রবিবার তৃতীয় বারের জন্য ক্রিকেটবিশ্বের সম্রাট হওয়ার হাতছানি ভারতের সামনে। কারণ এ দিনই আমদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হতে চলেছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া।
গত পাঁচ দশকে একাধিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানচিত্রে বিশিষ্ট স্থান অর্জন করতে পেরেছে ভারত। আইপিএলের মতো সীমিত ওভারের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জনক হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা আইসিসির কাছেও ক্রমশ কদর বেড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা বিসিসিআইয়ের।
বর্তমানে গোটা বিশ্বের ক্রিকেট খেলিয়ে দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে ধনী বোর্ডের তকমা পেয়েছে বিসিসিআই। আইসিসির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ভারতীয় বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বলে মনে করা হয়।
এই বিষয়ে অন্য ক্রিকেট বোর্ডগুলি বার বারই আইসিসির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। তবে আইপিএলের মতো টুর্নামেন্টের সফল রূপকার হিসাবে ক্রিকেট উন্মাদনা এবং বাণিজ্যকে বহু গুণ বৃদ্ধি করার কাজে বিসিসিআইয়ের গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে পারেন না কেউই।
তবে বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের এই প্রভাব এক দিনে তৈরি হয়নি। এক সময় তো ভারত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার সদস্য হবে কি না, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছিল। তখন অবশ্য নিয়ামক সংস্থার নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল’ বা আইসিসি ছিল না।
সে যাত্রা ভারতকে রক্ষা করেছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন এক জন আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক ব্যক্তি। তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু।
কী সেই সিদ্ধান্ত? কংগ্রেসের অন্দরেই সমালোচনার ঝড় উঠলেও ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত করে রাখার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন নেহরু।
নেহরুর এই একটি সিদ্ধান্তেই ভারতের ক্রিকেট-ভাগ্য বদলে গিয়েছিল। তখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার নাম ছিল আইসিসি। তবে এর সম্পূর্ণ নাম ছিল ‘ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স’।
নাম থেকেই স্পষ্ট যে, এর মধ্যে রাজকীয় একটা ব্যাপার ছিল। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হত।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘ভারতের শাসক’ হিসাবে স্বীকৃতি দেবে।
১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে গণপরিষদ সংবিধান গ্রহণ করল। নয়া সংবিধান কার্যকর হল তার পরের বছর, ২৬ জানুয়ারি।
সংবিধান মোতাবেক ভারত একটি সাধারণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পরেই কংগ্রেস নেতারা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলেন।
সেই সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি এবং বিরোধী নেতা উইনস্টন চার্চিল উভয়েই ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অংশ হওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
মূলত সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিকে নিয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ গঠিত। ৫৪টি দেশের এই সমবায় আলঙ্কারিক ভাবে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত।
তবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথে থাকার বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সাংবিধানিক সম্পর্ক রাখারও কোনও দায় নেই সদস্য দেশগুলির।
তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বল্লভভাই পটেলের মতো কংগ্রেসের বহু নেতাই কমনওয়েলথে থাকার বিষয়ে আপত্তি জানান। তবে দেশের সার্বভৌম ক্ষমতায় কোনও রকম হস্তক্ষেপ না করার শর্তেই কমনওয়েলথের সদস্য থেকে যায় ভারত।
সেই সময় ‘ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স’-এর নিয়ম ছিল যে, ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য না হলে কোনও দেশকে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থার সদস্য হিসাবে গণ্য করা হবে না।
১৯৪৮ সাল থেকে ভারত ‘ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স’-এর অস্থায়ী সদস্য হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৫০ সালে কনফারেন্সের সদস্যেরা বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেন, যে হেতু ভারত কমনওয়েলথে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই তাদের স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়া হবে।
কমনওয়েলথে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া নেহরু ব্যক্তিজীবনেও ক্রিকেটভক্ত ছিলেন। ব্রিটেনে পড়াশোনার সময়েই তাঁর এই খেলার প্রতি আগ্রহ জন্মায়।
১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী একাদশ বনাম উপরাষ্ট্রপতি একাদশ একটি প্রদর্শনীমূলক ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল। সেই ম্যাচে স্বয়ং নেহরু প্রধানমন্ত্রী একাদশের অধিনায়ক ছিলেন। ম্যাচে কিছু সময় তিনি ধারাভাষ্যও দিয়েছিলেন। বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪০ বছর পরে ব্যাট ধরলেও নেহরুর খেলা দেখে মনে হয়েছিল, এক জন পেশাদার ব্যাটার ব্যাট করছেন।