‘সোনার কেল্লা’র মুকুল কি শুধুই কল্পনা? না কি বাস্তব জীবনেও রয়েছে উদাহরণ? জন্ম-মৃত্যু কখনওই মানুষের হাতে থাকে না। সে কখন জন্ম নেবে বা কখন মৃত্যুর কোল ঢোলে পড়বে কেউ জানে না। এই জন্ম-মৃত্যু নিয়ে অনেক লোকগাথা প্রচলিত রয়েছে।
গ্রামে-গঞ্জে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় কেউ তার আগের জন্মের সমস্ত ঘটনা অনর্গল বলে দিচ্ছেন। কেউ বা বলে দিচ্ছেন তিনি কখন কী ভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। কেউ এই সব কথা সত্যিই বলে ধরে নেন। অনেক ধর্মে এই পুনর্জন্মে বিশ্বাসী লোকজনকে দেখতে পাওয়া যায়। যদিও এই পুনর্জন্মের কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি।
প্রচলিত আছে গৌতম বুদ্ধও নাকি তাঁর আগের জন্মের কথা বলতে পারতেন, যেগুলি জাতকের গল্প নামেই পরিচিত। বিগত জন্মের এমন এক ঘটনার সঙ্গে মহাত্মা গাঁধীর নামও জড়িয়ে রয়েছে।
মহাত্মা গাঁধীকে এক মহিলা তাঁর পুনর্জন্মের কথা বলেছিলেন। গাঁধী তা বিশ্বাসও করেন এবং সে বিষয়ে তদন্ত করার জন্য কমিশনও গঠন করেন। ওই মহিলার নাম শান্তি দেবী।
কে এই শান্তা দেবী? দেশের রাজধানী দিল্লিতে ১৯২৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। সাধারণ শিশুরা চার বছর বয়সে কথা বলতে অনেক সড়গড় হয়ে যায়। কিন্তু শান্তি দেবী শৈশবে অনেকদিন কথা বলেননি। চার বছর বয়সে কথা বলতে শুরু করেন।
ছোট থেকেই তিনি তাঁর বাবা-মাকে তাঁর আগের জন্মের কথা বলতেন। তাঁর ‘আসল ঘর’, ‘আসল বাবা-মা’ ইত্যাদি সম্পর্কে বলতেন।
স্কুলে ছোট বাচ্চারা পড়াশোনা বাদে যা কাজকর্ম করত তার ধারে কাছ দিয়েও যেতেন না শান্তি দেবী। তিনি স্কুলে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে নিজের স্বামীর ব্যাপারে কথা বলতেন। তাঁর খোঁজও নিতেন। কিন্তু স্বামীর নাম বলতেন না কিছুতেই। স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে মথুরার স্থানীয় ভাষায় কথা বলতেও শুনেছিলেন।
অনেক জোরাজুরি করার পর শান্তি দেবী তাঁর স্বামীর নাম প্রকাশ্যে আনেন। তাঁর স্বামীর নাম কেদারনাথ চৌবে। সঙ্গে এ-ও বলেন যে, শান্তি দেবীর আগের জন্মের নাম ছিল লুগ্দী দেবী।
তিনি আরও বলেন ১৯২৫ সালের অক্টোবরে একটি বাচ্চার জন্মও দিয়েছিলেন। বাচ্চার জন্ম দেওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই মারা যান লুগ্দী দেবী। ওই টুকু বাচ্চা কী করে এত কিছু অনর্গল বলে দিচ্ছে সেটা ভেবেই অনেকে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন।
শান্তি দেবীর স্বামীর নাম জানতে পারার পরই মথুরাতে তাঁর খোঁজ শুরু হয়ে যায়। শান্তি দেবী শুধু নামই বলেননি, স্বামীর চেহারার বিস্তারিত বিবরণও দিয়েছিলেন।
অবশেষে খোঁজ পাওয়া তাঁর স্বামীর। খোঁজ পাওয়ার পরই শান্তি দেবীর এক আত্মীয় কেদারনাথকে চিঠি লিখে বিস্তারিত সব ঘটনা জানান। কেদারনাথ চিঠির জবাব জানান, শান্তি যা বলছে সব সত্যি।
শান্তি দেবী তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে দিল্লিতে কেদারনাথের খুড়তুতো ভাই কাঞ্জীবনের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে চিনতেও পারেন।
কেদারনাথ পরে তাঁর ছেলে এবং তৃতীয় স্ত্রীয়ের সঙ্গে দিল্লিতে এসে শান্তি দেবীর সঙ্গে দেখা করেন। প্রথম সাক্ষাতে নিজেকে কেদারনাথের বড় ভাই বলে শান্তি দেবীর সঙ্গে পরিচয় করান কেদারনাথ। কিন্তু শান্তি দেবী কেদারনাথের ছেলে নবনীতলালকে চিনে ফেলেন।
কেদারনাথ একান্তে শান্তি দেবীর সঙ্গে কথা বলার পর সকলকে বলেন যে শান্তিই লুগ্দী দেবী। কারণ শান্তি এমন কিছু কথা কেদারনাথকে বলেছিলেন, যেগুলো লুগ্দী দেবী ছাড়া আর কেউ জানতেন না।
কয়েক দিন পর কেদারনাথরা বাড়ি চলে যাওয়ার পর শান্তি দেবী মথুরা যাওয়ার জন্য বাড়ির লোকের উপর জোরাজুরি করতে শুরু করেন। তিনি তাঁর বাড়ির লোকদের আরও বলেন যে, মথুরার বাড়ির ঠিকানা তিনি বলতে পারবেন। সঙ্গে এ-ও বলেন যে, ওই বাড়িতে তাঁর একটি পাত্রও রয়েছে যার মধ্যে টাকাপয়সা রাখা রয়েছে।
শান্তি দেবীকে নিয়ে চর্চা তখন দেশ জুড়ে। সেই চর্চা মহাত্মা গাঁধীর কানে এসেও পৌঁছয়। ঘটনার সত্যতা বিচার করতে তিনি একটি কমিশন গঠন করেন এবং তদন্তের নির্দেশ দেন।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে কমিশনের লোকজন শান্তি দেবীর সঙ্গে মথুরা যান। সেখানে শান্তি দেবীকে দেখতে ভিড় করে থাকা লোকজনের মধ্যে অনেক আত্মীয়কে তিনি চিনতে পারেন। তার মধ্যে লুগ্দী দেবীর এক দাদুও ছিলেন।
১৯৩৬ সালে কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টে লেখা ছিল লুগ্দী দেবীই শান্তি দেবী নামে পুনর্জন্ম নিয়েছেন।
সেই সময় আরও দু’টি পৃথক রিপোর্টও লেখা হয়েছিল। দু’টি রিপোর্টই মহাত্মা গাঁধীর গঠন করা কমিশনের রিপোর্টকে খণ্ডন করেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, শান্তি দেবীর দাবির প্রেক্ষিতে এমন কোনও মজবুত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা তাঁর পুনর্জন্মের তত্ত্বকে স্থাপিত করে।
আজীবন অবিবাহিত থেকে গিয়েছিলেন শান্তি দেবী। জীবদ্দশায় অনেকবার তাঁকে তাঁর পুনর্জন্মের গল্প শোনাতে হয়েছে। মৃত্যুর চার দিন আগে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে লোকজন দেখা করে গিয়েছিলেন, যাঁরা তাঁকে এবং তাঁর গল্পের সত্যতা নিয়ে খোঁজ করছিলেন। ১৯৮৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর শান্ত দেবীর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর পুনর্জন্মের গল্প আজও লোকমুখে চর্চিত।