সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের লাগাম কার হাতে উঠতে পারে? বোর্ডের সচিব জয় অমিতভাই শাহই কি সভাপতি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন? সৌরভের পর জয়ের পক্ষেই পাল্লা ভারী। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আইনগত ভাবে দু’জনের কার্যকালের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। আরও তিন বছরের জন্য সভাপতি এবং সচিব পদে থেকে যেতে পারেন সৌরভ এবং জয়। প্রশ্ন হল, সৌরভ কি আদৌ সভাপতি হতে পারবেন?
বুধবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি হিমা কোহলীর বেঞ্চের রায়ে আপাতত স্বস্তিতে রয়েছেন সৌরভ এবং জয়। কিন্তু আগামী তিন বছরের জন্য সভাপতি হতে গেলে সৌরভকে আরও এক বার নির্বাচনী দৌড়ে নামতে হবে। যদিও সেই নির্বাচনে সভাপতি হিসাবে সৌরভের লড়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ হতে শুরু করেছে।
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, রাজ্য সংস্থায় ছ’বছর এবং বোর্ডে ছ’বছর দায়িত্বে থাকতে পারেন এক জন আধিকারিক। অর্থাৎ ১২ বছর দায়িত্ব সামলানোর পর তিন বছরের জন্য ‘কুলিং অফ পিরিয়ডে’ যেতে হবে তাঁকে।
২০১৫ সালে বাংলার ক্রিকেট সংস্থার সভাপতি হয়েছিলেন সৌরভ। ২০১৯ পর্যন্ত সে পদের দায়িত্ব সামলে সে বছরই বোর্ডের সভাপতি হন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ২০২৫ সাল পর্যন্ত বোর্ডের দায়িত্বে থাকতে আইনগত বাধা নেই সৌরভের। যদিও আগামী তিন বছরের জন্য সৌরভকে আবারও নিয়োগ করতে হবে বোর্ডকে।
সৌরভের মতো জয়ও ২০১৯ সালে বোর্ডের পদে বসেছিলেন। এ বার সভাপতি হতে না পারলে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী তাঁকে আরও ছ’বছর অপেক্ষা করতে হবে। ৩৩ বছর বয়সি জয় স্বাভাবিক ভাবেই সেটা চাইবেন না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্র জয় এ বারই ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পদে বসতে চাইবেন। ছ’বছর পরে বোর্ডের রাজনীতি কোন খাতে বইবে, দেশের রাজনীতিই বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার তখনও থাকবে কি না, তার পুরোটাই অনিশ্চিত। স্বাভাবিক ভাবেই জয় নিজেকে এই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলতে চাইবেন না।
এই মুহূর্তে বোর্ডের নির্বাচন হলে ১৫টি বিজেপিশাসিত রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার ভোট যে জয়ের পকেটে যাবে, তা এক প্রকার নিশ্চিত। এমনকি, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ রেল, সার্ভিসেস এবং ইউনিভার্সিটির ভোটও জয় পাবেন। ফলে অধিকাংশ ভোটই জয়ের পক্ষে পড়বে।
ফলে সৌরভের পথে যে জয়ের ‘কাঁটা’ রয়েছে, তা এক প্রকার নিশ্চিত। ২২ গজের মহারাজের পথ দুর্গম করতে পারেন যে জয়, তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা কী রকম? তাঁর সম্পর্কে কতটাই বা জানে আমজনতা? নজর ঘোরানো যাক অমিত-পুত্রের জীবনে।
জয়ের জন্ম ১৯৮৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গুজরাতের আমদাবাদে। ক্রিকেট প্রশাসক হিসাবে নাম করলেও বাবার মতো রাজনীতির পথে পা রাখেননি জয়। বরং গুজরাতের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি টেক ডিগ্রিলাভের আগে তাঁর ঝোঁক ছিল ক্রিকেটের দিকে। আমদাবাদে জয়ন্ত সহগলের কাছে ক্রিকেটের খুঁটিনাটি শিখেছেন। ব্যাটার হিসাবে তিনি নাকি মন্দ ছিলেন না। এমনই দাবি আমদাবাদের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের। তবে ক্রিকেটকে পেশা হিসাবে বেছে নেননি এই ইঞ্জিনিয়ার।
