বোতলের পর বোতল ওয়াইন নষ্ট করছে ফ্রান্স। দামি রঙিন তরল স্রেফ ‘ফেলে দেওয়া’ হচ্ছে। এমনি এমনি নয়। দেশের সরকারের তরফে রীতিমতো গাঁটের কড়ি খরচ করে চলছে এই ‘অপচয়’।
ফ্রান্স সরকার জানিয়েছে, দেশের উদ্বৃত্ত ওয়াইন নষ্ট করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীদের পাশে দাঁড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারি কোষাগার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হচ্ছে এর জন্য।
উদ্বৃত্ত ওয়াইন নষ্ট করতে ফ্রান্স সরকার ২০ কোটি ইউরো খরচ করছে বলে খবর। ভারতীয় মুদ্রায় যার অর্থ ১,৭৮২ কোটি টাকা। এই টাকা খরচ করার কথা সরকারই ঘোষণা করেছে।
সুরার তালিকায় ওয়াইন ‘এলিট’ তকমা পেয়ে থাকে হামেশাই। অন্যান্য সুরার চেয়ে ওয়াইনের দামও বেশি। কেন সেই সুরা নষ্ট করা হচ্ছে ফ্রান্সে? কেনই বা নষ্ট করার জন্য উল্টে টাকা খরচ করছে সরকার?
বস্তুত, ফ্রান্সে ওয়াইন শিল্প সম্প্রতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ওয়াইনের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে ইউরোপের এই দেশটিতে। মানুষ ওয়াইন খেতে চাইছেন না আর।
তবে কি ফরাসিরা মদ খাওয়াই ছেড়ে দিলেন? তা কিন্তু নয়। ওয়াইনের চাহিদা কমেছে, কারণ অন্য মদের প্রতি আসক্ত হয়েছেন ফ্রান্সের মানুষ। চাহিদা বেড়েছে ক্রাফ্ট বিয়ারের।
ক্রাফ্ট বিয়ার হল প্রাচীন পদ্ধতিতে তৈরি দেশি মদ, কোনও রকম যন্ত্র ছাড়াই যা প্রস্তুত করা হয়। সাধারণত, ছোটখাটো কারখানায় এই ধরনের বিয়ার তৈরি হয়। কখনও কখনও কারখানাও থাকে না। ছোট ব্যবসায়ীরা এগুলি তৈরি করে বাজারে ছাড়েন।
ক্রাফ্ট বিয়ার দামেও ওয়াইনের চেয়ে সস্তা। সেই সস্তার বিয়ারে মজেছেন ফরাসিরা। আপাতত তাঁরা ক্রাফ্ট বিয়ার দিয়ে গলা ভেজাচ্ছেন। ওয়াইনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশের অধিকাংশ বাসিন্দা।
সাধারণ বিয়ারে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে ৫ শতাংশ। ক্রাফ্ট বিয়ারে তার চেয়ে বেশি অ্যালকোহল থাকে। সেখানে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৫.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, এই বিয়ার সাধারণ বিয়ারের চেয়ে ০.৯ শতাংশ বেশি ঘন।
ওয়াইনে অবশ্য বিয়ারের চেয়ে বেশি অ্যালকোহল থাকে। তাতে অ্যালকোহলের গড় পরিমাণ ১৮ শতাংশ। তবে প্রস্তুতকারক সংস্থা অনুযায়ী ওয়াইনে অ্যালকোহলের পরিমাণ বদলাতে পারে। ৫.৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অ্যালকোহল থাকতে পারে ওয়াইনে।
অনেকে বলছেন, কোভিড অতিমারির পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সে মানুষের জীবনযাপনের ধরন বদলে গিয়েছে। দারিদ্র বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে মানুষ হয়ে উঠেছেন আরও বেশি সঞ্চয়ী। সেই কারণেই ওয়াইনের চাহিদা কমেছে।
ফ্রান্সের জনপ্রিয় ওয়াইন প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি এই পরিস্থিতিতে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা আগে থেকে যে পরিমাণ ওয়াইন তৈরি করে রেখেছিল, তা আর বিক্রি করা যাচ্ছে না। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে বোতল বোতল রঙিন তরল।
সংস্থাগুলির বাড়তি উৎপাদনও তাদের বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়তে বসেছে ফ্রান্সের ওয়াইন শিল্প। সঙ্কটকালে তাই ইন্ডাস্ট্রির পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার।
ফ্রান্স সরকার অবশ্য নিজের হাতে ওয়াইন নষ্ট করছে না। বরং, যে ওয়াইন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বা যাবে, তার খরচ বাবদ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে অর্থসাহায্য করছে। সেই খাতেই ২০ কোটি ইউরো বরাদ্দ করা হয়েছে।
ফ্রান্সের ওয়াইন প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মী বলেছেন, ‘‘আমরা অনেক বেশি সুরা তৈরি করে ফেলেছি। যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে উৎপাদনের টাকাও উঠছে না। তাই আমাদের ক্ষতি হচ্ছে।’’
এএফপির রিপোর্ট অনুযায়ী, কোভিড অতিমারির পর থেকেই ফ্রান্সে খাদ্য এবং জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনের বাড়তি বিলাসিতা ত্যাগ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
ওয়াইনের ক্ষতিপূরণবাবদ যে টাকা সরকারের থেকে দেওয়া হবে, তা অতিরিক্ত স্টক কিনতে কাজে লাগবে। এ ছাড়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ওয়াইন থেকে অ্যালকোহল সংগ্রহ করে আলাদা করে তা বিক্রি করা হবে।
বিভিন্ন স্যানিটাইজার এবং সুগন্ধি প্রস্তুতকারক সংস্থার কাছে ওই বাড়তি অ্যালকোহল বিক্রি করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে চাষের কাজেও লাগানো হতে পারে ওয়াইন।
ধুঁকতে থাকা ওয়াইন শিল্পকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে চায় ফ্রান্স সরকার। সে কথা মাথায় রেখেই মোটা অঙ্কের টাকা আবার এই ইন্ডাস্ট্রিতে ঢালা হচ্ছে। দেশের কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তন প্রয়োজন।
শুধু ফ্রান্স নয়, সমগ্র ইউরোপেই ওয়াইনের ব্যবসা সম্প্রতি ধাক্কা খেয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ওয়াইনের বিক্রি ইটালিতে ৭ শতাংশ, স্পেনে ১০ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৫ শতাংশ, জার্মানিতে ২২ শতাংশ এবং পর্তুগালে ৩৪ শতাংশ কমেছে।