সরকারি টিভি চ্যানেলে চলছিল অনুষ্ঠান। আচমকাই কালো হুডি মাথায় হাতে বন্দুক, ডিনামাইট, গ্রেনেড নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল কয়েক জন। সঙ্গে চ্যানেল উড়িয়ে দেওয়ার, খুন করার হুমকি। অনুষ্ঠান লাটে উঠল। থরহরিকম্প অ্যাঙ্কর এবং অতিথিদের। এই বুঝি প্রাণ যায়!
অ্যাঙ্কর-সহ অতিথিদের মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হল। এর পরেই চ্যানেলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দক্ষিণ আমেরিকার ছোট দেশ ইকুয়েডরের ভয়াবহ অবস্থা। টিভি চ্যানেলে দুষ্কৃতী তাণ্ডব তারই একটি ছোট্ট উদাহরণ।
গত সোমবার থেকে লাতিন আমেরিকার ওই দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। আপাতত তার মেয়াদ ৬০ দিন। আর তারই ‘প্রতিবাদে’ পথে নেমে দিনেদুপুরে রাহাজানি চলছে রমরমিয়ে। বইছে রক্তগঙ্গা। অপহরণের অভিযোগ আর কেউ জানাচ্ছেনই না, পরিস্থিতি এমনই অগ্নিগর্ভ।
লাতিন আমেরিকার এই ছোট্ট দেশে গণতন্ত্র আছে বইয়ের পাতায়। নিন্দকেরা বলেন, আসলে দেশ চালান মাফিয়ারা। সম্প্রতি সেই অপশাসনের অবসান ঘটানোর শপথ নিয়ে মসনদে বসেছেন ড্যানিয়েল নোবোয়া। দেশের ৪৮তম প্রেসিডেন্ট তিনি। বয়স মাত্র ৩৫ বছর।
১৯৮৭ সালের ৩০ নভেম্বর ফ্লোরিডার মিয়ামি উপকূলে জন্ম ড্যানিয়েল রয় গিলক্রিস্ট নোবোয়া আজ়িনের। দেশের সবচেয়ে ধনী আলভারো নোবোয়া এবং ফিজিশিয়ান অ্যানাবেলা আজ়িনের সন্তান ড্যানিয়েল পড়াশোনা করেছেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়েছেন হার্ভার্ড এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতেও।
অত্যন্ত মেধাবী ড্যানিয়েল নোবোয়া যে কখনও রাজনীতিতে আসবেন, তা ছাত্রাবস্থায় ভাবতেই পারেননি কেউ। সেই ড্যানিয়েলই ২০২১ সালে ইকুয়েডরের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য হন। সেই সময়ই পণ করেছিলেন, দেশে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্যের অবসান ঘটাবেন। সে জন্য প্রাণ গেলে যাক!
২০২৩ সালের নভেম্বরে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন। শুরু হয় তাঁর সংস্কারের লক্ষ্যে ‘লড়াই’। যে লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতেই এখন জ্বলছে পুরো দেশ। অদ্ভুত আঁধারে আচ্ছন্ন ইকুয়েডর। পরিস্থিতি জরিপ করে নোবোয়াকে অভ্যন্তরীণ সামরিক অবস্থা জারি করতে হয়েছে। যা জরুরি অবস্থার সময় বিশেষতম পরিস্থিতিতে জারি করার সংস্থান রয়েছে।
দেশে নিয়মকানুন ফেরাতে যখন মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু করেন নোবোয়া, তখনই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাদক পাচারকারী গ্যাং ‘লোস চোনেরোস’। মেক্সিকো এবং কলম্বিয়ার মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে ইকুয়েডরে ‘ব্যবসা’ চালায় লোস চোনেরোস।
নোবোয়া সংস্কারের ঘোষণা করতেই ঘটে এক মহানাটকীয় ঘটনা। বিপুল নিরাপত্তার বেড়াজাল ভেঙে রাতারাতি জেল থেকে পালিয়ে যান লোস চোনেরোসের প্রধান তথা ইকুয়েডরের সবচেয়ে বিপজ্জনক মাদক ব্যবসায়ী তথা মাফিয়া ডন জোসে আডোলফো মাসিয়াস ওরফে ফিটো।
মাসিয়াসকে মাদক পাচার, খুন এবং অসংখ্য সংগঠিত অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তিনি গুয়াকিল বন্দরের ‘লা রিজিয়োনাল’ জেলে বন্দি ছিলেন। তাঁরা সাজার মেয়াদ ছিল ৩৪ বছর। রবিবারই তাঁকে ওই শহরেরই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পন্ন একটি ভবনে স্থানান্তরিত করার কথা ছিল। কারণ, প্রশাসনের সন্দেহ ছিল মাসিয়াস জেল থেকে পালানোর চেষ্টা করতে পারেন। সে জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে একটি ভবনকে জেলে রূপান্তরিত করে সেখানে মাসিয়াসকে রাখার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রাত পোহানোর আগেই পাখি হাওয়া!
এর পরেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন নোবোয়া। তার বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে সরাসরি হিংসার আশ্রয় নেয় মাদক কারবারীরা। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ফিটোর নেতৃত্বে লোস চোনেরোস। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে সে দেশের পথঘাট।
অসংখ্য থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের আধিকারিকদের একটি বড় অংশকে অপহরণ করে নিয়েছে দুষ্কৃতীরা। অবশিষ্ট নেই একটি এটিএম কাউন্টারও। গোটা দেশে কার্যত নৈরাজ্য বিরাজ করছে। সোমবার থেকেই নৈশ কার্ফু জারি করেছেন নোবোয়া। কিন্তু দিনের বেলাও হিংসা যেন প্রতি মুহূর্তে বেলাগাম হয়ে উঠছে।
এই পরিস্থিতির ফয়দা তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছে মেক্সিকো এবং কলম্বিয়ার বিভিন্ন ড্রাগলর্ড। তাঁরাও নিজেদের মতো করে ইকুয়েডরের বিভিন্ন গ্যাংকে সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে সংঘর্ষ এই বহুমুখী হয়ে উঠেছে ছোট্ট এই দেশে।
ভৌগোলিক ভাবে কলম্বিয়া এবং পেরুর কোকেন করিডোরের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করে ইকুয়েডর। ফলে এই দেশের মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা ওই দেশগুলিরও। যার পরিণতিতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে ইকুয়েডরে লাফিয়ে বাড়ছে খুনজখমের ঘটনা।
একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি জলের মতো সহজ হবে। শুধুমাত্র ২০২৩ সালে সে দেশে খুন হয়েছেন ৭,৮০০ জন মানুষ। দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে। ব্যাপক দারিদ্র। সেই সুযোগে মাদক কারবারে গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েদের অন্তর্ভুক্তিও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিরই অবসান ঘটানোই লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট নোবোয়ার।