ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনী পরিবার হিন্দুজাদের বিরুদ্ধে মানব পাচার এবং কর্মী শোষণের মামলা চলছে সুইৎজ়ারল্যান্ডে।
পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ভারত থেকে ন্যূনতম বেতনে লোক নিয়ে এসে ব্রিটেনে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়িতে গৃহ পরিচারকের কাজ করান।
এই চার সদস্য হলেন প্রকাশ হিন্দুজা, কমল হিন্দুজা, অজয় হিন্দুজা এবং নম্রতা হিন্দুজা। এঁদের মধ্যে প্রকাশ হলেন হিন্দুজা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা পরমানন্দ দীপচাঁদ হিন্দুজার তৃতীয় পুত্র। ইউরোপে হিন্দুজা গোষ্ঠীর সমস্ত সংস্থার মাথায় রয়েছেন তিনি। কমল তাঁর স্ত্রী। অজয় পুত্র এবং নম্রতা পুত্রবধূ।
সুইৎজ়ারল্যান্ডের আদালতে প্রকাশ এবং কমলের সাড়ে পাঁচ বছরের জেলের সাজার দাবি উঠেছে। অজয় এবং নম্রতাকে সাড়ে চার বছরের জন্য কারাবাসে পাঠানোর প্রস্তাব উঠেছে।
জেনেভার আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, হিন্দুজারা তাঁদের আদরের পোষ্য কুকুরের জন্য যে অর্থ ব্যায় করেন, তার অর্ধেকও খরচ করেন না তাঁদের প্রাসাদে কর্মরত ভারতীয় পরিচারকদের জন্য।
এ হেন কর্মী শোষণের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, সেই হিন্দুজারা আসলে কারা? হিন্দুজারা ভারতীয় ধনকুবের গোষ্ঠী। তাদের সম্পত্তির পরিমাণ ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার কোটি টাকার সমান।
২০২৩ সালের ব্লুমবার্গের ধনীতালিকা অনুযায়ী এরা ভারতের ধনীশ্রেষ্ঠদের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে। ২০১৭ সালের তালিকায় এশিয়ায় দ্বাদশ স্থানে ছিল। ২০২২ সালে গোটা বিশ্বে ১৪৬তম স্থানে থাকলেও ২০২৩ সালের তালিকা থেকে বাদ পড়ে।
তবে তাতে দেশ এবং বিদেশের অর্থনীতিতে হিন্দুজাদের গুরুত্ব কমেনি। বরং বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন হিন্দুজারা এখনও বিভিন্ন দেশকে যুদ্ধের সময় নানা ভাবে সাহায্য করে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হল অর্থসাহায্য। হিন্দুজাদের অন্যতম ব্যবসা ব্যাঙ্কিংয়ের।
১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা পাকিস্তানে) সিন্ধের শিকরপুর শহরে ব্যাঙ্কের ব্যবসা শুরু করেন প্রেমানন্দ হিন্দুজা। পরে সেই ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে আসেন মুম্বইয়ে। পাঁচ বছরের মধ্যেই, ১৯১৯ সালে ইরানে আন্তর্জাতিক অফিসও খোলেন প্রেমানন্দ।
চার সন্তানের বাবা প্রেমানন্দ। ধীরে ধীরে ব্যবসায় যোগ দেন তাঁরাও। সত্তরের দশকে প্রেমচাঁদের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীচাঁদ হিন্দুজা ব্যবসার হাল ধরেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দুজাদের ব্যাঙ্ক ইন্দাস ইন্ডের।
এর পরে ধীরে ধীরে ব্যবসার বিস্তার হয়। ব্যাঙ্কিংয়ের ব্যবসার পাশাপাশি যানবাহন, তেল, স্বাস্থ্যক্ষেত্র, প্রযুক্তি-সহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবসা বৃদ্ধি করে হিন্দুজারা।
অশোক লেল্যান্ড, হিন্দুজা হাসপাতাল, হিন্দুজা সুইস ব্যাঙ্ক, গাল্ফ অয়েল, হিন্দুজা ন্যাশনাল পাওয়ার কর্পোরেশন, ব্রিটিশ মেটাল কর্পোরেশন, হিন্দুজা কলেজ-সহ বহু সংস্থা রয়েছে হিন্দুজা গোষ্ঠীর অধীনে।
