যান্ডারের ওজন ছিল মাত্র ৮০০ কেজি। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নেমে চন্দ্রযান-৩ গবেষণার জন্য নানা তথ্য সংগ্রহ করবে ১৪ দিন ধরে। রুশ ল্যান্ডারের এক বছর চাঁদে থাকার পরিকল্পনা ছিল।
লুনা-২৫-এর ভর ছিল ১.৮ টন। পেটের মধ্যে ৩১ কেজি ওজনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহন করছিল এই ল্যান্ডার। চাঁদের মাটির অন্তত ৬ ইঞ্চি গভীর থেকে পাথুরে উপাদান সংগ্রহ করার কথা ছিল তার। তবে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে গিয়েছে।
অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের ‘লঞ্চিং প্যাড’ থেকে ১৪ জুলাই দুপুর ২টো ৩৫ মিনিটে চন্দ্রযান-৩-এর সফল উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। ইসরো জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে বিক্রমের চাঁদে নামার কথা। অভিযানের সাফল্যের আশায় বুক বেঁধেছে গোটা দেশ।