১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা লাহোর চুক্তি বা লাহোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত। ভারত এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই চুক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
সেই লাহোর চুক্তি সম্প্রতি শিরোনামে উঠে এসেছে। নেপথ্যে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফ। তিনি নিজের দলের একটি সভায় স্বীকার করে নিয়েছেন, লাহোর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছিল পাকিস্তানই। যা পাকিস্তানের অন্যতম ‘ভুল’।
১৯৯৯ সালে লাহোর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের ফলেই কয়েক মাসের মধ্যে শুরু হয় কার্গিল যুদ্ধ। দুই দেশের বহু সেনা জওয়ানের প্রাণ গিয়েছিল সেই যুদ্ধে। তবে শেষ হাসি হেসেছিল ভারতই।
বস্তুত, ভারত-পাক কূটনীতিতে ১৯৯৮ সালের মে মাসের উত্তাপ ছিল মারাত্মক। ওই বছরের ১১ থেকে ১৩ মে ভারত প্রথমে তিনটি এবং পরে আরও দু’টি পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।
ভারতের এই পারমাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষার পাল্টা হিসাবে ওই মাসেরই ২৮ তারিখে পাকিস্তান পর পর পাঁচটি পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায়। দুই দেশের কূটনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এর ফলে।
উত্তেজনা কমাতে উদ্যোগী হয়েছিল দুই দেশই। পরের বছরই ‘বন্ধুত্বের’ নিদর্শন হিসাবে চালু হয়েছিল দিল্লি-লাহোর বাস পরিষেবা। সেই বাসে করে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন স্বয়ং বাজপেয়ী।
১৯ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যান বাজপেয়ী। লাহোরের শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেন। তার পর ২১ ফেব্রুয়ারি লাহোর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দুই দেশের মধ্যে শান্তি এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই ছিল সেই চুক্তির মূল সুর।
লাহোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই কাশ্মীরে শুরু হয় কার্গিল যুদ্ধ। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতের এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছিল পাক সেনা। তা থেকেই যুদ্ধের সূত্রপাত।
পাকিস্তানের পরমাণু পরীক্ষার ২৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শাসক দল পিএমএল-এনের সভাপতি নওয়াজ় একটি সভায় শুক্রবার বলেন, ‘‘১৯৯৮ সালের ২৮ মে পাকিস্তান পাঁচটি পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। তার পরে বাজপেয়ী সাহেব এখানে এসে আমাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু আমরাই চুক্তি লঙ্ঘন করেছিলাম। ভুলটা আমাদের।’’
অতীতে বার বার দেখা গিয়েছে, কূটনৈতিক স্তরে ভারত এবং পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতামূলক কোনও পদক্ষেপ করলেই পাক সেনা এবং গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তা ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল বলে মনে করেন অনেকে।
কী ছিল লাহোর চুক্তিতে? কেনই বা তা লঙ্ঘন করে যুদ্ধ বাধাল পাকিস্তান? লাহোর চুক্তিতে দুই দেশই জম্মু ও কাশ্মীর-সহ যাবতীয় দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে একমত হয়েছিল।
ওই চুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, ভারত এবং পাকিস্তানের কেউ একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কেউ কোনও মন্তব্য করবে না। দুই দেশ তাতে সম্মত হয়েছিল।
দুই দেশ নিজেদের মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক নীতি গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়নের জন্য দু’দিক থেকেই চেষ্টা করা হবে বলে লাহোর চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল ভারত এবং পাকিস্তান।
পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার এড়াতে দুই দেশই অবিলম্বে পদক্ষেপ করবে বলে ঠিক করে। এই অস্ত্র যাতে ব্যবহার করার প্রয়োজন না পড়ে, সেই আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার জন্যও আলোচনা করবেন বলে সহমত হন রাষ্ট্রপ্রধানেরা।
দক্ষিণ এশিয়ার উন্নতিকল্পে সার্কের নীতিগুলি মেনে চলার চুক্তিও হয়েছিল ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে। এ ছাড়া, লাহোর চুক্তিতে দুই দেশই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণে সম্মত হয়েছিল।
এই চুক্তির কিছু দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জম্মু ও কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশ করে। শুরু হয় যুদ্ধ। অভিযোগ, লাহোর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ভারতে জঙ্গি প্রবেশে সহায়তা করেছিল পাকিস্তান।
বাজপেয়ী এবং নওয়াজ় দুই দেশে শান্তি ফেরাতে যে ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কার্গিল যুদ্ধের ফলে সেই উদ্যোগ ধুলোয় মিশে যায়। তার পরেও একাধিক বার পাকিস্তান আশ্রিত জঙ্গিরা ভারতে হামলা চালিয়েছে।
লাহোর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে যে পাকিস্তান ভুল করেছিল, তা সম্প্রতি স্বীকার করে নিয়েছেন নওয়াজ়। অনেকের মতে, এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী আসলে তৎকালীন পাক সেনাপ্রধান পারভেজ় মুশারফের উপর দোষারোপ করতে চেয়েছেন।
ভারত বরাবরই কার্গিল যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে লাহোর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগও তুলেছে নয়াদিল্লি। তবে এত দিন পাকিস্তান সেই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছিল। এত দিন পর নওয়াজ়ের ‘ভুল স্বীকার’ পাক রাজনীতিতে আলাদা মাত্রা যোগ করছে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।