রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ক্রকাস সিটি কনসার্ট হলে শুক্রবার রাতের হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে ‘এশিয়ার সবচেয়ে নৃশংস জঙ্গিগোষ্ঠী’ হিসাবে পরিচিত ইসলামিক স্টেট (আইএস)। প্রাথমিক ধারণা, এটি তাদের আফগান এবং মধ্য এশিয়া শাখার ‘কাজ’।
আইএসের আফগান এবং মধ্য এশিয়া শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান (সংক্ষেপে আইএসকে)-এর কয়েক জন ফিদায়েঁ এই হামলা চালিয়েছে বলে আমেরিকার গোয়েন্দা রিপোর্ট জানাচ্ছে। হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। আহত শতাধিক।
পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের একাংশ নিয়ে ছিল প্রাচীন খোরাসান অঞ্চল। আইএস-এর আফগান শাখা ওই অঞ্চলকে তাদের নামে জুড়ে নিয়েছে।
২০২১ সালের অগস্টে আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখল পর্বে কাবুল বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৮৫ জনকে খুন করেছিল আইএসকে। পরবর্তী সময় ধারাবাহিক ভাবে আফগান তালিবানের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
মূল সংগঠন আইএস-এর মতোই আইএসকে-র লক্ষ্যও খিলাফতের (খলিফার শাসন) পুনঃপ্রতিষ্ঠা। পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের নানগরহর, নুরিস্তান, কুনার প্রদেশ আইএসকে-র শক্ত ঘাঁটি।
একদা পাশতুন নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বাহিনীর ঘাঁটি জালাবাদের নানগরহর এখন আইএসকের ‘রাজধানী’। এখানে তাদের ঘাঁটিগুলিতে পাশতুনের পাশাপাশি আরব, পাক, উইঘুর এবং মধ্য এশিয়ার জঙ্গিরাও রয়েছে।
২০১৪-য় পাক তালিবান নেতা হাফিজ সঈদ খান আইএসকে গঠন করেছিলেন। তৎকালীন আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির অনুগামী হাফিজ ২০১৬-য় আমেরিকার বিমানহানায় নিহত হন। আমেরিকার হানায় বাগদাদির মৃত্যু ২০১৯-এ, সিরিয়ায়।
২০১৫ সালে আফগানিস্তানে আইএসকের প্রায় তিন হাজার জঙ্গি ছিল। তাদের বড় অংশই প্রাক্তন তালিবান। আমেরিকার সাহায্যে তাদের দমনে নেমেছিল আফগান সরকার। ক্ষমতার পালাবদলের পরে তালিবানও ধারাবাহিক লড়াই চালাচ্ছে আইএসকের বিরুদ্ধে।
প্রায় দু’দশক আগে আইএস-এর প্রতিষ্ঠা করেন আল কায়দার ইরাকি শাখার প্রধান আবু মুসাব আল জারকোয়াই। সে সময় সংগঠনের নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত (আইএসআইএল)। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের নানা দেশে তার শাখা তৈরি হয়।
তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডন, লেবানন, সাইপ্রাস, প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলের একাংশ নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন লেভান্ত ভূখণ্ড। পরে সাময়িক ভাবে সংগঠনের নাম হয় ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)।
ওসামা বিন লাদেনের জমানায় আল কায়দার সঙ্গে সখ্য ছিল আইএস-এর। পরবর্তী আল কায়দা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির সময় দুই সংগঠনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। আল কায়দা ঘনিষ্ঠ তালিবানেরও বিরোধিতা শুরু করে আইএস এবং তার শাখা আইএসকে।
তালিবান এবং আইএস দু’টি সংগঠনই সুন্নি মুসলিম সংগঠন। কিন্তু তালিবান ইসলামের দেওবন্দি মতাদর্শের অনুসারি। আইএস এবং তাদের শাখাগুলি অনুসরণ করে সালাফি মতবাদকে। সুফি মতবাদের কট্টর বিরোধী তারা।
নৃশংসতার অভিঘাতে তালিবানকেও ছাপিয়ে গিয়েছে আইএসকে। তালিবান সংগঠনে মহিলারা না থাকলেও পশ্চিম এশিয়ায় আইএস যোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন মহিলা জিহাদিরা। তবে আইএসকেতে এখনও সক্রিয় নন মহিলারা।
তালিবান বা আল কায়দা জঙ্গিরা সাধারণ ভাবে সুন্নি মসজিদগুলিকে হামলার নিশানা করে না। কিন্তু গত তিন বছরে আফগানিস্তানে এমন বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে তারা। পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়াতেও সম্প্রতি তাদের ‘সক্রিয়তা’ নজরে এসেছে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীর সঙ্গী হয়ে ধারাবাহিক ভাবে আইএস ডেরায় হামলা চালাচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সেনা। তারই জবাব দিতে এই হামলা বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে।
২০২২ সালে আইএসকে বাহিনী কাবুলের রুশ দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল। রাশিয়ার দুই কূটনীতিক-সহ ২০ জন নিহত হয়েছিলেন বিস্ফোরণ ও গুলিতে। তবে সে সময়ও হামলার ‘কারণ’ জানায়নি খোরাসানিরা।
ওয়াশিংটনের সামরিক পর্যবেক্ষক সংস্থা উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান শুক্রবার বলেন, ‘‘গত দু’বছরে পুতিনের কার্যকলাপে ‘ইসলাম বিরোধী’ ছাপ দেখছে আইএস এবং তার সহযোগীরা। সে কারণেই মস্কোতে এই হামলা।’’