লীনা মনিমেকালাই। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, সম্মান এবং পুরস্কারের লম্বা তালিকা রয়েছে এই ভারতীয় চিত্র পরিচালকের। তবে ভারতীয়দের বেশির ভাগই তাঁকে প্রথম চিনলেন একটি তথ্যচিত্রের বিতর্কিত পোস্টারের জন্য। যা ভারতীয়দের একাংশের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে বলে দাবি।
পোস্টারটি লীনারই বানানো একটি তথ্যচিত্রের। ছবির নাম ‘কালী’। কানাডার একটি চলচ্চিত্রোৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার কথা ছিল তথ্যচিত্রটি। লীনা জানিয়েছেন, কানাডারই টরন্টোর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক ভবঘুরে মহিলা অভিনেত্রীর জীবন নিয়ে ছবিটি তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই ছবির পোস্টার ঘিরে বিতর্ক এখন বাড়তে বাড়তে ধর্মীয় ভাবাবেগের আওতা ছেড়ে রাজনীতির উঠোনে ঢুকে পড়েছে। লীনার নামে তাঁর নিজের দেশেরই বিভিন্ন রাজ্যে দায়ের করা হয়েছে এফআইআর।
লীনার বায়োডাটা বলছে তিনি স্ব-শিক্ষিত চিত্র পরিচালক। অর্থাৎ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রথাগত প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রি নিয়ে তিনি সিনেমা বানানো শেখেননি। সেই শিল্প তিনি নিজেই নিজেকে শিখিয়েছেন। শিক্ষা যে বেপথে এগোয়নি, তার প্রমাণ এ বছরই লীনার পাওয়া আন্তর্জাতিক সিনেমা সম্মান ‘বাফতা’র স্বীকৃতি। বাফতা কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের যে ১০ জন সম্ভাবনাময় ভারতীয় চিত্র পরিচালককে সাহায্য করার অঙ্গীকার করেছে, তাঁদের মধ্যে লীনা অন্যতম।
তবে সেই লীনা আপাতত সমালোচনার মুখে। কারণ তাঁর তথ্যচিত্রের পোস্টারে দেবী কালীরূপী ছবির মুখ্যচরিত্রকে দেখা যাচ্ছে সিগারেট হাতে নিয়ে ধূমপান করতে। এমনকি কালী রূপে ওই মহিলার নকল হাতের একটিতে রূপান্তরকামীদের আন্দোলনের সাতরঙা পতাকাও ধরিয়েছেন তিনি।
পোস্টারটি নেটমাধ্যমে প্রকাশ্যে আসতেই তা নিয়ে অসন্তোষে ফেটে পড়েন কানাডায় বসবাসকারী ভারতীয়দের একাংশ। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, ভারতীয় হাই কমিশনের তরফে কানাডা প্রশাসনের কাছে নির্দেশ যায় অবিলম্বে ওই পোস্টার সরিয়ে ফেলার। টরন্টোর আগা খান জাদুঘর দুঃখপ্রকাশ করে জানিয়ে দেয়, তাঁরা অসাবধানতাবশত যে ভুল করে ফেলেছে, তার জন্য তাঁরা অনুতপ্ত।
১৯৮০ সালের ৭ জুন মাদুরাইয়ে জন্ম লীনার। বাবা ছিলেন কলেজের শিক্ষক। বাবার হাত ধরে সিনেমার সঙ্গে পরিচয় লীনার। এক সাক্ষাৎকারে এক বার জানিয়েছিলেন, বাবার কোলে বসে বহু বার হলে সিনেমা দেখেছেন।
সিনেমার পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে আগ্রহ লীনার— কবিতা। স্কুলে পড়তে পড়তেই কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি।
স্কুলের গতে বাঁধা পড়াশোনা কোনওদিনই টানেনি লীনাকে। যদিও প্রত্যেক বছর ক্লাসে প্রথম হতেন । পড়াশোনায় আগ্রহ নেই দেখে লীনার পরিবার ঠিক করে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেবে। ১৮ বছর বয়সে তাঁর দূর সম্পর্কের মামার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় লীনার। বিয়ে এড়াতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান হবু পরিচালক।
লীনা এক সাক্ষাৎকারে সেই ঘটনার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের গ্রামের নিয়মই ছিল ওই রকম। মেয়েদের বিয়ের বয়স হলেই তার মামার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম বিয়ে করব না।’’ বাড়ি থেকে পালিয়ে একটি তামিল পত্রিকার দফতরে কাজ নিয়ে চেন্নাই চলে গিয়েছিলেন লীনা। কিন্তু পত্রিকার অফিস থেকে লীনার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের খবর দিয়ে দেওয়া হয়।