জয়ের পেশাদার জীবন শুরু হয়েছিল ক্রিকেট মাঠ থেকে দূরে। গোড়ার দিকে পিভিসি পাইপের পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এর পর ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত টেম্পল এন্টারপ্রাইজ নামে এক সংস্থায় ডিরেক্টর হিসাবেও দায়িত্ব সামলেছেন। কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসাকারী ওই সংস্থাটি ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তত দিনে অবশ্য কুসুম ফিনসার্ভ নামে একটি সংস্থার ৬০ শতাংশ স্বত্ব কিনে নিয়েছেন জয়।
সংবাদমাধ্যমের দাবি, বাবার মতোই শেয়ার বাজারের খুঁটিনাটি নিয়ে ওয়াকিবহাল জয়। তবে বেসরকারির সংস্থায় কাজের ফাঁকে আমদাবাদ ক্রিকেটে প্রশাসক হিসাবে পা রেখেছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে আমদাবাদের সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ক্রিকেটের এগ্জিকিউটিভ বোর্ড সদস্য হিসাবে যোগ দেন জয়।
আমদাবাদের ক্রিকেট সংস্থায় প্রশাসক হিসাবে অভিজ্ঞতা কাজে এসে গিয়েছিল ২০১৩ সালে। সে বছরের সেপ্টেম্বরে গুজরাত ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (জিসিএ)-এর যুগ্মসচিব নির্বাচিত হন জয়।
যুগ্মসচিব হিসাবে আমদাবাদে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম নির্মাণের বিষয়েও কম উদ্যোগী ছিলেন না জয়। বস্তুত, সে সময় অমিত শাহ ছিলেন গুজরাত ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
২০১৫ সালের আর একটি বড় লাফ দেন জয়। সে বছর বিসিসিআইয়ের ফিনান্স অ্যান্ড মার্কেটিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জিসিএ-র যুগ্মসচিব পদ থেকে ইস্তফা দেন জয়। পরের মাসে তিনি দেড় বছরের জন্য বিসিসিআইয়ের সচিব হিসাবে নির্বাচিত হন। সে সময় জয়ই ছিলেন বিসিসিআইয়ের সর্বকনিষ্ঠ পদাধিকারী আধিকারিক।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা আইসিসি-র সিইসি বৈঠকে ভারতীয় বোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করেছেন জয়। সেটা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর।
২০২১ সালে জয়ের মুকুটে আরও একটি পালক জুড়ে যায়। সে বছরের জানুয়ারিতে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
ক্রিকেট প্রশাসক হিসাবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন জয়। তবে সৌরভের মতো আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার অভিজ্ঞতা কি তাঁকে কোনও ভাবে পিছিয়ে রাখতে পারে? এ তর্ক উঠলেও অনেকে প্রাক্তন বোর্ড সভাপতি জগমোহন ডালমিয়ার উদাহরণ দেন। তিনি তো ব্যাট-বল হাতে ২২ গজে নামেননি কখনও। তবে তা সত্ত্বেও ক্রিকেট প্রশাসক হিসাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
পেশাদার জীবন সামলানোর ফাঁকে সংসারও পেতে ফেলেছেন জয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঋষিতা পটেলের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। চিরাচরিত গুজরাতি রীতি মেনে কলেজের বান্ধবীকে বিয়ে করেছিলেন জয়।
ব্যবসায়ী গুনবন্ত পটেলের মেয়ের সঙ্গে জয়ের বিয়েতে চাঁদের হাট বসেছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, পীযূষ গয়াল, নিতিন গডকরীদের দেখা গিয়েছিল। ছিলেন গৌতম আদানি-সহ সস্ত্রীক মুকেশ অম্বানীও।
২০১৭ সালে জয় এবং ঋষিতার কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। ক্রিকেট প্রশাসনার ফাঁকে চুটিয়ে সংসার করছেন জয়।