চলছে নিট-বিতর্ক। ডাক্তারির সর্বভারতীয় সেই প্রবেশিকা পরীক্ষাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। আর তার সঙ্গেই এ বার নাম জড়িয়ে পড়ল ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগের।
মনে করা হচ্ছে, নিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জাল বিহার ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছিল হাজারিবাগে। শুধু নিটের নয়, বহু সরকারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সক্রিয় চক্র রয়েছে ঝাড়খণ্ডের ওই শহরে।
বিহার পুলিশের আর্থিক দুর্নীতি দমন শাখা (ইএইউ) সূত্রে খবর, নিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত ছিল হাজারিবাগের একটি বেসরকারি স্কুল। সেই স্কুল থেকেই ফাঁস হয়েছে এমন একটা প্রশ্নপত্র, যা তদন্তকারীদের হাতে এসেছে।
ইএইউ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই স্কুল যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, সে সংক্রান্ত প্রমাণ রিপোর্টের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। আর সেই প্রমাণ থেকেই পুরো বিষয়টিতে পরীক্ষার আয়োজক সংস্থা এনটিএ-র জড়িত থাকার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে। তদন্তভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে।
গত ১৫ মার্চ বিহার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও হাজারিবাগ থেকেই ফাঁস হয়েছিল। অভিযোগ, বিহারের নালন্দা জেলার ১১৩ জন-সহ মোট ২৬৮ জন পরীক্ষার্থীকে হাজারিবাগের বিভিন্ন এলাকায় রেখে পরীক্ষার আগের রাতে তাঁদের হাতে প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছিল।
ঝাড়খণ্ড এবং বিহার পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় বিপিএসসি পরীক্ষার দুর্নীতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থী এবং পেপার ফাঁস চক্রের অনেক মাথাকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তকারীদের অনুমান, হাজারিবাগে সক্রিয় তেমনই এক চক্র জড়িত নিটের প্রশ্নফাঁসের সঙ্গেও।
তবে এই সব প্রশ্নফাঁসের ঘটনাতেই যে ব্যক্তির নাম বার বার উঠে আসছে, তিনি সঞ্জীব মুখিয়া ওরফে সঞ্জীব কুমার ওরফে লুটন। সঞ্জীব বিহারের নুরসরাইয়ের হর্টিকালচার কলেজের কর্মী।
অভিযোগ, নিট পরীক্ষার এক দিন আগে পটনা এবং রাঁচীতে লার্ন প্লে স্কুল অ্যান্ড বয়েজ় হস্টেলে ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিয়ে আসেন সঞ্জীব। সেখানে তাঁদের দিয়ে নিটের প্রশ্নপত্রের উত্তর লেখানো হয়। তার পর সেই উত্তরগুলি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল।
ওই লার্ন প্লে স্কুল অ্যান্ড বয়েজ় হস্টেলে আগে থেকেই পরীক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন সঞ্জীব। সেখানেই তাঁদের প্রশ্ন এবং উত্তরপত্র বিলি করা হয় লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে।
কেউ যাতে সন্দেহ না করে, তাই কোনও ভিড়বহুল এলাকাতে পরীক্ষার্থীদের না রেখে, গ্রামের সুনসান জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন সঞ্জীব।
সঞ্জীব-পুত্র শিব মুখিয়া বিপিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম চক্রী। সেই ঘটনায় আগেই গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। বর্তমানে তিনি জেলে। অভিযোগ, শিবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ ছিল হাজারিবাগের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের।
শিবকে গত ২১ এপ্রিল মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় তাঁর চার সহযোগীকেও। ২০১৭ সালেও পটনার একটি থানায় নিট প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত মামলায় তাঁর নাম জড়িয়েছিল।
ইএইউ সূত্রে জানা গিয়েছে, বিহার সীমান্তে হওয়ার কারণে হাজারিবাগকেই প্রশ্নফাঁসের ‘মুক্তাঞ্চল’ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন সঞ্জীব এবং তাঁর ‘নেটওয়ার্ক’। সঞ্জীবের ‘হাজারিবাগ গ্যাং’ শিক্ষক নিয়োগ এবং নিট— উভয় পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যুক্ত।
নালন্দা জেলার শাহপুর বলওয়া গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জীব। তাই তাঁর ‘গ্যাং’-এর সদস্যেরা, নালন্দা থেকে শুরু করে হাজারিবাগ পর্যন্ত সক্রিয় বলেও মনে করা হচ্ছে।
তদন্তকারীদের অনুমান, সঞ্জীব এবং তাঁর সহযোগীরা ছক কষতেন নালন্দায় বসে। তা ফলপ্রসূ করতে ব্যবহার করতেন হাজারিবাগকে। নিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রেও তাঁরা সেই সূত্র ধরেই কাজ করেছিলেন বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
নিট প্রশ্নপত্র ফাঁসকাণ্ডে সঞ্জীব এখনও অধরা। তবে তাঁকে খুঁজে বার করতে নালন্দা, গয়া এবং নওয়াদা জেলায় পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, নিটকাণ্ডে এখনও পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য দিকে, ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) যাতে ‘অবাধ এবং স্বচ্ছ’ ভাবে পরীক্ষা নিতে পারে, সে জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়েছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক। সাত সদস্যের প্যানেলের মাথায় থাকবেন ইসরোর প্রাক্তন প্রধান কে রাধাকৃষ্ণণ।
এনটিএ-র প্রধানকেও পদ থেকে সরানো হয়েছে। নিটে বেনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের হাতে।
এই আবহে শনিবার নিট-পিজিও স্থগিত করার কথা ঘোষণা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) নিয়ে একের পর এক অভিযোগ প্রকাশ্যে আসছে। সেই কথা মাথায় রেখেই এনটিএ যাতে অবাধ, স্বচ্ছ ভাবে পরীক্ষা নিতে পারে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করার প্রয়োজন। সেই কারণেই পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সেই পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকতে পারে বলে প্রশ্ন উঠছে। তবে এ নিয়ে এখনও মুখ খোলেনি সরকার।