বিয়ে না করার শর্তে বাড়ি ফিরে আসেন লীনা। সিনেমা আর কবিতায় আগ্রহী ছাত্রী বাধ্য হন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে। কিন্তু সেই পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায় মাঝপথে। লীনা যখন তৃতীয় বর্ষে, তখন দক্ষিণের চিত্র পরিচালক ভারতীরাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। তিনি ঠিক করেন পরিচালককে সাহায্য করবেন। পড়াশোনা ছেড়ে সিনেমার কাজ শুরু করেন লীনা।
এই পর্বে এক বিবাহিত দক্ষিণী নায়কের সঙ্গে নাম জড়ায় তাঁর। পত্রিকা, খবরের কাগজে তাঁর নাম বেরোতে শুরু করে। খবর পৌঁছয় বাড়িতেও। লীনাকে অবিলম্বে সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসার নির্দেশ দেন তাঁর মা। ফিল্মের কাজ ছেড়ে আসার ইচ্ছে না থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয় লীনাকে। এক সাক্ষাৎকারে লীনা বলেছিলেন, ‘‘আমি ফিরে আসতে চাইনি। কিন্তু মা জেদ ধরেছিলেন। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর শরীর অসুস্থ হতে শুরু করে।’’
ফিল্মের কেরিয়ার ছেড়ে আবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফেরেন লীনা। কিন্তু সিনেমা ছেড়ে কাজে মন বসাতে পারছিলেন না। দু’বছরে ১১টি আইটি সংস্থায় চাকরি নেন এবং ছাড়েন। শেষে ২০০২ সালে লীনা ঠিক করেন, স্বপ্নের পথেই হাঁটবেন। সিনেমাকে ঘিরেই বানাবেন নিজের কর্মজীবন।
তবে সিনেমায় গত ২০ বছরে লীনার কাজ যেমন সাফল্য দেখেছে তেমনই দেখেছে বিতর্কও। কখনও অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ মুহূর্তে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রযোজক। জবাবে স্বাধীন ভাবে সেই একই ছবি বানিয়েছেন লীনা। আবার কখনও যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন ফিল্ম পরিচালকের হাতে। প্রকাশ্যে সে কথা জানাতে গেলে সর্বসমক্ষে তাঁকেই অপদস্থ করেছেন সেই পরিচালক। সাহায্য করেনি পুলিশও।
তবু এ সবের মধ্যে দিয়েই একের পর এক তথ্যচিত্র, স্বাধীন ছবি বানিয়ে গিয়েছেন লীনা। বরাবর সামাজিক, অবহেলিত বিষয়কেই ছবিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতপাত, বর্ণবৈষম্য, তামিলনাড়ুর জেলেদের সমস্যা, মহিলাদের সমস্যা, রূপান্তরকামীদের কথা উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে। লীনার পরিবার বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। তাই তাঁর ছবিতে ঘুরে ফিরে এসেছে শ্রীলঙ্কার মানুষের সঙ্কটের কথাও। যা ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে দেখে বড় হয়েছেন লীনা।
লীনার তৈরি সেই সব ছবি, তথ্যচিত্র আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কৃত হওয়ার পাশাপাশি নানা সম্মানও পেয়েছে।
এ সবের পাশাপাশি নিজের দ্বিতীয় ভালবাসা কবিতা নিয়ে অজস্র কাজ করেছেন। ছেপে বেরিয়েছে তাঁর অনেকগুলি কবিতার বই। সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছে সে সব। তামিল ভাষায় প্রথম সমকামীদের নিয়ে কবিতার বই লিখেছিলেন তিনিই। এই সব কিছুর সঙ্গে লীনা অভিনয়ও করেছেন। নিজের ছবিতে তো বটেই, অন্য উঠতি পরিচালকদের ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
দেশের মননশীল ফিল্মপরিচালক হিসেবে তাঁর নাম উঠে আসতেই পারত জোয়া আখতার, মীরা নায়ার, গৌরী শিন্ডে, দীপা মেহতা কিংবা মেঘনা গুলজারদের পাশে। লীনাও বিখ্যাত হতে পারতেন এঁদের মতোই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। তাঁর পোস্টার-বিতর্ক তাঁকে হয়তো চিনিয়েছে দেশের মানুষের কাছে। কিন্তু হয়তো এ ভাবে বিখ্যাত হতে চাননি লীনা।