পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধে দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বিপদ। হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথিদের আক্রমণ ঠেকাতে ‘জিপিএস স্পুফিং’ করছে ইহুদি ফৌজ। তেল আভিভের এই নেভিগেশন হামলায় বেসামাল অসামরিক উড়ান পরিষেবা! যাত্রিবাহী বিমানের দুর্ঘটনার আশঙ্কায় নয়াদিল্লির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
কী এই ‘জিপিএস স্পুফিং’? একে এক রকমের হ্যাকিং বলা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ২০২৩ সালের অক্টোবরে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক ‘গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ বা জিএনএসএসে সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েল। এরই পোশাকি নাম ‘জিপিএস স্পুফিং’।
উল্লেখ্য, ইহুদিভূমিতে নিখুঁত নিশানায় ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট হামলা চালাতে ‘গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম’ বা জিপিএস ব্যবহার করছে হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথি বিদ্রোহীরা। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, সেটা ঠেকাতেই ‘জিপিএস স্পুফিং’ করছে ইজ়রায়েল। এর সাহায্যে গ্লোবাল নেভিগেশন এ দিক-ও দিক করতে পারছেন তারা।
‘জিপিএস স্পুফিং’-এর সাহায্যে শত্রুর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেটকে ভুল দিকে পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে ইজ়রায়েল। কিন্তু, জিএনএসএস হ্যাকিঙের ফলে যাত্রিবাহী বিমানের পাইলটেরাও ভুল তথ্য পাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে উড়োজাহাজের নেভিগেশন সিস্টেম। আর তাই মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা।
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজ়রায়েলি ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর সর্বাধিক প্রভাব পড়েছে পশ্চিম এশিয়ায়। এর জন্য মারাত্মক ভাবে ভুগছে ইরান এবং পাকিস্তান। ভুগছে ভারতও। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে গত ১৫ মাসে ভারতে যাত্রিবাহী বিমানের নেভিগেশন সিস্টেমে ৪৬৫টি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে সরকারি তরফে জানা গিয়েছে।
ইহুদিদের ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর প্রভাব মূলত পাক সীমান্তবর্তী অমৃতসর এবং জম্মু এলাকায় দেখা গিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ওপিএস গ্রুপ। সেখানে ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকায় উত্তর-পশ্চিম নয়াদিল্লি এবং পাকিস্তানের লাহোর ও এর আশপাশের এলাকার নাম বলা হয়েছে।
গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অগস্টের মধ্যে ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর নিরিখে বিশ্বে নবম স্থানে ছিল উত্তর-পশ্চিম দিল্লি, পাকিস্তানের লাহোর এবং তার আশপাশের এলাকা। ওই এক মাসে সেখানকার ৩১৬টি বিমানের ওঠানামা এর জন্য ব্যাহত হয়।
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, গত বছর ভারতে ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর ঘটনা ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বিষয়টি নিয়ে পাইলট থেকে শুরু করে যাত্রিবাহী বিমানের ৭০ শতাংশ ক্রু উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পূর্ব ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর এবং এশিয়ার বিরাট এলাকা ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর হটস্পট হয়ে উঠেছে বলে জানা গিয়েছে।
গত বছরের অগস্টে ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর জন্য বিশ্ব জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজারের বেশি বিমান পরিষেবা। পাইলটদের অভিযোগ, ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করার পর থেকেই নেভিগেশনে ভুল তথ্য আসতে শুরু করে। তুরস্কের আকাশসীমায় না পৌঁছোনো পর্যন্ত সেটি চলতে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইজ়রায়েল মূলত লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন, মিশর, তুরস্ক এবং সাইপ্রাসের উপর ‘জিপিএস স্পুফিং’ করছে। তাদের এই সাইবার আক্রমণ বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই কারণে বাণিজ্যিক বিমানের নিরাপত্তা মারাত্মক প্রভাবিত হচ্ছে।
‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের সবচেয়ে বড় বিপদ হল পাইলটের কাছে ভুল সঙ্কেত যাওয়া। উদাহরণ হিসাবে, ধরা যাক একটি উড়োজাহাজ ইরাকের বিমানবন্দরের কাছে রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরটির কোনও তথ্য পাবেন না চালক। ফলে প্রয়োজন থাকলেও সেখানে উড়োজাহাজ নামাতে পারবেন না তিনি।
সংবাদমাধ্যম ওপেনস্কাই নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, গত এক বছরে ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের জন্য পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির ৫০ হাজারের বেশি বিমানের পরিষেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার মুখে পড়ার মতো অবস্থাও হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে পাইলটদের বুদ্ধিমত্তায় সেগুলি এড়ানো যায়।
পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়মিত ভাবে ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর তথ্য সরবরাহ করে চলেছে সুইস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স। গত বছরের মার্চে লেবাননের রাজধানী বেইরুটগামী তুরস্ক এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ইজ়রায়েলি হামলার কারণে প্রায় ৪০ মিনিট আকাশে চক্কর কাটে। এর পর সেটি ফের তুরস্কে ফিরে গিয়েছিল।
বর্তমানে ‘জিপিএস স্পুফিং’ থেকে বাঁচতে পুরনো দিনের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করে পাইলটদের বিমান ওড়াতে হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে এ ব্যাপারে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে ভারতের ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন’ বা ডিজিসিএ। সেখানে এই ধরনের সমস্যায় বিমানচালকদের সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে।
এর পাশাপাশি বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজ়েশন’ বা আইসিএও এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পরিচালিত ‘ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন অ্যাভিয়েশন সেফটি এজেন্সি’ বা ইএএসএ নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া ‘জাতীয় বিমান চলাচল নিরাপত্তা পরিকল্পনা’ (ন্যাশনাল অ্যাভিয়েশন সেফটি প্ল্যান বা এনএএসপি) চালু করেছে সরকার।
কেন্দ্র জানিয়েছে, বিমান ওড়ানোর সময়ে ঝুঁকি কমানো, নিরাপত্তা জোরদার করা এবং ফ্লাইট ট্র্যাফিক বৃদ্ধি করাই এনএএসপির মূল লক্ষ্য। তবে এ ব্যাপারে বিপদ এড়াতে অবিলম্বে ইজ়রায়েলি সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
অন্য দিকে এই ইস্যুতে রাষ্ট্রপুঞ্জে ইহুদিভূমির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে লেবানন। ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) ‘জিপিএস স্পুফিং’কে বিপজ্জনক এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেছে বেইরুট।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ ব্যাপারে একটি শব্দও খরচ করছে না ইজ়রায়েল। সূত্রের খবর, ‘জিপিএস স্পুফিং’ শুরু করার পর থেকেই এ ব্যাপারে ভারতকে গোপনে সতর্কবার্তা দিয়েছে তেল আভিভ। তবে এই বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে নয়াদিল্লিও।