প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে চলতি সংঘাতে ইজ়রায়েলের পাশেই দাঁড়িয়েছে বন্ধুরাষ্ট্র আমেরিকা। বুধবারই ওয়াশিংটন থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ ভর্তি বিমান পৌঁছে গিয়েছে ইজ়রায়েলের দক্ষিণ প্রান্তের নেভাটিম বিমানঘাঁটিতে।
যুদ্ধ পরিস্থিতির সূচনাতেই মৌখিক ভাবে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছিল আমেরিকা। পরে ইহুদিপ্রধান দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনেও কথা হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের।
বুধবারই বাইডেনের দূত হয়ে ইজ়রায়েলে পৌঁছেছেন আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ইজ়রায়েলি প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ আধিকারিকের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।
আমেরিকা যখন সরাসরি ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছে, সেই সময় ওয়াশংটনকে দুষে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, প্যালেস্তাইনের স্বার্থের দিকটি বরাবর উপেক্ষা করে এসেছে আমেরিকা।
তবে ইজ়রায়েলের প্রতি আমেরিকার এই সমর্থন নতুন কোনও ঘটনা নয়। ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের গোড়ার দিন থেকেই আমেরিকা ‘ত্রাতা’ হিসাবে ধরা দিয়েছে ইজ়রায়েলবাসীর কাছে।
ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার বিষয়টি ব্রিটেন প্রথম প্রকাশ্যে আনলেও, ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর তাকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল আমেরিকাই।
১৯৪৮ সালের পর আমেরিকায় একাধিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন। কখনও ক্ষমতায় এসেছেন রিপাবলিকানকা, তো কখনও ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু মোটের উপর আমেরিকার ইজ়রায়েল-নীতিতে কোনও বদল আসেনি।
জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার এবং তাঁর নাৎসিবাহিনীর হাতে ইহুদিনিধনের আবহে বহু ইহুদির কাছে আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে আমেরিকা। পরে বিশ্বে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের একটি অখণ্ড দেশ দেওয়ার যে দাবি, তাতে জলহাওয়া জুগিয়েছিল আমেরিকা-সহ সমগ্র পশ্চিমি দুনিয়াই।
ইজ়রায়েলকে স্বতন্ত্র দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় নিজেদের মুক্ত এবং উদার নীতির ধারক হিসাবে যেমন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, তেমনই খনিজ তেলসমৃদ্ধ আরব দুনিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতেও চেয়েছিল।
অবশ্য ইজ়রায়েলকে পশ্চিম এশিয়া জয়ের বাহন করতে চাইলেও, কখনও কখনও দর কষাকষির পাশেও হেঁটেছে আমেরিকা। যেমন ইজ়রায়েল পরমাণু শক্তিধর হওয়ার বাসনায় খানিক লাগাম পরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি।
আবার আর এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন আরব-ইজ়রায়েল সংঘাতে লাগাম পরাতে মুখোমুখি বৈঠকে বসিয়েছিলেন ইজ়রায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়াৎজ়াক রবিন এবং প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশন (পিএলও) প্রধান ইয়াসের আরাফতকে।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময়েও দু’পক্ষের শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে আমেরিকা। সেই চেষ্টাগুলি অবশ্য দীর্ঘমেয়াদে বিশেষ সাফল্য পায়নি।
বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকার বিদেশনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই তিনি ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ান। পাশাপাশি এ-ও জানিয়ে দেন যে, বিতর্কিত ভূখণ্ড ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ‘জবরদখল’ করে রেখেছে ইজ়রায়েল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য ভারসাম্য রক্ষার কোনও চেষ্টাই করেননি। বরং ইজ়রায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতকে আরও উস্কে দেন তিনি। ইজ়রায়েলের আমেরিকান দূতাবাসকে বিতর্কিত ভূখণ্ড জেরুসালেমে সরিয়ে নিয়ে আসেন।
বার্তা স্পষ্ট যে, জেরুসালেম ইজ়রায়েলেরই অংশ। এর পাশাপাশি ট্রাম্পের আমলে খানিক আমেরিকার কূটকৌশলেই ইজ়রায়েলকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় বাহরিন, সৌদি আরব আমিরশাহি। পরে স্বীকৃতি দেয় মরক্কো এবং সুদানও।
দল এবং নীতি আলাদা হলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনও মোটের উপর ট্রাম্পের নীতিই বজায় রেখেছেন। আমেরিকার পাশাপাশি ইজ়রায়েলের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন।
আরবভূমে খানিক অনাহূতের মতো প্রবেশ করার কারণেই নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভীতি গোড়ার দিন থেকেই ইজ়রায়েলের সঙ্গী। আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার দায় তাদের তরফেও ছিল।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, উপসাগরীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে লাভের লাভ কিছুই হয়নি আমেরিকার। যুদ্ধে জয়ী হয়েও ওয়াশিংটনের অধরা থেকে গিয়েছে পশ্চিম এশিয়ার বড় অংশই।
হামাসের নেপথ্যে ইরানের হাত থাকার ইঙ্গিত আমেরিকার কাছে এই বার্তাই তুলে ধরেছে যে, বরাবর বেপরোয়া হয়েই রয়ে যাবে আরবভূমের এই অংশ। তাই ইজ়রায়েলের মাধ্যমে বিদ্রোহী আরব জাতীয়তাবাদীদের দমন করার নীতি নিয়েই এগোচ্ছে আমেরিকা।
এহ বাহ্য যে, আরব জাতীয়তাবাদেও বড় ফাটল ধরেছে। অনমনীয়তা ছেড়ে সৌদি আরবের মতো দেশও ইজ়রায়েলের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চাইছে। এখানেও নেপথ্যে সেই আমেরিকাই। ইরান আর সৌদিকে কাছাকাছি এনে এই অঞ্চলে ঢুকতে চাইছে চিনও।
আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের চরমপন্থী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কথাও। ক্লিন্টনের উপস্থিতিতে আরাফতের সঙ্গে হাত মেলানো ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী রবিনকে খুন হতে হয় নিজের দেশেই।
বলা হয় যে, রবিনের প্যালেস্তাইনের প্রতি নরম অবস্থান মেনে নেননি অনেকেই। আবার প্যালেস্তাইনেও আরাফতের তুলনায় নরম পথ মেনে নেয়নি অনেকেই। পিএলও-র জায়গায় এসেছে হামাস— যারা ইজ়রায়েল রাষ্ট্রটাকেই বিলোপ করার পক্ষপাতী।
এই আবহেই আরও কাছাকাছি এসেছে আমেরিকা এবং ইজ়রায়েল। দুই দেশের মধ্যে আরও দৃঢ় হয়েছে দ্বিপাক্ষিক এবং রণকৌশলগত বোঝাপড়া।