রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সফল হয়নি। উল্টে কৌশলে ‘ওয়াগনার’ বাহিনীর সেই বিদ্রোহ নির্মূল করেছেন পুতিনই। এ বার পরবর্তী পদক্ষেপ করলেন পুতিন। ভাড়াটে সেনার ওই বাহিনীর প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় বসাতে চলেছেন আন্দ্রেই ত্রোশেভকে। কে এই আন্দ্রেই?
মস্কোর দিকে এগিয়ে চলেছিল প্রিগোঝিনের ভাড়াটে বাহিনী। কিন্তু জুনের শেষে পুতিনের গদি ওল্টাতে ব্যর্থ হয় সেই বাহিনী। রুশ সংবাদমাধ্যমের দাবি, এর পরেই পুতিন দেখা করেন প্রিগোঝিনের সঙ্গে। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ওয়াগনার বাহিনীর শীর্ষকর্তারা।
সংবাদমাধ্যমের দাবি, ওই বৈঠকেই ওয়াগনার গোষ্ঠীর মাথায় আন্দ্রেইকে বসানোর প্রস্তাব দেন পুতিন। আর প্রিগোঝিন? তাঁর কী হল? অভিযোগ, তাঁকে খুন করিয়েছেন পুতিন। আমেরিকার সেনার প্রাক্তন শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক জেনারেল রবার্ট আব্রাম বৃহস্পতিবার এই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘‘আর কখনও প্রিগোঝিনকে প্রকাশ্যে দেখা যাবে কি না সে বিষয়ে আমার গুরুতর সন্দেহ রয়েছে।’’
এককালে পুতিন-ঘনিষ্ঠ প্রিগোঝিনের বদলে তাঁর জায়গায় যিনি বসতে চলেছেন সেই আন্দ্রেইয়ের পরিচয় কী? ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাশিয়ার উপর বিধিনিষেধের নথি থেকে জানা গিয়েছে, তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে ‘সেদোয়’ বা ‘ধূসর চুন’ নামে পরিচিত।
ওই নথিই বলছে, আন্দ্রেই রাশিয়ার সেনার এক জন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। ওয়াগনার গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
১৯৫৩ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্ম আন্দ্রেইয়ের। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধের নথি বলছে, সিরিয়ায় ওয়াগনার বাহিনীর ‘চিফ অফ স্টাফ’ নিযুক্ত ছিলেন তিনি। সেখানে বাশার আল-আসাদ সরকারকে সাহায্য করেছিল ওয়াগনার বাহিনী।
নথি থেকে জানা গিয়েছে, সিরিয়ার দেই এজ-জ়োর এলাকায় সক্রিয় থাকতেন আন্দ্রেই। আসাদকে সাহায্য করেছিলেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধের নথি থেকে আরও জানা গিয়েছে, ওয়াগনার বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উটকিন, কমান্ডার আলেকজান্ডার সার্গিভিচ কুজনেৎসোভ, আন্দ্রে বোগাতোভের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে তাঁর। দিমিত্রি সেনার গুপ্তচর বিভাগের প্রাক্তন আধিকারিক ছিলেন।
রাশিয়ার যে ক’জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আন্দ্রেই।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার নথিতে আমেরিকা লিখেছে, আন্দ্রেই ওয়াগনার বাহিনীর এক জন শীর্ষকর্তা। তিনি সিরিয়ার যুদ্ধে আসাদকে সাহায্য করেছিলেন। সিরিয়ার সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করেছিলেন।
সিরিয়া যুদ্ধের আগে আরও বেশ কিছু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আন্দ্রেই। আফগানিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের সময় আফগান মাটিতে ছিলেন তিনি। বিদ্রোহী চেচেনদের সঙ্গে যুদ্ধেও রুশ সেনার হয়ে লড়েছেন।
রাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিশেষ বাহিনী এসওবিআর-এর কমান্ডার হিসাবেও কাজ করেছেন আন্দ্রেই। আফগানিস্তানে কৃতিত্বের জন্য দু’বার রেড স্টার শিরোপা পেয়েছেন তিনি।
সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ২০১৬ সালে রাশিয়ার সর্বোচ্চ পদক ‘হিরো অফ রাশিয়া’ পেয়েছিলেন আন্দ্রেই।
জুন মাসে ওয়াগনার বাহিনী ইউক্রেন সীমান্তবর্তী একাধিক এলাকার দখল নিয়েছিল। এর পর তারা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। মস্কো থেকে মাত্র ছ’ঘণ্টা দূরে পৌঁছে গিয়েছিল তারা।
সে সময় পুতিন দ্রুত নিজের অনুগত রুশ সেনাকে সামনে রেখে ‘বিদ্রোহীদের’ নিরস্ত করেছিলেন। বিভিন্ন পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, প্রিগোঝিন সে সময় রাশিয়া থেকে বেলারুসে চলে গিয়েছিলেন।
পুতিন-ঘনিষ্ঠ বেলারুসের প্রেসিডেন্ট আলেকজ়ান্ডার লুকাশেঙ্কো দাবি করেছিলেন, তিনিই মস্কোর সঙ্গে ওয়াগনার বাহিনীর সমঝোতা করিয়েছেন।
আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলির তরফে দাবি করা হয়েছিল, সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী প্রিগোঝিনকে বেলারুসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও ‘তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে’ লুকাশেঙ্কো দাবি করেন, তাঁর দেশে প্রিগোঝিন নেই।
ক্রেমলিনের তরফেও জানানো হয়, ওয়াগনার প্রধান কোথায় তারা জানে না। প্রিগোঝিন বেঁচে আছেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা ছড়ায়। আমেরিকার সামরিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর জি স্টাডি অফ ওয়ার’ দাবি করে, ক্রমশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা প্রিগোঝিনকে ফাঁদে ফেলতেই ওয়াগনার যোদ্ধাদের একাংশের সাহায্যে ‘বিদ্রোহের চিত্রনাট্য’ তৈরি করেছিলেন পুতিন!
‘অজ্ঞাতবাস’-এ যাওয়া প্রিগোঝিন অডিয়ো বার্তায় দাবি করেছেন, বিদ্রোহ নয়, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সরকার এবং তাঁর সেনার আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমেছিল ওয়াগনার বাহিনী।
এই পরিস্থিতিতে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস’ (এফএসবি) বলেছে, তদন্তে দেখা গিয়েছে যে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীর অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করে দিয়েছেন। এ বার একদা ঘনিষ্ঠ প্রিগোঝিনের জায়গায় আন্দ্রেইকে বসাতে চাইছেন পুতিন বলে খবর। এই আন্দ্রেইও কখনও পূর্বসূরির পথ ধরবেন না তো? ক্রেমলিনের অন্দরে সেই প্রশ্নও কিন্তু ঘুরছেই।