ব্রিটেনের মসনদে পালাবদল। নতুন প্রধানমন্ত্রী পেল ইংল্যান্ড। কনজ়ারভেটিভ পার্টিকে (টোরি) বিপুল ভোটে হারিয়ে জয় হাসিল করল লেবার পার্টি। পেরিয়ে গেল ৪০০-এর গণ্ডিও।
এ বারের ব্রিটেনের ভোটে মূলত লড়াই ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক এবং লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টার্মারের মধ্যে। সেখানেই ঋষির দলকে হারিয়ে শেষ হাসি হাসলেন কিয়ের। ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনিই।
টানা ১৪ বছর ইংল্যান্ডের মসনদে ছিল কনজ়ারভেটিভ পার্টি। এই সময়কালে দেশে অনেক রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে টোরিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তিন বার প্রধানমন্ত্রী বদলের প্রভাবও পড়ল এ বারে ভোটে।
সেই সঙ্গে ব্রেক্সিট–পরবর্তী সময় থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা-সহ সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের জনগণ বিরক্ত ছিল কনজ়ারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের উপর। তারই প্রতিফলন দেখা গেল ভোটবাক্সে।
৬১ বছর বয়সি রাজনীতিবিদ স্টার্মার প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁকে প্রথম থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। বর্তমানে দেশ যে যে সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে স্টার্মারকে।
১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন স্টার্মার। বেড়ে উঠেছেন সারের অক্সটেডে। পড়াশোনা শেষে আইনজীবী হিসাবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তার পরই রাজনীতিতে প্রবেশ।
স্টার্মারের বাবা ছিলেন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। আর মা ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নার্স হিসাবে কাজ করতেন।
ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি খুবই মনযোগী ছিলেন স্টার্মার। তবে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় ছাত্রজীবনেই। প্রথমে লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন স্টার্মার। পরিবারে তিনিই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।
১৬ বছর বয়সেই রাজনীতিতে যুক্ত হন স্টার্মার। লেবার পার্টি ইয়ং সোশ্যালিস্টে যোগ দেন তিনি।
কলেজের পড়াশোনা শেষ করে আইনজীবী হয়ে কাজ শুরু করেন স্টার্মার। ১৯৮৭ সালে এক জন ব্যারিস্টার হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি।
মানবাধিকার ব্যারিস্টার হিসাবে কর্মজীবনে সাফল্যও লাভ করেন তিনি। ২০০২ সালে কুইন্স কাউন্সেল হিসাবে নিযুক্ত হন স্টার্মার।
২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ড পুলিশিং বোর্ডের আইনি উপদেষ্টা ছিলেন স্টার্মার। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টরও ছিলেন তিনি। সেই সময়কালে স্টিফেন লরেন্স হত্যার মতো মামলা সামলেছেন তিনি।
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৪ সালে রানি এলিজ়াবেথের থেকে ‘নাইট’ উপাধি পান স্টার্মার। তবে নামের আগে ‘স্যর’ উপাধি খুবই কম ব্যবহার করতে দেখা যায় তাঁকে।
তার পরের বছরই সাংসদ হন স্টার্মার। লন্ডনের হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাস আসন থেকে লেবার পার্টির সাংসদ হয়ে আবার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার মাস কয়েক পরেই মাকে হারান। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।
লেবার পার্টিতে নিজের অবস্থান মজবুত করেন স্টার্মার। ২০২০ সালে লেবার নেতৃত্বের ভোটে বিপুল জয় পান তিনি। তার পরই দলের রাশ চলে আসে তাঁর হাতে।
ব্রিটেনে প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে স্টার্মার যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতায় বার বার উঠে এসেছে বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা।
দুই সন্তানের পিতা স্টার্মার। ২০০৭ সালে তাঁর প্রেমিকা ভিক্টোরিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। ভিক্টোরিয়াও স্টার্মারের মায়ের মতো পেশায় নার্স। যুক্ত রয়েছেন ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসের সঙ্গে।
এ বারের নির্বাচনী প্রচারে স্টার্মারের দল একাধিক বিষয় তুলে ধরেছে। তাদের ইস্তাহারে শিক্ষক নিয়োগ, নারী-শিশুদের প্রতি যত্নবান হওয়া, স্থিতিশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা-সহ একাধিক বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ বছর আগে কনজ়ারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারে বিপুল সাড়া মিলেছিল। ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ স্লোগানে ভর করে ‘হাউস অফ কমন্স’-এর ৩৬৫টিতে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন বরিস জনসন।
কিন্তু ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাসভবনে আড়াই বছরের বেশি কাটাতে পারেননি তিনি। দলের অন্দরে বিদ্রোহ এবং কোভিডবিধি ভেঙে পানভোজনের আসর বসানোর অভিযোগ মাথায় নিয়ে ২০২২ সালে জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তার পর লিজ় ট্রাসের ৪৯ দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব পর্বের শেষে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন ঋষি।
ঋষির শাসনকালে একাধিক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় ব্রিটেন। সে সব কাটলেও জনমত অন্য কথা বলছিল। জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাসকে সত্যি প্রমাণ করে বড় জয় পেল লেবার পার্টি। প্রধানমন্ত্রী হলেন স্টার্মার। লেবার পার্টির বিপুল জয়ের পর সমর্থকদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘‘পরিবর্তনের কাজ শুরু হবে আজ থেকেই।’’