বর্তমানে হিন্দুজা গোষ্ঠীর মাথায় রয়েছেন গোপীচাঁদ হিন্দুজা। ২০২৩ সালের মে মাসে শ্রীচাঁদের মৃত্যুর পরে তিনি এই গোষ্ঠীর দায়িত্ব নেন। গোপীচাঁদের পরেই রয়েছেন প্রকাশ। তার পরে তাঁদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অশোক হিন্দুজা।
ইতিমধ্যে হিন্দুজাদের তৃতীয় প্রজন্মও তৈরি হতে শুরু করেছে। গোপীচাঁদের পুত্র সঞ্জয় হিন্দুজা, ধীরজ হিন্দুজা ছাড়াও প্রকাশের পুত্র অজয় হিন্দুজা এবং অশোকের পুত্র সোম হিন্দুজা। তাঁরা প্রত্যেকেই হিন্দুজা গোষ্ঠীর নানা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত। গোটা বিশ্বে অন্তত দু’লক্ষ কর্মচারী কাজ করেন তাঁদের অধীনে। সেই হিন্দুজাদের বিরুদ্ধেই উঠেছে গৃহকর্মী শোষণের অভিযোগ।
অভিযোগ, হিন্দুজারা তাদের ব্রিটেনের প্রাসাদে দিনে ১৮ ঘণ্টা করে সপ্তাহে সাত দিনই কাজ করান ভারত থেকে আনা পরিচারকদের। অথচ বেতন দেন দিনপ্রতি ৬৬০ টাকা করে। অর্থাৎ বছরে ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকার কিছু বেশি। অথচ তাদের কুকুরদের জন্য ধার্য বাজেটে দেখা যাচ্ছে, বছরে খরচ করা হয়েছে ৮ লক্ষ ৯ হাজার ১৪৩ টাকা। অর্থাৎ কুকুরদের বাৎসরিক খরচের সিকিভাগ বরাদ্দ দিনে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করা কর্মীদের জন্য।
অভিযোগ এ-ও উঠেছে যে, হিন্দুজারা ভারত থেকে যাঁদের নিয়ে গিয়ে পরিচারক হিসাবে নিযুক্ত করেন, তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, অনুমতি ছাড়া প্রাসাদের বাইরে বেরোনোর অনুমতিও নেই তাঁদের। এমনকি, বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় মুদ্রায় বেতন দেওয়া হয় জেনেভার হিন্দুজা প্রাসাদে কর্মরত পরিচারক পরিচারিকাদের।
হিন্দুজাদের বিপক্ষের আইনজীবী বার্তোসা আদালতকে বলেছেন, গৃহপরিচারকদের সঙ্গে হিন্দুজারা যে আচরণ করেন, তাতে মনে হতে পারে, তাঁরা এক প্রকার কিনেই নিয়েছেন তাঁদের। এই মর্মে হিন্দুজা পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে মানব পাচার এবং কর্মী শোষণের অভিযোগ এনেছেন তিনি।
যদিও হিন্দুজারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের পাল্টা দাবি, তাঁদের পরিবারে যাঁরা পরিচারকের কাজ করেন, তাঁদের বেতনের পাশাপাশি আশ্রয় এবং খাবারও দেওয়া হয়। পরিচারকেরা যথাযোগ্য সম্মান পান। আত্মপক্ষ সমর্থনে কয়েক জন পরিচারিকার বয়ানও পেশ করেছেন হিন্দুজারা।
তাঁরা বলেছেন, শিশুর সঙ্গে বসে সিনেমা দেখা, বা তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, খেলা করা— এ সবকে কাজের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
একই সঙ্গে তারা এ-ও জানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারে পরিচারকের নিয়োগের বিষয়টি হিন্দুজা ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃপক্ষ দেখাশোনা করেন। এজেন্সি মারফত নিয়োগ করা হয় তাঁদের। তাঁরা কী পরিস্থিতিতে কাজ করছেন, তা তাঁদের জানার কথা নয়। সেই যুক্তি যদিও ধোপে টেকেনি।
আদালতে আইনজীবী প্রস্তাব দিয়েছেন, মামলা লড়ার জন্য আদালতের যে ১০ লক্ষ ফ্রাঁ খরচ হয়েছে সেই অর্থ দিতে হবে হিন্দুজাদের। এ ছাড়া আরও ৩৫ লক্ষ ফ্রাঁ জমা করতে বলা হয়েছে হিন্দুজা পরিবারের পরিচারকদের ক্ষতিপূরণের তহবিলে।
আপাতত আদালতে টানাটানি চলছে ধনকুবের হিন্দুজাদের সম্মান নিয়ে। সুইৎজ়ারল্যান্ডের আইনে মানবপাচারে অভিযুক্ত হিন্দুজাদের কী শাস্তি দেওয়া হবে, সে দিকেও নজর রয়েছে সবার।