যুদ্ধ বেধেছে ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র বাহিনী হামাসের মধ্যে। ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতের প্রথমেই ইজ়রায়েলের প্রায় ২০০ জন সাধারণ মানুষকে বন্দি বানিয়েছে হামাস। সেই তালিকায় রয়েছে ন’মাস বয়সি এবং বিরল স্নায়ু রোগে আক্রান্ত শিশু থেকে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা। তালিকায় রয়েছেন ৮৫ বছর বয়সি বৃদ্ধাও।
মনে করা হচ্ছে, ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যই ইজ়রায়েলিদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে হামাস গোষ্ঠী। অপহৃতদের পরিবারের সদস্য এবং অনেক সাধারণ মানুষ বন্দিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। যার জেরে নেতানিয়াহু আরও চাপের মুখে পড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলের বুকে আচমকা হানা দেয় হামাসের সশস্ত্র বাহিনী। বন্দুকের গুলি এবং ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিহত হন কয়েকশো ইজ়রায়লি। সেই সময়ই ইজ়রায়েলের অনেক সাধারণ মানুষকেও অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় বলেও অভিযোগ।
কিন্তু কেন আচমকা ইজ়রায়েলের মাটিতে অনুপ্রবেশ করে প্রায় ২০০ ইজ়রায়েলিকে অপহরণ করে নিয়ে গেল হামাস? এই নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে।
যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, হামাসের এমন পদক্ষেপের নেপথ্যে রয়েছে এক সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এবং ইতিহাসের শিক্ষা।
১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল তৈরির পর থেকে, প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র বাহিনীদের সঙ্গে বেশ কয়েক বার সংঘাতে জড়িয়েছে সেই দেশ। আর প্রায় প্রতি বারই দু’দেশের বহু মানুষ অপর দেশের সেনা বা সশস্ত্র বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১১ সালের সংঘাত।
২০১১ সালেও ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘাত বেধেছিল হামাসের। সেই যুদ্ধে ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনীর কর্পোরাল গিলাদ শালিতকে অপহরণ করে নিয়ে যায় হামাস গোষ্ঠী। তখন গিলাদের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর।
হামাসের সশস্ত্র বাহিনী সুড়ঙ্গ দিয়ে ইজ়রায়েলে প্রবেশ করে। সেই সময় গিলাদের ট্যাঙ্কে হামলা চালিয়ে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। হামাসের শর্ত ছিল ইজ়রায়েলের জেলে বন্দি ১,০২৭ বন্দিদের মুক্তি দিলে তবেই ফেরানো হবে গিলাদকে।
সেই সময়ও ইজ়রায়েলে নেতানিয়াহুর সরকারই ক্ষমতায় ছিল। গিলাদকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে সেই সময় বহু ইজ়রায়েলি পথে নেমেছিলেন। চাপে পড়ে নেতানিয়াহু সরকার শেষমেশ গিলাদকে ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়ে যায়।
এর পর দীর্ঘ আলোচনা চলে দু’পক্ষের মধ্যে। বন্দি হওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পর ছাড়া পান গিলাদ। ইজ়রায়েলের হাতে বন্দি থাকা ১,০২৭ জন প্যালেস্তিনীয়দের মুক্তির বদলে মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে।
তবে গিলাদের ঘটনার আগেও একাধিক বার চাপের মুখে পড়ে বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে ইজ়রায়েল।
ইজ়রায়েলি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টাইমস অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক সেনার মৃতদেহ এবং চার জন সরকারি আধিকারিকের বিনিময়ে ১৯৫৫ সালে সিরিয়ার ৪০ সেনাকে মুক্তি দিয়েছিল ইজ়রায়েল।
১৯৮৩ সালে ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (পিএলও)-র হাতে বন্দি ছয় ইজ়রায়েলি বন্দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্যালেস্তাইনের ৪,৭০০ বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৮৫ সালেও দু’জন সেনার বদলে প্যালেস্তাইনের ১,১৫০ জন বন্দিকে ইজ়রায়েল মুক্তি দিয়েছিল। ২০০৪ এবং ২০০৮ সালেও দু’দেশে বন্দি বিনিময় হয়েছে।
এর আগেও দেশের বন্দিদের ফিরিয়ে আনতে প্যালেস্তাইনের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়েছে ইজ়রায়েল। বিশেষজ্ঞদের মতে ইজ়রায়েলের সেই ‘দুর্বলতা’কেই কাজে লাগাতে চাইছে হামাস।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই নাকি ইজ়রায়েলি বন্দিদের ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে বন্দিমুক্তির দাবি জানিয়েছে হামাস।
ব্রিটেনের এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইজ়রায়েলে বন্দি থাকা সাত হাজার জঙ্গিকে মুক্ত করার বিনিময়ে অপহৃত প্রায় ২০০ ইজ়রায়েলিকে মুক্তি করার কথা ভাবছে হামাস।
অপহৃত ইজ়রায়েলিদের পরিবারকে ফোন করেও নাকি তেমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছে হামাস বাহিনী। অপহৃত এক ইজ়রায়েলির পরিবারকে ফোন করে নাকি গিলাদের প্রসঙ্গও টেনে আনে তারা।
প্যালেস্তাইনের ‘সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ’-এর পরিচালক খলিল শিকাকির জানিয়েছেন, হামাস যদি প্যালেস্তাইনের বন্দিদের মুক্ত করে আনতে সক্ষম হয়, তা হলে প্যালেস্তাইনে হামাসের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
তবে হামাসের দর কষাকষিকে এখনই পাত্তা দিতে রাজি নয় ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ জানিয়েছেন, অপহৃতদের নিরাপদে এবং কোনও শর্ত ছাড়াই ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েলি সেনা।
বন্দিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন ইজ়রায়েলের সাধারণ মানুষ। রবিবার রাস্তায় নেমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বাইরে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। জনগণের একাংশের দাবি, এই বিশৃঙ্খলার জন্য নেতানিয়াহু সরকারকেই দায়ী। হামাসকে আটকাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেও সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ।